Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ চীনকে নিয়ে পশ্চিমাদের এত উদ্বেগ কেন?

চীনকে নিয়ে পশ্চিমাদের এত উদ্বেগ কেন?

।। নাহিদ ভূঞা ।।

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় নব্য উপনিবেশবাদের অভিযোগ তুলে এসেছে পশ্চিমা বিশ্ব। যদিও চীন উপনিবেশিক আমলের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মতো ক্ষমতা দখল করে না, তবুও বলা হয় যে সম্পর্কটা অনেকটা সেরকমই হয়। সমালোচকদের মতে, অনেক দেশের সাথে চীনের সম্পর্কের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে উনিশ এবং বিশ শতকের আফ্রিকা ও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তির সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে।

দেশগুলো চীন উৎপাদিত পণ্যের জন্য তাদের নিজেদের উৎপাদিত প্রাথমিক পণ্য বিনিময় করে; চীন স্থানীয় অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে; দেশগুলো চীনের ভারী ঋণে নিমজ্জিত হয়ে আছে; চীন স্থানীয় রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ রাখে; এবং বিদেশে চীনারা তাদের নিজস্ব ‘অভিবাসী ছিটমহল’গুলোতে বাস করে। পাইপলাইন এবং মহাসড়কের মতো বেইজিংয়ের আন্তঃরাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগুলো আদতে আরও বেশি সম্পদ চীনে প্রেরণের কৌশল হিসেবে দেখা হয়। এই প্রকল্পসমূহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে রিক্ত করে দিচ্ছে বলে সমালোচনা রয়েছে।

তাছাড়া, চীনা প্রকল্প এবং বিনিয়োগগুলোতে খুব অল্প সংখ্যকই স্থানীয় সরবরাহকারী এবং অংশীদাররা যুক্ত হতে পারে এবং সেগুলো স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে খুব অল্পই অবদান রাখে। এর প্রধাণ কারণ প্রকল্পগুলোতে চীনা শ্রমিকই বেশি নিযুক্ত হয়। বলা হয়, চীন ঋণগ্রাহক দেশগুলোর উপকার করার চেয়ে ক্ষতিই বেশি করে কারণ চীনের সস্তা পণ্য স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়।

আফ্রিকাকে নতুন এই চীনা বৈশ্বিক ‘সম্প্রসারণবাদের’ বৃহত্তম শিকার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। চীন বিশ্বজুড়ে প্রধানত আফ্রিকা থেকে খনিজ, জীবাশ্ম জ্বালানী এবং কৃষিপণ্যের মতো কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজস্ব কারখানাগুলোকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। ৩৯টা আফ্রিকান দেশে চীনের ‘উপস্থিতি’ রয়েছে এবং এই মহাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারও চীন। চরম অর্থসংকটে থাকা আফ্রিকান দেশগুলো চীনের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং ঋণ সহজেই স্বীকার করে নিয়েছে, যদিও এগুলো সাথে করে নানারকমের শিকল নিয়ে এসেছে। বলা হয় চীন একটি দেশকে ঋণ দেয় এবং জালে আবদ্ধ করে ফেলে। অর্থনৈতিক শিথিলতা, রাজনৈতিক সমর্থন বা উভয়ের সংমিশ্রণের মাধ্যমে ঐ দেশকে অবশ্যই এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

