Home লাইফ স্টাইল মাদকের আগ্রাসী থাবা থেকে বাঁচতে হলে যা করতে হবে

মাদকের আগ্রাসী থাবা থেকে বাঁচতে হলে যা করতে হবে

-ফাইল ছবি

।। জালাল উদ্দিন ওমর ।।

বিশ্বব্যাপী মানব জাতির জন্য ভয়াবহ এক সমস্যার নাম হচ্ছে মাদক। দেশে দেশে মহামারী আকারে আজ মাদকের আগ্রাসন ছড়িয়ে পড়েছে। মাদকের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়েছে লাখো মানুষের স্বাভাবিক জীবন, সুন্দর এবং সাজানো ভবিষ্যত। প্রতিনিয়তই অসংখ্য মানুষ মাদকে আক্রান্ত হচ্ছে এবং ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষই সর্বনাশা মাদকের ছোবলে আক্রান্ত। নর-নারী, ছোট-বড়, ধনী-গরীব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সবাই মাদকের নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। যে একবার মাদকের নেশায় আক্রান্ত হয়েছে, সে ক্রমেই আরো বেশি করে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এবং দিনের পর দিন আরো বেশি করে মাদক গ্রহণ করছে। এক পর্যায়ে সে ধ্বংস হয়ে যায়। নিয়মিত মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তি ক্রমান্বয়ে তার স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে ফেলে এবং আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মাদকে আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সংসার কর্ম কোনটাই স্বাভাবিকভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। সুতরাং মাদক দ্রব্য আছে যত, সবই নির্মূল করতে হবে। মাদকের কবল থেকে যে কোনভাবেই হোক মানবজাতিকে রক্ষা করতে হবে। মাদক বর্জন করে সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনই গড়তে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সকল মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ এবং প্রয়াস।

ক্যান্সারের মতো মাদকদ্রব্যও মানব দেহের সকল শক্তি এবং সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। এই মাদকের সাম্রাজ্য অনেক বিস্তৃত। সিগারেট, মদ, গাজা, আফিম, হিরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল ইত্যাদি মাদকের বিভিন্ন রূপ। এসবে মাদক বা নেশার মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। মাদকের প্রথম ধাপ কিন্তু ধূমপান। যারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা সবাই প্রাথমকিভাবে ধূমপানে আসক্ত ছিল। পর্যায়ক্রমে তারা শক্তিশালী মাদকে আসক্ত হয় এবং ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। সুস্থ শরীর এবং মন একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। মাদকদ্রব্য মানুষের শরীর এবং মন সবই ধ্বংস করে দেয়। এজন্য মাদককে নির্মূল করতে হবে। কেবলমাত্র আইন করে এবং মাদক ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিয়ে কখনো মাদককে নির্মূল এবং মাদকমুক্ত জীবন সম্ভব নয়। মাদক নির্মূল এবং মাদকমুক্ত জীবনের জন্য প্রয়োজন মাদকমুক্ত মানুষ। কারণ মাদক নির্মূলের জন্য যিনি আইন প্রয়োগ করবেন, তিনি যদি মাদকমুক্ত না হন এবং নিজেই মাদক গ্রহণকারী অথবা মাদক ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকেন তাহলে সেখানে মাদক নির্মূলের জন্য আইন যথাযথ প্রয়োগ হবে না। আইনের মাধ্যমে মাদক নির্মূল তখনই সম্ভব, যখন আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তি মাদকমুক্ত জীবনের অধিকারী এবং মাদক নির্মূলে অধিকারাবদ্ধ হবে। এজন্য মাদকমুক্ত মানুষ তৈরি করতে হবে এবং এর কোন বিকল্প নেই।

মাদক নির্মূলে প্রথমত মাদকমুক্ত মানুষ তৈরি করতে হবে এবং এটা সবারই দায়িত্ব। এ কাজটা সমাজের প্রাথমিক স্তর পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে, যার মূল ভিত্তি হচ্ছে পিতামাতা। পিতামাতার দায়িত্ব হচ্ছে, সন্তানকে ছোট বেলা থেকেই মাদক থেকে দূরে রাখা এবং মাদকমুক্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা। কোন অবস্থাতেই সন্তান যেন মাদক গ্রহণ না করে এবং মাদকাসক্ত না হয়ে পড়ে, সেই বিষয়টিকে অবশ্যই অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। তার জন্য পিতামাতাকে সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে হবে এবং মাদকের কুফল সম্পর্কে বুঝাতে হবে। তবে পিতা যেহেতু বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে থাকে, সুতরাং এ ক্ষেত্রে মাতার দায়িত্ব বেশি। পিতামাতারা তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার যাবতীয় চেষ্টা করেন, চাকরি অথবা ব্যবসার মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। পাশাপাশি মাদকমুক্ত জীবন-যাপনের শিক্ষা দিতে হবে। মাদকমুক্ত জীবন গঠনের কাজটি পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে।

