Home ওপিনিয়ন ‘খুব কষ্ট পাই, যখন দেখি মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় তালিকায় আমার নাম নেই’

‘খুব কষ্ট পাই, যখন দেখি মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় তালিকায় আমার নাম নেই’

সুমন কুমার দাশ: সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর অপর পারে ভারতের করিমগঞ্জ মহুকুমা। একাত্তরে সেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরে চালু হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতাল। সেটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মো. রুহুল আমিন ভূঞা। রণাঙ্গনে আহত হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা হতো এই হাসপাতালে। সেখান থেকে সুস্থ হয়ে তাঁরা দেশকে শত্রুমুক্ত করতে পুনরায় নামতেন যুদ্ধের ময়দানে।

১৯৭১ সালের জুন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগপর্যন্ত কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা করেছেন রুহুল আমিন ভূঞার স্বাস্থ্যসেবা দল। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে আসাম রাজ্য সরকারের অস্থায়ী নিয়োগ পেয়ে তিনি করিমগঞ্জের শরণার্থীশিবিরগুলোতে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা দিয়েছেন। রুহুল আমিন ভূঞার বয়স এখন ৯০ বছর। জীবনের পড়ন্ত সময়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠ দুঃখে ভরাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বললেন, ‘আমরা সেই সব সৌভাগ্যবান মুক্তিযোদ্ধা, যারা বেঁচে থেকেছি, স্বাধীন স্বদেশ দেখেছি; এটাই তো জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। ব্যক্তিগতভাবে কিছু পাবে, সেই লোভে কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। স্বাধীন রাষ্ট্র, সমৃদ্ধ দেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্মানজনক উন্নত জীবনের জন্য অজস্র মানুষ জীবন দিয়েছে, আত্মত্যাগ করেছে, সর্বাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে। কিন্তু আজ খুব কষ্ট পাই, যখন দেখি মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় তালিকায় আমার নাম নেই। তবে আমাকে কি কেউ মনে রাখেনি!’

চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, সন্তান–সন্ততিদের জন্য সরকারি চাকরি অথবা অন্য কোনো বৈষয়িক প্রয়োজনে ৯০ বছর বয়সী রুহুল আমিন ভূঞার বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের দরকার নেই। তিনি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ইতিহাসের এই স্বীকৃতিস্মারকটুকু তাঁর নাতি–নাতনিদের দিয়ে যেতে চান। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেঁচে থাকতে আগ্রহী। সে লক্ষ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নামটি লিখে রাখার জন্য তিনি ২০০৪ সালে প্রথমবার, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার এবং ২০১০ সালে তৃতীয়বার ফরম পূরণ করে আবেদন করলে যাচাই-বাছাই শেষে ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল তাঁকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় যুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বহুবার লেখালেখির পরও আজও তাঁর ভাগ্যে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটটি জোটেনি। গেজেটভুক্ত হওয়ার পর ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেয়েছিলেন; হঠাৎ সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।

সিলেট শহরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁরা এখনো জীবিত আছেন, তাঁদের কাছে ৪ নম্বর সেক্টরের মেডিকেল অফিসার মো. রুহুল আমিন ভূঞা সমাদৃত ব্যক্তি। একাত্তর সালে সিলেট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত শিক্ষক ও চিকিৎসকদের মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলায় অবস্থিত ছিল ৪ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। সেখানেই তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আসা তাঁর শিক্ষার্থী, হাসপাতালের নার্স, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট, মেডিকেল টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেক্টর হাসপাতাল।

আরও পড়তে পারেন-

একাত্তর সালের ৬ এপ্রিল তিনি স্ত্রী ও চার শিশুসন্তানকে নিয়ে হেঁটে সিলেট শহর থেকে বেরিয়ে পড়েন ভারতের সীমান্ত অভিমুখে। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ১৯ এপ্রিল জকিগঞ্জ থেকে কুশিয়ারা নদী পার হয়ে তিনি ঢুকেন করিমগঞ্জে। সেখানে তাঁদের আশ্রয় জোটে শরণার্থীশিবিরে। এরপর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আসামের কাছাড় জেলায় অবস্থিত আসাম ও ত্রিপুরার বৃহত্তম শরণার্থীশিবির দাসগ্রামের মেডিকেল অফিসার হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দেয় রাজ্য সরকার। সেই কাজের পাশাপাশি তখন থেকেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন এবং অস্থায়ীভাবে একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার লক্ষ্যে সিলেট থেকে পালিয়ে আসা স্বাস্থ্যকর্মীদের সংগঠিত করতে থাকেন। আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আগপর্যন্ত তিনি পুরো করিমগঞ্জ অঞ্চলের শরণার্থীশিবিরগুলোর চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

