Home ইসলাম সন্ত্রাস দমনে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর তাৎপর্যময় ভূমিকা

সন্ত্রাস দমনে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর তাৎপর্যময় ভূমিকা

।। মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ।।

সন্ত্রাস শব্দটি শুনলেই যেন গা শিউরে উঠে। ইদানিং তার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আগের তুলনায় অভিনব কৌশলে সন্ত্রাস জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে। এমন একটি দিন অতিবাহিত হয়না, যে দিন পত্র-পত্রিকার পাতা খুললে দু’চার পাঁচটি লোমহর্ষক সন্ত্রাসের খবর পত্রিকায় আসে না।

সন্ত্রাস নামক শব্দটি যেন হরদম কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এ কারণেই সম্ভবত সন্ত্রাস শব্দটির কথা শুনলে আগের মত শরীরের লোম শিউরে উঠেনা। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যেন সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বসেছে। সন্ত্রাসীদের হাতে গোটা দেশ হয়ে পড়েছে জিম্মি। তাদের বিপরীতে টু-শব্দ করার ক্ষমতাটিও যেন পাওয়ার লেস হয়ে গেছে।

সন্ত্রাস জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের কাছে এটি ঘৃণিত। প্রত্যেকেই চায় সন্ত্রাস থেকে নিস্কৃতি পেতে, নিরাপদ থাকতে, সন্ত্রাস মুক্ত সমাজ গড়তে, দেশ গড়তে। স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় নির্বাচন এমনিক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, সমিতি-সংঘ, প্রতিটি নির্বাচনেই নেতা-নেত্রীরা কঠোর হস্তে সন্ত্রাস দমন করার প্রতিশ্রুতিও প্রদান করে থাকেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রতিদিন যেন ধ্বনিত হয় সন্ত্রাস বিরোধী শ্লোগান। পত্র-পত্রিকাসহ সকল পর্যায়ের জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করছেন। সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। সন্ত্রাস দমনের নামে আইন পাশ করা হচ্ছে। তবুও, কই সন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে? সন্ত্রাসীরা ভীত হচ্ছে? বরং যতই নিত্য নতুন আইন পাশ করা হচ্ছে, সন্ত্রাসও ততই নিত্য নতুন অভিনব কৌশলে আত্মপ্রকাশ করছে।

বিষধর সাপের ন্যায় ফণা উঁচিয়ে দ্রুতপদে অগ্রসর হচ্ছে অগ্রপানে। সন্ত্রাসের নখর থাবায় সভ্যতার দেওয়াল যেন খসে খসে পড়ছে। চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছে সভ্যতা নামক সৌধের ভিত্তি। যে কোন মুহূর্তে ধ্বসে যেতে পারে, ভেঙ্গে চুরে খান্ খান্ হয়ে যেতে পারে সন্ত্রাসের অপ্রতিরোধ্য বন্যায়। সভ্যতার দাবীদার পাশ্চাত্য সমাজ আজ সন্ত্রাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

সন্ত্রাসের উৎকট গন্ধে মানবতা তথায় ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। সন্ত্রাস থেকে মুক্তিলাভের জন্য মানবতা যেন হন্যে হয়ে ঘুরছে; কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না সন্ত্রাস মুক্ত একটু ঠাঁই।

আরও পড়তে পারেন-

সন্ত্রাস থেকে কি মুক্তি পাওয়া যাবে না? সন্ত্রাস দমনের কি কোন উপায় নেই? নাকি সন্ত্রাসের হাতেই মানব সভ্যতা থাকবে জিম্মি? নিশ্চয়ই সন্ত্রাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। সন্ত্রাস দমনে পরীক্ষিত একটি সমাজ ব্যবস্থা ইতিহাসের পাতায় আজো অম্লান হয়ে আছে; যা অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে তাকালেই দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠে। সেই সমাজে সন্ত্রাস তথা সন্ত্রাস তৈরীর কারখানাগুলো শতঃস্ফূর্তভাবে একটি কালজয়ী আদর্শে মুগ্ধ হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল। অমাবশ্যার কঠিন অন্ধকার রাত্রিতেও কোটি কোটি টাকা পয়সা, সোনাদানা মনি মানিক্য নিয়ে হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করলেও চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক, লুন্ঠন তো দূরে থাক, সামান্যতম ক্ষতির সম্ভাবনাও ছিলনা। উন্নত বক্ষধারিনী ডাগোর ডাগোর চক্ষু বিশিষ্ট ষোড়শী যুবতীও যদি নিঃসঙ্গভাবে পথ চলত, তবুও তার সম্ভ্রম হানীর কোন সম্ভাবনা ছিল না। গোটা সমাজ বনে ছিল রক্ষক। ইতিহাস এ যুগকে সোনালী যুগ নামে অভিহিত করেছে।

