Home বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফিঙ্গারপ্রিন্ট না থাকলে কী হবে আপনার?

ফিঙ্গারপ্রিন্ট না থাকলে কী হবে আপনার?

জিয়া চৌধুরী: ১৯৩০-এর দশকে কুখ্যাত আমেরিকান ব্যাংক ডাকাত জন ডিলিঞ্জার নিজের আঙুলের ছাপ (ফিঙ্গারপ্রিন্ট) মুছে ফেলার জন্য যাচ্ছেতাই কাণ্ড করেছিলেন। এসিড দিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পুড়িয়ে ফেলে নিজেকে ভয়ানক যন্ত্রণা দিয়েছিলেন তিনি। কোনো অপরাধস্থলে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সূত্র ধরে যেন তাকে শনাক্ত করা না যায়, এ কারণেই এমন প্রচেষ্টা ছিল তার।

তবে ঘটনা ডিলিঞ্জারের মতো না হলেও, কিছু কিছু মানুষের আসলেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই; তাই তারা প্রয়োজনে সেটি ব্যবহার করতে পারেন না। এটি তাদের জন্মগত ত্রুটি। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার অপু সরকার তাদেরই একজন।

বছরের পর বছর ধরেই অপুর জীবনের বিভিন্ন ধাপে অ্যাডারমাটোগ্লাইফিয়া হয়ে রয়েছে একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। এরমধ্যে, জাতীয় পরিচয় পত্রের (এনআইডি) আবেদনের সময়ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট না থাকায় বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের জেনেটিক অ্যান্ড রেয়ার ডিজিজেস ইনফরমেশন সেন্টারের তথ্যমতে, অ্যাডারমাটোগ্লাইফিয়া হলো হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল, হাতের তালু ও পায়ের তালুর চামড়ায় রেখার ঘাটতির একটি চরম বিরল পরিস্থিতি। এইসব রেখার কারণেই প্রতিটি মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট একেবারেই আলাদা হয়। তাই অ্যাডারমাটোগ্লাইফিয়া যাদের, তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্ত করা যায় না। এ কারণে এনআইডি পেতে দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে অপুকে। ২০১৬ সালে আবেদন করে ২০১৮ সালে পেয়েছিলেন তিনি।

“বংশগতভাবে আমার আঙুল ও পায়ের ত্বকে রেখা নেই, আর এ কারণে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই আমার। আমার বাবারও একই অবস্থা। তার এনআইডি কার্ডে লেখা রয়েছে: ‘ফিঙ্গারপ্রিন্টস নট অ্যাভেইলেবল’,” দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন ২৩ বছর বয়সী অপু।

আরও পড়তে পারেন-

এনআইডি রেজিস্ট্রেশনের সময় তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ সমস্যার কথা জানালেও কেউ কর্ণপাত করেননি। নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা তাকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বলেন। অবশেষে যখন এনআইডি হাতে পেলেন, দেখেন, সেখানে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্পর্কে কোনোই তথ্য দেওয়া নেই।

‘এখন আমি সিম কার্ড কিনতে পারছি না। কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে গেলে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়া আবশ্যক হলে আমি ডিভাইসে আঙুল রাখি ঠিকই, কিন্তু ডিসপ্লেতে কিছুই আসে না,’ বলেন তিনি। ‘কয়েক মাসের প্রচেষ্টা শেষে, অবশেষে মায়ের নামেই একটি সিম কার্ড কিনতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু যদি আরেকটা কিনতে চাই, তাহলে কোনো বন্ধুর সাহায্য নিতে হবে,’ বলেন অপু।

দিন কয়েক আগে তার সিম কার্ডটি নষ্ট হয়ে গেছে, তাই সেটি রিপ্লেস করার দরকার ছিল। কিন্তু সে কারণে মাকে কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার ঝক্কি পোহাতে হয়েছে তাকে। এরপরই শুধু তিনি নতুন একটি সিম কার্ড পেয়েছেন।

‘এই হলো সমস্যা। অন্য কারও নামে সিম কার্ড কিনতে হয় আমাকে; কিন্তু তারা তো সব সময় আমার সঙ্গে থাকবেন না। তাই সিম কার্ড কেনার অন্য কোনো উপায় থাকলে ভালো হতো। এ সমস্যা নিয়ে কার সঙ্গে কথা বললে কাজ হবে, আমি আসলেই জানি না,’ তিনি বলেন।