৪ নম্বর সেক্টরের প্রশাসক এবং জাতীয় পরিষদের সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী এবং সেক্টর কমান্ডার তৎকালীন মেজর সি আর দত্ত ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মেডিকেল অফিসার হিসেবে মো. রুহুল আমিন ভূঞাকে এবং সিনিয়র নার্স সরস্বতী হাওলাদার ও রোজি গোমেজকে নিয়োগ দিলে তখনই করিমগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতাল চালু হয়। আগস্ট মাসে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রুহুল আমিন ভূঞাকে ৪ নম্বর সেক্টরের মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়।

কাজে যোগ দিয়ে তিনি প্রথমেই পাঁচটি সাবসেক্টরের চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি সাধনে মনোনিবেশ করেন। তখন সাবসেক্টরগুলোতে সহকারী মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন কুকিতলে মৃগেন কুমার দাস চৌধুরী, বড়পুঞ্জিতে নজরুল আলম চৌধুরী, জালালপুরে রামেন্দ্র চন্দ্র তরাত, কৈলাসহরে একজন ফার্মাসিস্ট এবং কমলগঞ্জে একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট। প্রথমোক্ত তিনজন ছিলেন সিলেট মেডিকেল কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী, অন্য দুজনের নাম ৫০ বছর পর এখন আর মনে করতে পারেন না রুহুল আমিন ভূঞা। সেক্টর হাসপাতালে মেট্রনের দায়িত্বে ছিলেন আয়েশা বেগম, সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে সরস্বতী হাওলাদার ও রোজি গোমেজ এবং জুনিয়র নার্স পদে পারুল বালা, স্টোর ইনচার্জ পদে কানন দেবী, হাউসকিপার পদে কল্যাণী দে, দ্বিজেন্দ্র কুমার দে, বিলাশ চন্দ্র রায় ও ফার্মাসিস্ট পদে ফারুক উদ্দিন আহমেদের নাম এখনো তাঁর মনে আছে। প্রিয় ছাত্র ও পরবর্তী সময়ে খ্যাতিমান চিকিৎসক নজরুল আলম চৌধুরী মারা গেছেন, ডা. রামেন্দ্র চন্দ্র দেশান্তরিত হয়েছেন, জনপ্রিয় চিকিৎসক মৃগেন কুমার দাস চৌধুরী সিলেটে থাকেন, সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ হয়েছে। অন্যদের খবর তিনি জানেন না।

বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সিলেটের প্রবীণ চিকিৎসক মৃগেন কুমার দাস চৌধুরী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘রুহুল আমিন ভূঞা আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের নিয়োগকৃত চিকিৎসক ছিলেন। ৪ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। আমি ছিলাম ওই সেক্টরের একটি সাবসেক্টরের দায়িত্বে। প্রকৃত দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও স্যার কখনোই মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করেননি। বহু পরে স্যার ২০১১ সালে আবেদন করে বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হন। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত ভাতা পেলেও হঠাৎ করে ২০১৫ সাল থেকে তাঁর ভাতা বন্ধ হয়ে পড়ে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তাঁর মতো প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম সঠিক যাচাই-বাছাই ছাড়া ফেলে দেওয়া খুবই অনুচিত হয়েছে।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন ভূঞা মনে করেন, তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট না পাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের আন্তরিকতাহীনতা ও সীমাহীন অবহেলা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত যে ফরমটি পূরণ করে নিজের নাম তালিকায় তোলার চেষ্টা করেছিলেন, তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ।

সেখানে আবেদনকারী কোথায়, কোন সেক্টরে, কাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, সেসব তথ্য স্পষ্ট ও বিস্তৃতভাবে উল্লেখের জায়গা নেই। আছে স্থায়ী ঠিকানা লেখার কলাম। তিনি ৪ নম্বর সেক্টরে, অর্থাৎ সিলেট অঞ্চলে কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁর ফরমটি সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সব সময় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে। যেখানকার কেউই তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চেনার কোনো কারণ নেই।

রুহুল আমিন ভূঞা একবার একটি পত্র দিয়ে তাঁর কনিষ্ঠ ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠালে বহু চেষ্টা করে তৎকালীন সচিব এম এ হান্নানের হাতে তা পৌঁছে ছিল। তাতে একনজর চোখ বুলিয়ে সচিব জানিয়ে দেন, ডাক্তার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারীরা মুক্তিযোদ্ধা নন। এরপরও রুহুল আমিন ভূঞা খোঁজ নিতে দুয়েকবার সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় অথবা তাদের কোনো দপ্তর থেকে তিনি কখনো কোনো পত্রের জবাব পাননি।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলা কমান্ডের (বর্তমানে কমিটিহীন) সর্বশেষ কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে দিনরাত চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন, তাঁর নামই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। রাষ্ট্রের উচিত, দ্রুত তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে যথাযথ সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া। নাহলে এ গ্লানি সবাইকে ছুঁয়ে যাবে।’ [সূত্র- দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে]

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।