Home সম্পাদকীয় পঞ্চাশ বছরের অর্জন এবং আগামীর প্রত্যাশা

পঞ্চাশ বছরের অর্জন এবং আগামীর প্রত্যাশা

।। আবুল কাসেম হায়দার ।।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা আমাদের লাল সবুজের পতাকা নিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছি। সেই দিন বিজয়ের দিন। আর আমাদের স্বাধীনতা দিবস হচ্ছে ২৬ মার্চ। আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছি। আমাদের বিজয় অনেক কষ্টের, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতার এমন ইতিহাস খুবই কম রয়েছে। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই অর্জন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্জনও কিন্তু কম নয়। আমাদের প্রাপ্তির তালিকা বেশ বড়, সমৃদ্ধ, গৌরবময়।

আমাদের অর্জন: ১৯৭১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমাদের অর্জন বিস্ময়কর। দৃশ্যমান জগৎ থেকেই বোঝা যায় আমাদের অর্জন। শহর গ্রামে বিশাল পরিবর্তন। এদিকে বর্তমান সরকার মুজিব বর্ষে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ ভাতে-কাপড় আছে। কেউ এখন আর পূর্বের মতো ভুখা-নাঙ্গা থাকে না। স্বাধীনতার পূর্বে যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ৮৮ শতাংশ মানুষ, আজ সেখানে ২০ শতাংশের নিচে। অবশ্য এখন কোভিড-১৯ কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে আরও বেশ কিছু মানুষ যোগ হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের মানুষ পূর্বে ‘মঙ্গায়’ প্রতিবছর ভুগত। এখন আর তেমন হয় না।

বিগত ৫০ বছরে আমাদের ধান-চালের উৎপাদন প্রায় চারগুণ বেড়েছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে বেশ কম। এখন অধিকাংশ মানুষ ভাত-কাপড় পাচ্ছে। তখনকার সময় পুরাতন কাপড় কেনার জন্য ফুটপাত ছিল আমাদের বাজারে। যখন ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ছি, তখন পুরাতন কাপড়ের জামা কেনার জন্য গুলিস্তান আমরা নিয়মিত যেতাম। নতুন কাপড় কেনার তখন আমাদের অনেকের আর্থিক সমর্থ ছিল না।

এখন শাক-সবজি, মাছ-মাংস, দুধ-ডিমের উৎপাদন বেড়েছে। বেড়েছে মাথা পিছু ভোগের পরিমাণও। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার স্বাধীনতার পর থেকে অনেকদিন ছিল তিন/চার/পাঁচ শতাংশের। আজ আমাদের জিডিপি ৮ শতাংশের অধিক। এবার কোভিড-১৯ কারণে জিডিপি ৫.২ শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের মাথা পিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। তা এখন অনেক বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মাথাপিছু আয় ২০৭৯ মার্কিন ডলার স্বাধীনতার পর আমাদের রাজস্ব বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। আর ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে আমাদের মোট বাজেটের পরিমাণ ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেট ছিল তখন মাত্র ৫০১ কোটি টাকা। বর্তমানে ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট হচ্ছে ২ লক্ষ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।

আরও পড়তে পারেন-

আমাদের অর্থনীতির প্রধানতম বাহন হচ্ছে রেমিটেন্স। স্বাধীনতা উত্তর তা ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৮০ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৮ বিলিয়ন ডলারে। চলতি বছরে প্রতি মাসে তা বাড়ছে। গত নভেম্বরে’২০ সালে এসেছে ২০৭ কোটি ডলার। স্বাধীনতাত্তোর আমাদের রিজার্ভ ছিল না বললেই চলে। চলতি বছরের নভেম্বরে রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলার। এখন আমাদের ডলারের কোনো অভাব নাই। এক সময় এলসি করতে ডলার পেতাম না বা পেতে কষ্ট হতো, সময় লাগতো। রিজার্ভ ৩ থেকে ৪ মাসের আমদানি পরিমাণ থাকলেই চলে। এখন ৮-৯ মাসের আমদানির চেয়ে বেশি রিজার্ভ আমাদের রয়েছে।