যদিও প্রায়শই এধরনের চুক্তির প্রেক্ষিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, সমালোচকরা মনে করেন যে আদতে চুক্তিগুলোতে চীনের স্বার্থই বেশি রক্ষিত হয়। এতে করে একদিকে চীনকে কাঁচামাল পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় অপরদিকে প্রশ্নবিদ্ধ মানের সস্তা পণ্য আমদানি করে স্থানীয় উৎপাদনকারীদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। কিছু বিশ্লেষক আফ্রিকায় চীনের বহু বিলিয়ন ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে সহায়তার নামে ঋণের ফাঁদ পাতার অভিযোগ করেছেন। সমালোচকরা এর নাম দিয়েছেন ‘ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি’ (debt trap diplomacy)। আফ্রিকা বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে গত শতাব্দী থেকেই চীনের নজর আফ্রিকার দিকে থাকলেও মূলত এই শতাব্দীর প্রথম প্রান্তিকের মধ্যেই চীন পুরো মহাদেশের শীর্ষ কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠে এবং আফ্রিকায় চীনের প্রভাব উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। একদিকে চীনা প্রশাসন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাস্তবায়ন করতে (যেটি ভবিষ্যতে চীনের বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দেয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ সুগম করবে বলে চীনা প্রশাসন মনে করে) ঋণ দেয় অপরদিকে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে কৌশলে দেশগুলোর সম্পদ জব্দ করে নিচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণগুলো হচ্ছে জাম্বিয়া, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া। উদাহরণস্বরূপ, জাম্বিয়ায় চীন তামার খনিতে বিনিয়োগ করেছে। খনিগুলোতে চীন লোকবল ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে, চীনা শ্রমিকরা জাম্বিয়ান শ্রমিকদের স্থান নিয়ে নিয়েছে। যার ফলে জাম্বিয়ায় বেকারত্ব বাড়ছে। এছাড়াও, চীনা কোম্পানিগুলো স্থানীয় খনিজ শ্রমিকদের মৌলিক সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ না করে সুরক্ষা বিধিগুলো উপেক্ষা করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কেনিয়ানরা তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর চীন দখল করে নিতে পারে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যেহেতু আফ্রিকান এই দেশটি চীনা ঋণ পরিশোধে অক্ষম।

অনুরূপ উদ্বেগ বিশ্ব এর আগেও দেখেছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে, শ্রীলঙ্কা চীনা ঋণদাতাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ শোধ করতে হাম্বানটোটার নবনির্মিত বন্দরের নিয়ন্ত্রণ একটি চীনা অপারেটরের হাতে তুলে দিয়েছিল। কিছু পশ্চিমা সূত্র দাবি করে যে এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং আফ্রিকা জুড়ে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোর সাথে রাজনৈতিক লাভ অর্জনের জন্য চীন কৌশলগতভাবে ঋণ দেওয়াকে ব্যবহার করে, অন্যদিকে চীনঘেঁষা সূত্রগুলো বেশ কয়েকটি ঘটনার ভিত্তিতে বিপরীতটি দাবি করে। কিছু সূত্র দাবি করেছে যে কেনিয়ার বাহ্যিক ঋণের ৭০ শতাংশই চীনা ঋণ, অন্যরা বলছেন যে এটি মাত্র ২১ শতাংশ। কেনিয়াকে চীনের দেওয়া ঋণের অনুমিত পরিমাণ ২১ শতাংশ হলেও এটি উদ্বেগের বিষয় কেননা বেইজিংয়ের ঋণ কূটনীতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কিছু আফ্রিকান দেশকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

নিজেদের অ্যালুমিনিয়াম কারখানাগুলোকে সচল রাখতে চীন গিনি থেকে বক্সাইট সংগ্রহ করছে। বিশ্বের বক্সাইট রিজার্ভের একটা বড় অংশই গিনিতে। গিনির মোট দেশীয় উৎপাদনের (GDP) দ্বিগুণ পরিমাণ ঋণ দেয়ার আশ্বাসে বেশ কয়েকটি চীনা প্রতিষ্ঠান বক্সাইট রিজার্ভগুলোতে খনন ও বক্সাইট উত্তোলনের অনুমোদন পেয়েছে। ২০১৮ সালে চীনা অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনকারী এক প্রতিষ্ঠান গিনির বোকে শহরে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়।