স্থানীয় নির্বাচন কমিশন অফিস এবং মোবাইল ফোন অপারেটরটির রাজশাহী ডিভিশনাল কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের বেশ কয়েকবারই দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। কিন্তু এ সমস্যার কোনো সমাধান পাননি।

নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে তাকে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পর তারা বলেছেন নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে! ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট না থাকলে কী যে ঝামেলা পোহাতে হয়, তা শুধু আমিই জানি। এই যে বছরের পর বছর ধরে এত সমস্যা পোহাচ্ছি, জানি না এর সমাধান কার কাছে,’ হতাশ কণ্ঠে বলেন তিনি।

এদিকে, ২০১১ সালে দ্য ডেইলি মেইলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তেল আবিব ইউনিভার্সিটির স্যাকলার ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন এবং তেল আবিব সুরাস্কি মেডিক্যাল সেন্টারের অধ্যাপক এলি স্প্রেচার জানিয়েছেন, ফিঙ্গারপ্রিন্ট না থাকার মতো বিরল পরিস্থিতির জন্য জিনের বিবর্তন দায়ী।

এক সুইস নারী যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টাকালে অ্যাডারমাটোগ্লাইফিয়া প্রথমবার চিকিৎসা কমিউনিটির নজরে আসে; কেননা, যারা ওই দেশের নাগরিক নন, তাদের প্রবেশকালে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে হয়।

ওই নারী যখন জানান, তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই, তখন সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে যান। পরে এক জিনগত বিশ্লেষণে জানা যায়, শুধু তিনিই নন, তার পরিবারের আরও ৯ সদস্যের কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই।

এদিকে, ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এনআইডিতে প্রথম নাম উঠেছিল ৪৭ বছর বয়সী সরকারি কর্মকর্তা আবু হানিফ টিপুর। অপুর মতো জন্মগতভাবে অ্যাডারমাটোগ্লাইফিয়ার শিকার না হলেও এনআইডি রেজিস্ট্রেশনের সময় আঙুলের রেখা নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয় টিপুকে।

তবু এনআইডি কর্তৃপক্ষ তাকে রেজিস্টার করতে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, ২০১৮-১৯ সালের দিকে তার রেখাগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। এখন তার কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই! ‘এর পর থেকে আমাকে নানা রকমের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে,’ বলেন তিনি।

টিপু সম্প্রতি তার বাংলালিংক সিমকার্ড হারিয়েছেন। এরপর নতুন কার্ড তুলতে অন্তত পাঁচটি কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে ধর্ণা দিয়েছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে কেউই তার সমস্যাটির সমাধান দিতে পারেনি।

তিনি আরও জানান, ‘আমার গ্রামীণফোন ও টেলিটক সিম কার্ডের বেলায় কী হবে, ভাবতেই ভয় লাগছে। যদি একই সমস্যায় পড়ি?’ বিষয়টি মোবাইল ফোন অপারেটরদের গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত বলে জানান অপু।

জন্মগতভাবে অ্যাডারমাটোগ্লাইফিয়ায় আক্রান্ত আরেক তরুণ আহমেদ আরিফুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ‘অন্যদের মতো আমার আঙুল আছে ঠিকই, কিন্তু রেখা নেই। শুনতে উদ্ভট লাগলেও আমার ক্ষেত্রে এটাই সত্য।’

শুধু সিম কার্ড কিনতে গিয়েই ঝামেলা পোহাননি আরিফ। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়া পাসপোর্টের আবেদন করতে পারলেও, রিনিউ করতে গিয়ে মুসিবতে পড়েন। কেননা, ততদিনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। এছাড়া, বিমানবন্দরেও ঝামেলা পোহাতে হয় তাকে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক সিস্টেম বিশ্লেষক নুসরাত জাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, জানামতে পৃথিবীতে মাত্র চারটি পরিবারে অ্যাডারমাটোগ্লাইফিয়া রয়েছে।

ফিঙ্গারপ্রিন্ট না থাকায় আন্তর্জাতিক সীমান্ত পাড়ি দেওয়া কঠিন হয় বলে এটিকে তিনি ‘ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ’ বলেও অভিহীত করেন।

প্রখ্যাত চর্মরোগবিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. এমইউ কবির চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তিনি তার সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে এ রকম রোগী পেয়েছেন মাত্র কয়েকজন। ‘বাংলাদেশে কতজন এ রোগে আক্রান্ত, সেই তথ্য আমাদের জানা নেই,’ বলেন তিনি। সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।