স্বাধীনতার পর আমাদের ১০০ টাকায় ভারতীয় রুপি পেতাম ৩৫-৪০ রুপি। আর আজ? আজ আমরা পাচ্ছি ৮৫-৯০ টাকা। এখন পাকিস্তানের অবস্থা আরও খারাপ। এখন পাকিস্তানে ১৫০ রুপি দিয়ে এক ডলার ক্রয় করতে হয়। অথচ পাকিস্তানিরা বলেছিল ‘স্বাধীন হলে তোমরা খাদ্য পাবে না, খাবে কী?’ তোমাদের আছে শুধু কাঁচা পাট, চা ও চামড়া। তোমাদের সংসার চলবে না। তোমরা ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত হবে। একই কথা বলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের হেনরী কিসিঞ্জার। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি।’ এখন কী ভাবছেন পাকিস্তানিরা, আর কিসিঞ্জাররা। আমরা এখন অনুন্নত দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল। সারা বিশে^ আমাদের প্রশংসা। কৃষি, তৈরি পোশাক, রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসাবে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা, গড় আয়ু, আমদানি, রফতানি, রিজার্ভ, ডলারের মান, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু আয়ের মতো অনেক সূচকে এখন আমরা পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। সামাজিক অনেক সূচকে আমরা ভারতের চেয়েও এগিয়ে রয়েছি। কীভাবে বাংলাদেশের এই উন্নতি ঘটেছে তার কারণ ভারতীয় মিডিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছে।

গ্রামাঞ্চলে এখন ঘরে ঘরে আমাদের বিদ্যুৎ রয়েছে। দ্বীপাঞ্চলগুলোতে সাব মেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে। স›দ্বীপসহ অনেক দ্বীপে এখন বিদ্যুৎ রয়েছে। এই সকল দ্বীপে সরকার এখন শিল্প স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। আমাদের এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াট। খাদ্য উৎপাদনে আমরা প্রায় স্বয়ংসপূর্ণতা অর্জন করে ফেলেছি। আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদন ৪৫১ কোটি মেট্রিক টন। স্বাধীনতার পূর্বে এই অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন হতো এক কোটি টনের চেয়ে কম। বর্তমানে এক থেকে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি বিদেশে চাকরি করে দেশে ডলার পাঠাচ্ছে। চিন্তা করলে অবাক হতে হয়। বর্তমানে প্রায় পাঁচ থেকে ৬ কোটি মানুষ রেমিটেন্স সুবিধাভোগী। যেখানে রেমিন্টেস সেখানে নগদ অর্থের ছড়াছড়ি। বর্তমানে ১২ থেকে ১৫ লক্ষ হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী। দেশে দশ হাজারের অধিক ব্যাংকের শাখা রয়েছে।

দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। অনকে জেলায় এখন বিশ^বিদ্যালয় রয়েছে। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় সংখ্যা ১৫০-এর অধিক। মেডিকেল কলেজ, সাধারণ কলেজ, পলিটেকনিকেল কলেজের সংখ্যা নাই বললাম। এক সময় জেলায় ১টি বা ২টার বেশি কলেজ ছিল না। এখন প্রতিটি উপজেলায় কয়েকটা করে কলেজ রয়েছে। রয়েছে আলাদা মহিলা কলেজ। তারপর রয়েছে মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন স্কুল, প্রাথমিক বিদ্যালয়, হেফজখানা, হাইস্কুল, হাই মাদ্রাসা ইত্যাদি।

গ্রাম এখন শহরে পরিণত হয়েছে। আগে সপ্তাহে একদিন বা দুই দিন গ্রামে হাট বাজার বসত। এখন সকাল-বিকাল হাট-বাজার চলে। গ্রামের প্রতিটি বড় স্থানে হাট বা বাজার রয়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দোকানপাট, রাতের বেলায় এই সকল হাট-বাজার শহরের মতো ঝক ঝক করে। বিদ্যুতের বদৌলতে রাত্রিতে বাজার ঝলমল। দেশের প্রতিটি গ্রামে পাকা রাস্তা। গাড়ি, বেবিট্যাক্সি, মাইক্রোবাস গ্রামের রাস্তাগুলোতে চলছে। হাটে-বাজারে মহিলারা যাচ্ছে। এমন কি পর্দাশীল মহিলা পর্যন্ত গ্রামের বাজারে বাজার করছে। মাইলের পর মাইল মোটর সাইকেল দিয়ে চলাচল করা যায়। শত শত মোটর সাইকেল গ্রামগুলোতে চলে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যোগাযোগও বেশ উন্নত। নিমেষে বাস, ট্রেনে, স্টিমার ও লঞ্চে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাওয়া যায়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উড়োজাহাজ চলাচল বেড়েছে। বেসরকারি হেলিকপ্টারও চালু রয়েছে। অনেকে মজা করে হেলিকপ্টার দিয়ে বর-কনে সেজে বিয়ে করছে, আনন্দ করছে।