অথচ আমরা যদি এই সোনালী যুগের পূর্বের ইতিহাস তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার দিকে তাকাই, তাহলে আমাদের সামনে দর্পণের ন্যায় ভেসে উঠে আরবদের অধঃপতনের করুণ চিত্র। মমত্ববোধটুকুও তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল না। প্রতিনিয়তই তারা লেগে থাকতো খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, লুন্ঠন ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপে। যুদ্ধংদেহী মানসিকতা থেকে একটি মুহূর্তও যেন তারা খালি ছিলনা। কথায় কথায় লেগে যেত যুদ্ধ। একটি মাদী উটকে প্রহার করার ফলে বনু বকর ও বনু তাগলীব গোত্রের মধ্যে সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত যুদ্ধ লেগে ছিল। উটকে পানি পান করানোকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে দুই গোত্রের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ লেগেছিল।

নবুওয়্যাত পেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আল্লাহ পাকের মনোনিত জীবন ব্যবস্থা একমাত্র ইসলামের পতাকাতলে একত্রিত হওয়ার জন্য আরববাসীকে আহ্বান জানালেন, তখনই তাঁর উপর নেমে এসেছিল অমানবীক নির্যাতন। তাঁর সহচরদের প্রতিও নেমে এসেছিল একই নির্যাতন। ইসলামের পতাকাতলে যোগদানের অপরাধে হযরত বেলাল (রাযি.)কে দ্বি প্রহরের উত্তপ্ত মরুভূমির ফুটন্ত বালুর উপর চিত করে শুইয়ে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রাখা হত। বাবলা গাছের কাঁটার উপর শুইয়ে রাখা হত। গলায় রশি লাগিয়ে বালকদের হাতে তুলে দেওয়া হত- কাঁটার উপর দিয়ে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। হযরত আবুযর গিফারী (রাযি.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে গিয়ে ইসলাম কবুল করলেন। অতঃপর তিনি কা’বা শরীফ গিয়ে উচ্চ স্বরে কালিমায়ে শাহাদত পাঠ করলেন।

মক্কার দুর্ধর্ষ কাফিররা তার উপর বাজ পাখির ন্যায় চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে বসল। এতে অবুযর গিফারী (রাযি.) মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছে গেলেন। হযরত আব্বাস (রাযি.) (তখনও তিনি মুসলমান হননি)এর সহায়তায় প্রাণে রক্ষা পেলেন। এরপর দ্বিতীয় দিনে হযরত আবুযর গিফারী (রাযি.) পূর্ব দিনের ন্যায় কা’বা শরীফে গিয়ে সুউচ্চ স্বরে কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করলে প্রথম দিনের ন্যায় আবারও কাফিরগণ তার উপর আক্রমণ করে এবং বেদম প্রহারে তাঁকে রক্তাক্ত করে ফেলে।

হযরত খাব্বাব (রাযি.) প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের কারণে দীর্ঘ দিন যাবৎ তাঁকে নির্মম নির্যাতন ও কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল। লৌহ নির্মিত পোশাক পরিধান করিয়ে তাঁকে উত্তপ্ত রৌদ্রের মধ্যে ফেলে রাখা হত; ফলে প্রচন্ড রৌদ্রতাপে লৌহনির্মিত পোশাক উত্তপ্ত হলে শরীর থেকে ঘর্ম নির্গত হতে থাকতো। অধিকাংশ সময় উত্তপ্ত বালির উপর জ্বলন্ত আঙ্গাঁর রেখে তার উপর তাঁকে শুইয়ে রাখা হত। ফলে তার শরীরে চর্বি ও রক্ত ঝরে সেই আগুন নিভে যেত। এরূপ নির্যাতন ভোগ করা সত্ত্বেও যখন ইসলামের বিজয় হল, তখন তিনি এই বলে কাঁদতেন যে, খোদা নাখাস্তা! আমাদের কষ্টের বদলা না জানি দুনিয়াতেই মিলে গেল।

