Home পরিবার ও সমাজ স্যোশাল মিডিয়া আসক্তি: হুমকির মুখে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন

স্যোশাল মিডিয়া আসক্তি: হুমকির মুখে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন

ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়া এখন আমাদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বেশি দিন আগের কথা নয়, মাত্র দেড় যুগ আগেও দূর দুরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে হলেও মানুষ একে অন্যকে দেখতে আসতো। এতে মেহমান-মেজবান উভয়ের চোখে-মুখে ও মনে এক অন্যরকম আনন্দ ও সুখের হিল্লোল বয়ে যেতো। হৃদয় ও মনের টান মজবুত হতো। আবার কোন অনুষ্ঠানের দাওয়াত পৌঁছাতেও যেতে হতো অনেক পথ পাড়ি দিয়ে। এতে দাওয়াত ও দাওয়াত রক্ষার গুরুত্ব বাড়তো। ফলে পারিবারিক, সামাজিক ও আত্মিয়তার বন্ধন মজবুত হতে সহায়ক হতো। তেমনি দাওয়াত রক্ষার আতিথিয়েতা থেকে গল্প, আড্ডা, খুনসুটি ছিল সামাজিক পরিচিত চিত্র।

আর্থিক সংগতি না থাকলেও আন্তরিক বন্ধন ছিল অটুট। আর এখন একটি ফোন কল বা ম্যাসাঞ্জারের মাধ্যমে এক মুহূর্তেই কাজ শেষ। ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক বা হৃদ্যতা, তা আগের মতো আর থাকছে না। বিয়ে-শাদি বা বিভিন্ন দাওয়াতও এখন মানুষ সামান্য ম্যাসেজের মাধ্যমে বা ফেসবুক টুইটারের মাধ্যমে দিয়ে দিচ্ছে। যে কারণে এসব পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান ও আয়োজনগুলো আগের মতো আবেদন ও সাড়া জাগায় না। দিন দিন এসব পারিবারক ও সামাজিক অনুষ্ঠান নিছক প্রথা পালনে রূপ নিচ্ছে।

একসময় পরিবারের সবাই মিলে এক সঙ্গে বসে প্রাণবন্ত আড্ডা ও গল্পের আসর হতো। আর শিশুরাও এসব বৈঠক ও আসর থেকে অনেক কিছু শিখতো। আনন্দ করতো। বড়-ছোট, বয়স্ক-শিশু-কিশোরদের মাঝে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা ও সামাজিক আচরণ অনুশীলনের সুযোগ তৈরি হতো। অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হতো। স্নেহ-মমতা-ভালবাসা-মানবিক টান বৃদ্ধি পেতো।

আর এখন স্যোশাল মিডিয়ায় যুক্ত হয়ে সবাই নিজেদেরকে এতে ডুবিয়ে রেখেছে। ফলে পারিবারিক বন্ধনও দিনে দিনে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা যে টান, সেটার পরিবর্তে বাড়ছে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি আসক্তি। পরিবারের সদস্যরা একে অপরের শারীরিকভাবে কাছাকাছি অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও মনের দিক থেকে দেখা যাবে নানা জায়গায় নানাজনের সাথে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। চার দেওয়ালের ভেতরে থাকা পরিবারের মানুষগুলোর সম্পর্কও যেন দিনকে দিন যান্ত্রিকতার মতো হয়ে যাচ্ছে। হাই, হ্যালো যেন যাস্ট সৌজন্যতা রক্ষা। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতবিনিময় কমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে বিয়ে ভাঙ্গার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্যোশাল মিডিয়া বা ফেসবুক। দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙ্গার হার আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে।

সমাজ বিজ্ঞানীদের অনেকে এ জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকেই দায়ী করছেন বেশি। এতে পারস্পরিক সম্পর্কে যেমন হৃদত্যতা কমে যাচ্ছে, তেমনি ঘরোয়া সম্পর্ককে যাস্ট প্রয়োজন রক্ষার মতো চরম আত্মকেন্দ্রিকতায় নিয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপরিচিত যে কারো সাথে সহজ যোগাযোগের সুযোগ থাকায় দাম্পত্য সম্পর্কে বাড়ছে সন্দেহ, কমছে শ্রদ্ধাবোধ।