গ্রামে গঞ্জে জেলে, তাঁতী, কামার, কুমার ইত্যাদি পেশার মানুষ বেকার বেশি। এখন এই সকল লোক অন্য পেশা বেছে নিচ্ছে। চীনা ও ভারতীয় পণ্য এই সকল মানুষের বেকার করেছে। নতুন নতুন পেশায় এই সকল মানুষ যাচ্ছে। কেউ কেউ ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা প্রভৃতি বড় বড় শহরে চলে এসেছে। অবশ্য এখন কোভিড-১৯ কারণে অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছে। গ্রামের বাজারে এখন সব কিছু পাওয়া যায়। মোবাইল ফোন, ফ্রিজ, টিভি, জামা কাপড় জুতো, অন্যান্য বৈদ্যুতিক দ্রব্য থেকে শুরু করে সব কিছু গ্রামের বাজারে মিলছে। তাই শহরে আসার প্রয়োজন পড়ে না। পাইকারেরা গ্রামের দোকানে দোকানে মাল নিয়ে যায়। আর বাবুর হাটে যেতে হয় না। বিকাশে টাকা পরিশোধ হয়। লেনদেনে কোনো অসুবিধা নাই। গ্রামে সোনার দোকান আলোতে ঝলমল করে। ছোট বড় শহরে বড় বড় সুপার শপ গড়ে উঠেছে। এয়ারকন্ডিশান সকল দোকান। রেমিটেন্স প্রাপক এবং নব্য ধনীরা এখন গ্রামের ক্রেতা। এই সব দেখে গ্রাম না শহর ভুল হওয়ার মতো। মনে হয়, ছোট ছোট এক একটি ঢাকা শহর গ্রামে গড়ে উঠেছে।

তবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটু পিছিয়ে আছি আমরা। তবে সরকারি উদ্যোগে কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা দিচ্ছে। অনেক গ্রামে নব্য ধনীরা বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে তুলেছে। সেখানে শহরের মত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। প্রতিটি উপজেলা শহরে পরিণত হয়েছে। শত শত সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীতে জমজমাট উপজেলা যেখানে ক্লাব আছে, পাঠাগার আছে, বিনোদন কেন্দ্র আছে, সিনেমা হল আছে। সকলের হাতে হাতে মোবাইল। ইন্টারনেট ব্যবহাকরারী অনেক। মিনিটে খবর পাচ্ছে, নিচ্ছে। পূর্বের টেলিগ্রাম নেই। ডাকঘরও না থাকার মতো। এখন আর গ্রামে ডাক পিয়ন তেমন দেখা যায় না। ডাক বিভাগ ‘নগদ’ চালু করে ডাকঘরকে সচল রাখার চেষ্টা করছে।