একই বছরেই আরেক চীনা অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানী ‘জিবো রুন্ডি’ ২৫ বছরের খনন কাজের অনুমোদন পায় যেখান থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন টন বক্সাইট উত্তোলন করবে তারা। গিনি ২০১৮ সালে প্রায় ৩কোটি ৮২ লাখ টন পরিমাণ অ্যালুমিনিয়ামের কাঁচামাল বক্সাইট চীনে রপ্তানী করে। তবে এসব বড় বড় চুক্তি থেকে গিনির জনগণ খুব কমই সুবিধাভোগী হচ্ছে। ২০১৮ সালে এক শ্রমিক নেতার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২ সপ্তাহ ধরে খনি শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করে। ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকির প্রশ্নে খনি মালিক ও স্থানীয় দরিদ্র জনগণের মাঝে দাঙ্গা বেঁধে যায়। ২০১৮ সালের এপ্রিলে আরো নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে তেলিমেলে জেলায় চীনা মালিকানাধীন খনিতে শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করে।

কেনিয়ার অডিটর জেনারেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চায়না এক্সিম ব্যাংকের ঋণের ক্ষেত্রে খেলাপি হলে দেশটি মোম্বাসা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। কেনিয়া রেলওয়ে কর্পোরেশনের (KRC) জন্য ২.৩ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণের শর্তাদিতে উল্লেখ আছে যে বন্দরের সম্পদ এই ঋণের জামানত হিসেবে কাজ করবে, এবং চুক্তিতে কিছু শিথিলতার কারণে সে সম্পদগুলো কেনিয়ার সার্বভৌম অনাক্রম্যতা (sovereign immunity) দ্বারা সুরক্ষিতও নয়। মোম্বাসা-নাইরোবি স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলপথ (SGR) নির্মাণের জন্য কেনিয়া বহু-বিলিয়ন ডলারের এই ঋণ গ্রহণ করে। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চীন কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (CCCC) অধীন প্রতিষ্ঠান চায়না রোডস অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশন (CRBC) এই নির্মাণ কাজের মূল বাস্তবায়নকারী ছিল।

উল্লেখিত উদাহরণগুলোর বাইরেও চীনা ঋণে জর্জরিত হয়ে রয়েছে জিবুতি, তাজিকিস্তান, মালদ্বীপ, মাদাগাস্কার, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশসমূহ। জিবুতির মোট দেশীয় উৎপাদনের (GDP) ৮৮ শতাংশ, যা প্রায় ১.৭২ বিলিয়ন ডলার সমমানের, চীনের মালিকানাধীন। উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে ঋণের ভিত্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে চীনের এই পরোক্ষ মালিকানা প্রাপ্তি। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কেনিয়ার মতো দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান ঋণের  বোঝা তাদেরকে আরো নতুন ঋণের জালে আটকে ফেলেছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, কেনিয়ার চীনা ঋণের দিকে তাকালে। ২০১৩ সালে চীনের কাছে কেনিয়ার ঋণ ছিল ১ বিলিয়ন ডলার যা ২০১৭ সাল নাগাদ এসে  দাঁড়ায় ৫.২ বিলিয়ন ডলারে। এধরণের ঘটনার ফলে চীন সম্পর্কে উদ্বেগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়ান নীতিনির্ধারকরা BRI এর অবকাঠামো নির্মাণে অর্থায়নের নাম করে চীন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলে প্রভাব বাড়াচ্ছে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ফলতঃ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনা ‘ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি’ ঠেকাতে অস্ট্রেলিয়া ২ বিলিয়ন ডলারের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য অস্ট্রেলীয় অবকাঠামো অর্থায়ন সুবিধা (AIFFP) নামে BRI এর প্রতিদ্বন্দ্বী একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরী করেছে।

কিন্তু এতো গেল মুদ্রার একপিঠ। চীনের বিরুদ্ধে নব্য উপনিবেশবাদ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব অভিযোগের উল্টোপিঠেও কিছু কথা থেকে যায়। যদিও এসব অভিযোগ সাম্প্রতিক সময়ের চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তথা ট্রাম্প প্রশাসনকেই নৈতিক সুবিধা দেয়। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের কথাই যদি বলি, এটি চীনের ‘ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি’র ক্ষেত্রে বৃহত্তম উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রচলিত ব্যাখ্যাটি হল শ্রীলঙ্কা ঋণ সঙ্কটের মুখোমুখি হবে জেনেও চীন শ্রীলঙ্কাকে এই বন্দর তৈরির জন্য ঋণ দিয়েছে, যাতে করে ঋণ খেলাপি হলে বন্দরটির নিয়ন্ত্রণ চীন নিয়ে নিতে পারে এবং চীনা নৌবাহিনী পরবর্তীতে এই বন্দর ব্যবহার করতে পারে। এই প্রচলিত গল্পটি অনেকাংশেই ভুল।