কুরাইশগণ হযরত খুবাইব (রাযি.)কে বন্দী করে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে দীর্ঘদিন কারাভোগের মাধ্যমে অসহনীয় নির্যাতন করা হল। অতঃপর তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হল। হযরত খুবাইব (রাযি.)কে শূলে চড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশজন কাফির চতুর্দিক হতে বর্শাদ্বারা তাঁকে হামলা করল এবং তাঁর দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল। এছাড়াও অন্যান্য সাহাবীদের উপরও চলছিল অমানবিক নির্যাতন। এক কথায় যারাই ইসলাম কবুল করেছিল তারাই কুরাইশদের নখর থাবার শিকার হয়েছিল।

এমনি একটি বর্বর উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসী জাতি সোনার মানুষে পরিণত হলো কোন আদর্শ পেয়ে? এর জবাবে নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে বলা যায়, মানবতার মুক্তির দূত, মযলুমের অতন্দ্র কান্ডারী, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কালজয়ী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে। তাঁর আবির্ভাবই ছিল যুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন-সন্ত্রাসী কার্মকান্ড তথা অনৈতিকতার বিরুদ্ধে বিজয় বার্তা স্বরূপ। তিনি নিজেই বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমি প্রেরিত হয়েছি চারিত্রিক উৎকর্ষতার পরিপূর্ণতা সাধনের জন্য।” কুরআনে এ কথারই সাক্ষ্য প্রদান করে বলা হয়েছে, “তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলের চরিত্রের উত্তম আদর্শ।”

বাস্তবিক পক্ষে তিনি সক্ষমও হয়েছিলেন তাঁর উত্তম চারিত্রিক গুণে একটা অসভ্য বর্বর উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসী জাতিকে সভ্য ও উন্নত জাতিতে রূপান্তরিত করতে।

পবিত্র কা’বা ঘরের ঐতিহাসিক কালো পাথরটি যথাস্থানে স্থাপনকে কেন্দ্র করে গোত্রে গোত্রে যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সুত্রপাত হয়েছিল, রহমতের নবী করুণার ছবি হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সন্ধিক্ষণে তাঁর বিজ্ঞোচিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে উদ্ভূত ভয়াবহ পরিস্থিতির যে সুন্দর ও সর্বকালে সর্বযুগের মানুষের কাছে গ্রহণীয় সমাধান দিয়েছিলেন তা আজো অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়।

যারা উটের পানি পান করার মত একটা মামুলি বিষয়কে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তাঁরাই হুনাইনের যুদ্ধে কঠিন পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত মুহূর্তেও নিজে পানি পান না করে অপর মুসলিম সহযোদ্ধা ভাইকে পানি পান করার সুযোগ করে দিয়ে মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করে ত্যাগের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। যা আজো ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন ১৫ বছর, তখন আরবের কুরাইশ ও হাওয়াযেন গোত্রদ্বয়ের মধ্যে লেগেছিল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে কত লোক যে প্রাণ হারিয়েছে, কত নারী যে বিধবা হয়েছে, কত মা যে সন্তান হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এযুদ্ধের ভয়াবহতা লক্ষ্য করে তিনি মক্কার কিছু দূরন্ত ও দুঃসাহসী যুবককে সাথে নিয়ে সন্ত্রাস নির্মূলের জন্য “হিলফুল ফুযল” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যা ছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি অপ্রতিরোধ্য অন্দোলন। এ সংগঠনের উদ্দেশ্যাবলী ছিল নিম্নরূপ-

১। আমরা অসহায় নিঃস্ব ও দুর্গতদের সেবা করব।

২। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে অত্যাচারীকে বাধা প্রদান এবং উৎপীড়িতকে সাহায্য করব।

৩। আমরা দেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করব, যাতে কোন ব্যক্তি বা গোত্র শান্তি ভাঙ্গার কারণ ঘটাতে না পারে, তৎ প্রতি সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখব।

৪। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করার জন্য আমরা সর্বদা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাব। সেই কিশোর বয়সের পদক্ষেপ সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা দূরীকরণে নজিরবিহীন অকল্পনীয় ভূমিকা রেখেছিল বলে আজো তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। [আগামী কিস্তিতে সমাপ্য ]

– মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, প্রিন্সিপাল- জামিয়া ইসলামিয়া ইমদাদুল উলূম নলজুরী, গোয়াইনঘাট, সিলেট, চেয়ারম্যান – জাফলং ভিউ রেষ্টুরেন্ট, প্রোপাইটার- আব্দুল মজিদ এন্ড সন্স, সভাপতি- বৃহত্তর জাফলং পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতি।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।