এ এক নতুন বাংলাদেশ। একে চেনার কোন উপায় নাই। নতুন ধনীক শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে। তবে গ্রামের বিচার ব্যবস্থা এখন মুরব্বীদের হাতে নেই, চলে গিযেছে নব্য মাস্তানদের হাতে। শহর থেকে অনেক নব্য ধনী গ্রামে বাগান বাড়ি বানাচ্ছে। অন্যদিকে ইংরেজি শিখার ব্যবস্থা বেড়েছে। যুবকদের বিদেশ গমনের ইচ্ছা বেড়েছে। লক্ষ লক্ষ যুবক বিদেশ যাচ্ছে। লেখাপড়া বেশি গ্রামের যুবকেরা করে না। বিদেশ যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। সৌদি, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর সকল দেশে যুবকেরা যাচ্ছে। এখন আবার মহিলারা বিদেশ যাচ্ছে প্রচুর। তাই গ্রামের অবকাঠামো অল্প দিনের মধ্যে পরিবর্তন। টিনের ঘর পাকা হচ্ছে। সেনেটারি টয়লেট স্থাপন হয়েছে। পাকা ঘর বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দেশের উত্তরাঞ্চলে ফারাক্কা ও তিস্তা বাঁধের জন্য নদী নেই। পাল তোলা নৌকা আর দেখা যায় না। মাঝির সেই গান আর শোনা যায় না। আব্বাস উদ্দিনের গান আর গ্রামে গ্রামে শোনা বেশ কঠিন। মাঠে মাঠে গরু ছাগলও চরে না আর। এখন গরুর গোশত, ছাগলের মাংস দোকানে দোকানে সাজানো থাকে। মাছ, মাংসের খামার গ্রামে হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ধনে-ধান্যে পূর্ণ। এখন সোনার বাংলা সোনায় ভরপুর। এখন শহর-গ্রাম সর্বত্র জিডিপি, উন্নয়ন, মেগা প্রকল্প প্রভৃতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা। পৃথিবীর কে কত ধনী। আমরা ধনীদের তালিকা কত নম্বরে। আমাদের দেশের কোন ধনী, কোন অবস্থায় প্রভৃতি এখন চায়ের দোকানে আলোচনার বিষয়বস্তু। ক্রিকেট খেলা ছাড়া শিল্প সাহিত্য, অন্যান্য খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, লোকগীতি ইত্যাদি যেন পিছনে পড়েছে। এখন শহর-গ্রামের মানুষদের ভোগবাদিতা পেয়ে বসেছে। এখন টাকাই সব। টাকা উড়ছে সর্বত্র। অফিসের কেরানী, ড্রাইভার প্রভৃতির ব্যাংক হিসাবে পাওয়া যায় কোটি কোটি টাকা। ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমাদের সোনার বাংলা এগিয়ে।

আমাদের প্রয়োজন: স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরকে সামনে রেখে এবারে বিজয় দিবস আমাদের নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ। এখনো অনেক কিছু করার আছে আমাদের। আমাদের পদ্মা সেতু হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলীতে ট্যানেল হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লাইনের হাইওয়ে হয়েছে, আণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ স্থাপিত হয়েছে, আইটিতে আমরা বিশ^কে অবাক করে দিয়েছি। তারপরও কিছু অভাব আমাদের যন্ত্রণা দিচ্ছে। কী যেন আমাদের নেই। আমাদের অনেকের মনে যেন শান্তি নেই। আরও বেশ কিছু আমাদের প্রয়োজন। আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর করার জন্য, আমাদের দেশকে আরও উন্নত করার জন্য কিছু বিষয় গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তাতে সহজে, অল্প সময়ে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে পৌঁছতে পারবো।

১. করোনা থেকে মুক্তি: আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানুষকে করোনা থেকে কীভাবে মুক্ত করতে পারি। এখনও আমাদের দেশে হাজার হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে। ভ্যাকসিন এখনও আসেনি। শীঘ্রই ভ্যাকসিন আমরা পাবো আশা করি। সরকার অগ্রিম বুকিং দিয়েছে। দেশের সকল মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম থেকে সকলকে দূরে থাকতে হবে। সরকারকে শক্ত হাতে বিষয়টি মোকাবেলা করতে হবে। দক্ষতা, সততা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা এ ক্ষেত্রে আমাদের এই মহাসঙ্কট থেকে রক্ষা করতে পারে। আমাদের অর্থনীতি, উন্নতি, শিল্প-বাণিজ্য সকল কিছু করোনা মোকাবেলার উপর নির্ভর করছে। অর্থনীতি এখন কঠিন সময় অতিক্রম করছে। করোনা ব্যবস্থাপনার উপর সকল কিছু নির্ভর করছে।

২. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের দক্ষতা: আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, আইন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, পুলিশ বিভাগ, সেনাবাহিনীসহ সকল বিভাগকে আরও বেশি শক্তিশালী, কার্যকর, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে কাজ করার শপথ নিতে হবে। এ সকল প্রতিষ্ঠান দেশের কোনো দলের বা ব্যক্তির নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো যত বেশি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও গতিশীল হবে, দেশ তত বেশি উন্নত হবে।

৩. নির্বাচন ব্যবস্থা: মানুষকে নির্বাচনমুখী করতে হবে। এখন মানুষ নির্বাচনের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। সকল মানুষকে তার ন্যায্য ভোটের অধিকার আরও বেশি নিশ্চিত করার জন্য সকল রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে হবে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে মানুষের বাক স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার দিতে হবে।