এই প্রকল্পটির পরিকল্পনা মূলত শ্রীলঙ্কার সাবেক রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপাকসের, চীনের নয়। রাজাপাকসে সরকারের দুর্নীতিগ্রস্থ ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচির একটি অন্যতম নিদর্শন এই বন্দর। ফলে শ্রীলঙ্কার জন্য এই প্রকল্প দ্রুতই অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিলাসিতা হিসেবে দেখা দেয় এবং শ্রীলঙ্কার আর্থিক সঙ্কটকে তীব্রতর করে। শ্রীলঙ্কার ঋণের সঙ্কট এককভাবে চীনা ঋণ থেকে নয়, বরং পশ্চিমা ক্যাপিটাল মার্কেটের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের ফলে উদ্ভূত হয়েছিল। যখন মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ তাদের পরিমাণগত শিথিলতা কর্মসূচী (quantitive easing program) গুটিয়ে আনে তখন হঠাৎ করেই শ্রীলঙ্কার জন্য ঋণ নেওয়া বিষয়ক সামগ্রিক যে ব্যয় তা অনেক বেড়ে যায় তথা ঋণ নেওয়াটাই অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তা নিতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা।

ঋণের বিনিময়ে সম্পদ হস্তান্তরের কোনো চুক্তিও চীন-শ্রীলঙ্কার মধ্যে ছিল না। বরং, কঠোর দর কষাকষির পরে, চীনের একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান (SOE) বন্দরটি ১.১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ইজারা নেয়, এবং শ্রীলঙ্কা সে অর্থ অন্যান্য ঋণদাতাদের ঋণ পরিশোধে এবং নিজেদের বিদেশী রিজার্ভকে বাড়িয়ে তুলতে ব্যবহার করে। আদতে চীনের অপরিশোধিত ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। এছাড়াও চীনের নৌবাহিনী বন্দরটি ব্যবহার করতে পারবে না, বরং শ্রীলঙ্কার নিজস্ব দক্ষিণ নৌ কমান্ড থাকবে এখানে। সংক্ষেপে, হাম্বানটোটা বন্দর চীনা ঋণ কূটনীতির চেয়ে ঋণগ্রহীতা দেশের দুর্বল প্রশাসনের বেশি প্রমাণ দেয়। একারণে মূলত বছরের পর বছর ধরে বাণিজ্য হ্রাসের ফলে উদ্ভূত অপরিশোধিত ঋণ সঙ্কটের দায়ে হাম্বানটোটা বন্দরটি চীনের কাছে ইজারা দেওয়া সত্ত্বেও অনেক পশ্চিমা এবং চীনা সূত্র পরস্পর বিরোধিতা করে আসছে যে এটি আদতে চীনের ঋণ-ফাঁদ কৌশলের অংশ কিনা?

চীনের অর্থায়নে নির্মিত অধিকাংশ অবকাঠামো প্রকল্প, তা সেটা বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন, মহাসড়ক বা রেলপথ যাই হোক না কেন, ঐ দেশগুলোতে পণ্য, যাত্রী ও পরিষেবার অভ্যন্তরীণ বিনিময় সহজতর করেছে। অন্যান্য প্রকল্পগুলো দেশগুলোকে বৈশ্বিক উৎপাদন নেটওয়ার্ক বা আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্পের সাথে যুক্ত করবে। চীন নির্মিত বিমানবন্দর, নৌবন্দর এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর (SEZ) ‘দ্বৈত ব্যবহার’ হয় অর্থাৎ এগুলো ব্যবহার করে শুধু চীনের সাথেই আমদানি-রপ্তানি হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। চীন সংশ্লিষ্ট সরকারকে প্রকল্পের উপযোগিতা নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে লোকসান হয় এমন প্রকল্প গ্রহণ করতে বা ঋণ গ্রহন করতে বাধ্য করছে না। মোটকথা, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে তথাকথিত ‘ঋণের ফাঁদে’ আটকাতে চীন আকর্ষণীয় ঋণের নামে ‘সস্তা আফিম’ বিতরণ করছে না। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক রোডিয়াম গ্রুপের গবেষণা অনুসারে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চীনের বাহ্যিক ঋণ পুনর্বিবেচনার ৪০ টি ঘটনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, চীন খেলাপি দেশগুলোর সম্পদ দখল করেছে বা করতে পারে এটা খুবই বিরল।