দ্বিতীয়ত ছাত্ররা যাতে মাদকমুক্তভাবে গড়ে ওঠে, তার জন্য বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনতে হবে এবং মাদকমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষককে বলা হয় দ্বিতীয় জন্মদাতা। মাদকমুক্ত নাগরিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। যদি পাঠ্যপুস্তকে মাদকের কুফল সম্পর্কে বলা হয় এবং শিক্ষকরা যদি ছাত্রছাত্রীদের মাদকের কুফল সম্পর্কে শিক্ষা দেন এবং মাদক মুক্ত জীবন গড়ার জন্য মোটিভেশন করেন, তাহলে অতি সহজেই ছাত্রছাত্রীরা মাদকমুক্ত জীবন গড়বে এবং তারা বড় হয়ে মাদক নির্মূলে কাজ করবে। তৃতীয়ত দেশের সাংস্কৃতিক মাধ্যমকে মাদকমুক্ত করতে হবে। নাটক সিনেমা হচ্ছে সমাজের দর্পণ, সমাজকে পরিবর্তনের হাতিয়ার। এমন নাটক এবং সিনেমা তৈরি করতে হবে যাতে করে এইসব নাটক এবং সিনেমা দেখে মানুষ মাদকের কুফল সম্পর্কে জানতে পারবে। কিন্তু বিশ্বের দেশে দেশে বর্তমানে যে চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে তার প্রধান বিষয় হচ্ছে ভায়োলেন্স, অশ্লীল নৃত্য এবং কুরুচীপূর্ণ গল্পকাহিনী। এ অবস্থায় যদি আমরা সত্যিকার অর্থে একটি মাদকমুক্ত সুন্দর সমাজ গড়তে হলে নাটক-সিনেমায় ও পরিবর্তন আনতে হবে। তার জন্য নাটক ও চলচ্চিত্র থেকে ভায়োলেন্স, অশ্লীলতা এবং মাদকের ব্যবহার দূর করতে হবে এবং তৈরি করতে হবে মূল্যবোধ সম্পন্ন সুস্থ ধারার নাটক ও চলচ্চিত্র।

প্রবাদ আছে, Prevention is better than cure.. অর্থাৎ নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। শরীরে অসুখ হবার পর চিকিৎসা করে সুস্থ হবার চেয়ে অসুখকে প্রতিরোধ করাই উত্তম এবং এটাই সঠিক পথ। সবাইকে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চলতে হবে এবং এরপরও যদি শরীর অসুস্থ হয় তাহলে চিকিৎসা করে সুস্থ হতে হবে। একইভাবে সমাজটাকে যদি মাদকমুক্ত করতে হয় তাহলে সমাজ থেকে মাদক নির্মূল করতে হবে। তার জন্য মাদক বর্জন করতে হবে। তারপরও যদি কোন মানুষ মাদক গ্রহণ করে এবং মাদকাসক্ত হয়, তাহলে তাকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করতে হবে। কেউ যদি মাদক ব্যবসায় জড়িত হয়, তাহলে তাকে আইনের মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে। এটাই হচ্ছে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের একমাত্র পথ। রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা না করে শুধুমাত্র চিকিৎসার মাধ্যমে যেমন রোগকে কখনই নির্মূল করা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে মাদকমুক্ত মানুষ তৈরি না করে এবং মাদককে বর্জন না করে শুধুমাত্র মাদক ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিয়ে কিছুতেই মাদক নির্মূল করা যাবে না। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও সবাইকে মাদক নির্মূলে এগিয়ে আসতে হবে। তার জন্য মাদক বিরোধী সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের সুস্থ করে তোলার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মাদকদ্রব্যের উৎপাদন বন্ধের জন্য রাষ্ট্রের উদ্যোগে আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মাদক নির্মূলের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানকে রয়েছে, তাকে আরো বেশি সক্রিয় এবং গতিশীল করতে হবে। আর এখানে সত্যিকারের মাদকমুক্ত এবং মাদক নির্মূলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জনবল নিয়োগ দিতে হবে।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।