স্যোশাল মিডিয়ার ভয়াবহতা থেকে কীভাবে আমরা বের হয়ে আসতে পারি? এমন প্রশ্নে কোন কোন সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরকে সে আলোকে তৈরি করে নিতে হবে। প্রযুক্তিকে বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু দেখতে হবে আমি সেটাকে কীভাবে ব্যবহার করছি। আমাদের সন্তানদেরকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। স্যোশাল মিডিয়ার প্রভাব অনেক বেশি। এ থেকে নিজেদেরকেই বের হয়ে আসতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে।

অনেকেই বলে থাকেন, এই সঙ্কট কাটাতে হলে ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে উৎখাত বা স্থায়ীভাবে বন্ধের বিকল্প কিছু নেই। কিন্তু আসলেই কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে এখন আর স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব? তবে এর ব্যবহারকে সীমিত করা যায়। এ জন্য নিজেদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। সন্তানদের কাছ থেকে কোনো কিছু লুকাতে চাইলে তারা আরও বেশি পরিমাণে সেদিকে ঝুঁকবে। তাদেরকে ভালো মন্দ, কোনটা সঠিক সে বিষয়ে জ্ঞান দিতে হবে। পারিবারিক বন্ধন ঠিক রাখতে পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করতে হবে। সুতরাং নতুন নতুন প্রযুক্তি আসবে কিন্তু সেটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। সন্তানরা তার অপব্যবহার করছে কিনা, বা প্রযুক্তি ব্যবহারের সময় হওয়ার আগেই তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে কিনা, সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব।

আরও পড়তে পারেন-

তবে এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের মানুষ অনেক বেশি জড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে কিশোর-যুবারা, এমনকি অনেক বয়স্করাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে হারে সময় ব্যয় করেন, উন্নত বিশ্বে এমন লাগামহীন সময় ব্যয় করতে দেখা যায় না। এর মানে আমাদের দেশের নাগরিকদের বড় একটা অংশ ইতিমধ্যেই ইন্টারনেট আসক্তিতে ভূগতে শুরু করেছেন। এতে করে সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। সবকিছু যন্ত্র নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। পারস্পরিক আত্মিক সম্পর্কও নষ্ট হচ্ছে।

এক সময় পারিবারিক বন্ধন, খুনসুটি, পারস্পরিক আন্তরিকতা, আড্ডা ছিল আমাদের সমাজের অন্যতম সংস্কৃতি। আর এখন পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্ক ইন্টারনেট নির্ভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমমুখী হয়ে উঠেছে। আধুনিক হতে গিয়ে সবকিছু যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এদেশে মানুষের আন্তরিকতা বা পারিবারিক বন্ধন নিয়ে যে সুনাম ছিল সেটা এখন অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে।

মানুষের সম্পর্কের যে মধুরতা সেটা নষ্ট করে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। নেশার মতো স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকে সব পেশার মানুষ এখন এ নেশায় আসক্ত। সকাল বিকাল রাত সব সময়ই ফেসবুক, টুইটার, গেমসে আসক্ত হয়ে আছে এক শ্রেনীর মানুষ। দিন দিন আশংকাজনক হারে তরুণ ও শিশুরাও যুক্ত হচ্ছে। এ সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। এর ফলে মানুষ নিমন্ত্রণের কাজও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সারতে চায়।

হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ফেলে দিয়ে জীবন যাপনকে সহজ করার অজুহাত খাড়া করে প্রযুক্তিকে এক শ্রেণীর মানুষ আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে, যা পারিবারিক বন্ধন ও মানুষে মানুষে সম্পর্ককে ধীরে ধীরে নষ্ট করে ফেলবে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এমন আত্মঘাতি পথ থেকে এখনই আমাদের সরে আসতে হবে। নিজেদের সন্তানদের এবং নিজেদেরকেও এ আসক্তি থেকে সরিয়ে রাখতে হবে।

এ জন্য অভিভাবকদেরকে যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সরকারকেও এ বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। অন্যথায় আত্মকেন্দ্রিকতার ভয়াল গ্রাস আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে তছনছ করে দিতে দেরি হবে না।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।