আরও পড়তে পারেন-

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেবোরাহ ব্রটিগামের মতে, আফ্রিকার চীনা প্রকল্পগুলোতে এমনকি জাম্বিয়াতেও কর্মসংস্থানের সমীক্ষা ঘেটে দেখা যায় যে তিন চতুর্থাংশ বা তার বেশি শ্রমিক বাস্তবে স্থানীয়। তিনি এবং জনস হপকিনস এবং বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের তার সহকর্মীরা ২০০০ সাল থেকে চীন প্রদত্ত ঋণগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। তাদের মতে আফ্রিকাতে ২০০০ সাল থেকে  ২০১৫ সালের মধ্যে চীন কমপক্ষে ৯৫.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। পরিমাণ বিশাল হলেও দেশগুলোর তথ্যভান্ডার মতে চীনা ঋণগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখছে, বিশেষত আফ্রিকার গুরুতর অবকাঠামোগত পশ্চাৎপদতা কমিয়ে এনেছে। বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে থাকা ৬০ কোটিরও বেশি আফ্রিকানের মহাদেশে, চীনা ঋণের ৪০ শতাংশই বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহে ব্যবহৃত হয়েছে। আরও ৩০ শতাংশ আফ্রিকার ভঙ্গুর পরিবহন অবকাঠামোকে আধুনিকীকরণে ব্যবহৃত হয়েছে। বড় আকারের জমি দখল এবং চীনের জন্য খাদ্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যে চীনা কৃষকদের আফ্রিকায় প্রেরণের কাহিনী আদতে বেশিরভাগই গালগল্প হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালও চীনের সমালোচিত ‘সিল্ক রোড’ ধারণাকে দুর্বল সংজ্ঞায়িত, ভয়াবহভাবে অব্যবস্থাপনার শিকার এবং দৃশ্যমান ব্যর্থতা হিসেবে চিত্রিত করেছে।

চীনা কর্পোরেশনগুলোর বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগগুলোর অনেকগুলোই আমেরিকান এবং অন্যান্য পশ্চিমা কর্পোরেশনের বিরুদ্ধেও আরোপিত হয়েছে। নাইকি, অ্যাপল কিংবা ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সোয়েটশপ (sweatshop) চালানোর অভিযোগ আছে, যেখানে কাজের পরিস্থিতি অনিরাপদ, কর্মচারীদের সামান্য বেতন দেওয়া হয়, এবং শিশুশ্রমিক ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমা সরকারগুলোও প্রত্যাশা করে যে তারা যে ঋণ দেয় সেগুলো যেন তাদের কর্পোরেশনগুলোর পণ্য কিনতেই ব্যবহৃত হবে এবং অন্যান্য শর্তাবলি তো আছেই। এক্ষেত্রে প্রধান পার্থক্য হল চীন থেকে পাওয়া সহায়তা, ঋণ এবং বিনিয়োগের পরিমাণ পশ্চিম থেকে প্রাপ্ত ঋণ কিংবা সহায়তার তুলনায় অনেক বেশি।