৪. ব্যাংক ও আর্থিক খাতের উন্নয়ন: বিগত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে একটা টাল-মাটাল অবস্থা চলছে। পুঁজিবাজারসহ সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমাদের দুর্বল হয়ে পড়েছে। আজ সবচেয়ে যেটি প্রয়োজন তাহলো ব্যাংকিং খাতে আইনের শাসন নিশ্চিত করা। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে উধাও। অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। পুঁজিবাজার এখনও আমাদের আস্থার মধ্যে আসেনি। শিল্প বিপ্লবের পূর্ব শর্ত হচ্ছে, শক্তিশালী, স্বচ্ছ আর্থিক খাত। এই বিষয়টিকে সরকার বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে কার্যকর উদ্যোগ আরও বেশি প্রয়োজন। মুদ্রা পাচার রোধ করার জন্য দেশে বেশি বেশি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, সুযোগ দিতে হবে। দেশে লাভজনকভাবে বিনিয়োগ করতে পারলে বিদেশে টাকার পাচার বন্ধ হয়ে যাবে। টাকার অর্থাৎ পুঁজি রক্ষার নিশ্চয়তা পেলে মানুষ দেশে অধিক বিনিয়োগ করবে। তাতে কর্মসংস্থান বাড়বে, বেকারত্ব কমে আসবে। নতুন করে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান না দিয়ে যে সকল প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সুশাসন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।

৫. শিক্ষা ও কৃষি: স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্জন শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি ও প্রবাসে জনশক্তি রফতানি, তৈরি পোশাক শিল্পের উপর ভর করে আছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি অনেক। তবে আরও কিছু দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। শ্রীলঙ্কায় তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিক হতে হলে ইংরেজি মাধ্যমে এ লেভেল, ও লেভেল ছাত্রছাত্রী হতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষা ক্ষেত্রে এই উপমহাদেশে শ্রীলঙ্কা অনেক অগ্রসর। আমাদের দেশে এখনও অনেক গ্রাম রয়েছে, যেখানে একটি প্রাইমারি স্কুল নেই। সরকারকে এই সকল গ্রাম চিহ্নিত করে দ্রুত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশ থেকে প্রচুর অদক্ষ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশে চাকরিতে যাচ্ছে। অদক্ষ হওয়ার কারণে উপার্জনও কম, পরিশ্রম বেশি। রেমিটেন্সও তাদের মাধ্যমে কম আসে। তাই দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য করোনা পরবর্তী দক্ষ শ্রমিক যাতে আমরা বিদেশে পাঠাতে পারি তার জন্য প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে হলেও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট স্থাপন জরুরি। উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীগণ ছয় মাস, এক বছর বা অধিক সময়ের কোর্স করে বিদেশে ও দেশে কর্মসংস্থান করতে পারবে। অন্যদিকে সরকারের উচিত হবে যে সকল স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাকে পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে তাদের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে নেয়া। এই সকল প্রতিষ্ঠান শিক্ষা ক্ষেত্রে তখন বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে।

বর্তমান কৃষি আমাদের জাতীয় আয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। তারপরও কিছু কিছু খাদ্য পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় এই সকল পণ্য দেশে উৎপাদনের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করে কার্যকর করা প্রয়োজন। বিশেষ করে পেঁয়াজ, মরিচ, হলুদ, রসুন ও নানা মসলা আমরা আমাদের দেশে উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারি। এই জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিশেষ উদ্যোগ। আমাদের দেশের কৃষক বুদ্ধিমান-পরিশ্রমী। এক সময় কোরবানির সময় ভারত থেকে গরু আমদানি না করলে আমাদের কোরবানির পশুর সমস্যা হতো। এখন দেশে প্রচুর গবাদি পশু পালনের ফলে এই সমস্যা দূর হয়েছে। তেমনিভাবে প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। মৎস্য উৎপাদনে আমরা এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। নানা পদের মাছ আমাদের দেশে উৎপন্ন হচ্ছে। আমরা বিদেশে রফতানি করছি। করোনা পরবর্তী অর্থাৎ করোনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ের পর কৃষিপণ্যের চাহিদা পূরণে আমাদের এখন থেকে যত্নবান হতে হবে।

লেখক: গবেষক, শিক্ষানুরাগী, সম্পাদক ও শিল্প উদ্যোগক্তা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।