এই আলোচনার মূল কথা হচ্ছে, চীনকে বাইনারি ব্যবস্থার মতো করে হয় বন্ধু নয় শত্রু হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না। চীন আফ্রিকা থেকে কাঁচামাল নিয়ে যায়, চীনে সেগুলো পণ্যে রূপান্তরিত হয় এবং পরবর্তীতে আফ্রিকার বাজারে সেসব পণ্য বিক্রি হয়। উপরন্তু, চীনে ভোগ্যপণ্য ও কৃষিপণ্যের রফতানি বিশ্বের সব প্রান্তের দেশগুলোকেই সুবিধা দেয় না কেবল, প্রায়ই এই পণ্যগুলোর জন্য চীনই একমাত্র বাজার। এবং চীনে উচ্চ চাহিদার অর্থ হল, যে উপাদানগুলো আমদানি হচ্ছে সেগুলো পণ্য হিসেবে আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। চীন এই দেশগুলোকে শিল্পায়নে সাহায্য করছে এবং তাদের প্রযুক্তিগত এবং অবকাঠামোগত বিকাশে সহায়তা করছে – এগুলোর সবই চীন এবং সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ, উভয়পক্ষকেই উপকৃত করছে।

দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকার নব্যউপনিবেশিক ক্রিয়াকলাপ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পশ্চিমা রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রভিন্ন ক্রীড়নকদের দায়ী করা হতো। আফ্রিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মতো বৈশিষ্ট্য  নিয়ে নব্যউপনিবেশিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান সম্ভবত খোদ আফ্রিকা মহাদেশের অনেকেই কল্পনাও করতে পারেননি। এদিকে আফ্রিকান অঞ্চলের নেতারা চীনকে বর্তমান চুক্তিগুলোর চেয়ে আরো ভালো চুক্তিতে যেতে চাপ দিতে অনিচ্ছুক। ২০১৮ সালের চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামে (FOCAC), আফ্রিকার নেতারা চীনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন যা জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিপরীতে চীন তাদের জন্য কতটা অনিবার্য হয়ে উঠেছে সেটাই ইঙ্গিত করে। এতে করে এটি স্পষ্ট যে পশ্চিমারা তাদের প্রভাব বলয়ে থাকাকালীন সময়ে আফ্রিকাকে চরমভাবে অবহেলা করেছে এবং বেইজিংয়ের কাছে জায়গা হারিয়েছে। তবে চীনের শীর্ষ কূটনীতিকরা যতই কঠোরভাবে বিষয়টিকে অস্বীকার করুক না কেন চীনকে আলিঙ্গন করে পশ্চিমা নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় থাকা আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য এটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না যে চীনা বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপনিবেশবাদ ফিরে আসেনি।

এ পরিস্থিতিতে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদেরকে বিআরআইকে এককভাবে কূটকৌশল হিসেবে দেখা বন্ধ করতে হবে। পশ্চিমের পক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত চীনা প্রভাব প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হল চীন যে শর্তে বিনিয়োগ করছে তারচেয়েও সহজ শর্তে বিনিয়োগ করা, ঋণ এবং সহায়তা দেওয়া। বিভিন্ন কারণে এটি হচ্ছে না বলেই বহু দেশকে উপলব্ধ শর্তাদি মেনেই চীনা প্রস্তাব গ্রহণ করতে হচ্ছে- নচেৎ সাহায্যহীন থাকতে হচ্ছে। যেহেতু অনেক দেশই চীনা অর্থায়ন পাওয়ার সুযোগ নিতে চাইবে তাই বিআরআইকে প্রত্যাখ্যান করতে ঋণগ্রাহক দেশগুলোকে অনবরত চাপ দেওয়া বরং হিতে বিপরীত হতে পারে পশ্চিমের জন্য। এর পরিবর্তে, পশ্চিমা দেশগুলোকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে অস্ট্রেলিয়ার এআইএফএফপির মতো বিকল্প অর্থায়নের মাধ্যম তৈরি করতে হবে। বিআরআইয়ের প্রকল্পগুলোর ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ ও মেগাপ্রজেক্টগুলোর স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে আরো উন্নতির জন্য ঋণ গ্রাহক দেশগুলো এবং চীন উভয়কেই যথাযথভাবে সংশ্লিষ্ট রাখতে কাজ করতে হবে পশ্চিমা দেশগুলোকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।