Home ইসলাম ‘মৃত্যুর ডাক যেকোন মুহূর্তে আসতে পারে, তাই এখনই তাক্বওয়ার জিন্দেগী অবলম্বন করতে...

‘মৃত্যুর ডাক যেকোন মুহূর্তে আসতে পারে, তাই এখনই তাক্বওয়ার জিন্দেগী অবলম্বন করতে হবে’

[রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’র ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতীব আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান আজ (১৫ জানুয়ারী) শুক্রবার জুমায় খুতবার পূর্বে মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছেন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানের হুবহু অনুলিপি উম্মাহ পাঠক সমীপে উপস্থাপন করা হল -সম্পাদক]


হামদ-সালাতের পর আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান বয়ানে বলেন- 

بعد التحميد والتسليم۔ فبأي آلآئ ربكما تكذبان…

“আল্লাহ তায়ালা আমাদের অনেক নেয়ামত দান করেছেন। দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন উপায় উপকরণ অবলম্বন করার তাওফীক দিয়েছেন। প্রয়োজন মাফিক কোনটা অধিক আর কোনটা কম।

আমাদের দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হলে খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পানীয় গ্রহণ, বাতাস থেকে অক্সিজেন প্রয়োজন। অধিক ব্যবহারের জন্য মানুষ পানির অপর নাম রেখেছে জীবন। আমরা বস্ত্র একটা লম্বা সময় ব্যবহার না করলে আমাদের জীবন যাত্রায় তেমন পরিবর্তন ঘটে না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অনাহারে থাকলে কোন সমস্যা হয় না। যে পানির অপর নাম জীবন রাখা হয়েছে সে পানি সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গ্রহণ না করলেও বেঁচে থাকা সম্ভব। কিন্তু অক্সিজেন বা শ্বাসপ্রশ্বাস যদি এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, তবে কি বেঁচে থাকা সম্ভব? যদি আধা মিনিটের জন্যও আপনাকে এমন কোন স্থানে আটকে রাখা হয়, যেখানে বায়ু প্রবাহ নেই, যেখানে এয়ার সার্কুলেশন নেই, সেখান থেকে বেঁচে ফেরাটা সম্ভব না। সুতরাং মানুষের জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজন পানির চেয়ে বেশি।

বাতাসের অপর নাম জীবন না, বরং বাতাসই জীবন। এতো এতো মূল্যবান নেয়ামত আল্লাহ তায়ালা আমাকে/আপনাকে দিয়ে রেখেছেন বিনামূল্যে। আমি ঘুমিয়ে থাকি আমার শ্বাস-প্রশ্বাস চলমান। আমি অচেতন, আমার ব্লাড সার্কুলেশন সচেতন। আল্লাহ তায়ালা তার এই সমস্ত অমূল্য নেয়ামতরাজী সকলকে শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ, মুসলিম-অমুসলিম সকলকে সমানভাবে দিয়ে রেখেছেন তার একটি মাত্র সিফাত “রাহমানের” ঊসিলায়।

দুনিয়ার উপায় উপকরণের নেয়ামত আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন, তা ব্যবহার করে আমাদের আখিরাত বানানোর জন্য। তাকে মুহাব্বত করার জন্য নয়। দুনিয়ায় বেঁচে থাকাটা পানিতে নৌকা চলার মত। পানি ছাড়া যেমন নৌকা চলতে পারে না, আবার নৌকায় পানি উঠলে তা ডুবে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। তেমনই দুনিয়া ছাড়া এর উপায় উপকরণ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। তবে যদি তাতে ডুবে যায় তবে তার বিভ্রান্ত হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ তায়ালা যেমন বলেছেন-

وإذا نودي للصلاة من يوم الجمعة فاسعو إلى ذكر الله وذرو البيع

অর্থাৎ- “যখন তোমাদের নামাজের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা বেচাকেনা ছেড়ে দিয়ে নামাজের দিকে আসো।”

তেমনই বলেছেন-

فاذا قضية الصلاة فانتشروا في الأرض وابتغوا من فضل الله

অর্থাৎ- “যখন তোমাদের নামাজ শেষ হয় তখন তোমরা জমীনে ছড়িয়ে পড়ো আল্লাহপ্রদত্ত রিজিক সন্ধানে।”

রিজিক অন্বেষণ করা, বেঁচে থাকার উপায় অবলম্বন করাটা সুন্নাতে ইলাহী। তবে এতে ডুবে যাওয়া নিষেধ।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন কোন বিনিময় ছাড়াই। অত:পর আমাদের চোখ দিয়েছেন। সেই চোখ প্রয়োজনে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে ঘুরানোর জন্য ফ্রিলি মুভমেন্টের জন্য লাগিয়ে দিয়েছেন অদৃশ্য বেয়ারিং। লাইফ টাইম গ্যারান্টি। শ্রবণের প্রয়োজনে কান দিলেন। কথা বলার প্রয়োজনে মুখ দিলেন। আর মনের ভাব চেহারায় প্রকাশ করার জন্য দিলেন ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা। আলোর প্রয়োজনে সৃষ্টি করলেন সূর্য, স্নিগ্ধতার প্রয়োজনে দান সৃষ্টি করলেন চন্দ্র। দিন রাতের মাঝে তফাত সৃষ্টি করলেন। আলোর প্রয়োজনে আলো দিলেন। আঁধারের প্রয়োজনে আঁধার সৃষ্টি করলেন। আঁধারের প্রয়োজন না হলে মানুষ ঘুমাতে যাওয়ার আাগে লাইট অফ করতো না। সুতরাং মানুষের আঁধারেরও প্রয়োজন আছে। আল্লাহ তায়ালা এতো এতো নেয়ামত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দান করার পর ঘোষণা করেন-

فبأي آلآئ ربكما تكذبان “তোমরা আল্লাহর কোন কোন নিদর্শন অস্বীকার করবে।” যে আল্লাহ আমাদের প্রয়োজনার্থে এতো এতো নেয়ামত দান করলেন, আমরা সেই আল্লাহকে ভুলে সেই আল্লাহর দিকে ধাবিত না হয়ে এই তুচ্ছ দুনিয়ার পেছনে দৌড়াই। ফলশ্রুতিতে আমাদের জীবনতরী দুনিয়া নামক সাগরে ডুবতে থাকে। টাকার দরকার! কেমনে আসবে হালাল না হারাম তা দেখার দরকার নেই। চুরি করবো নাকি ডাকাতি করবো তা ভাবার সময় নাই। অন্যের মাল মেরে হোক, অন্যকে মেরে হোক, চাঁদাবাজী করে হোক, টেণ্ডারবাজী করে হোক, দূর্নীতি করে হোক, এতোকিছু ভাবার সময় আমার নেই। আমার শুধু টাকার দরকার। বাড়ি করবো জায়গা দরকার, শপিং মল করবো জায়গা দরকার, নিজেরটা নাই তো কি হয়েছে? অন্যেরটা মেরে হোক, আমার দরকার শুধু জায়গা!

আরও পড়তে পারেন-

এভাবেই আমরা আস্তে আস্তে দুনিয়া নামক সাগরের অতল গহ্বরে ডুবে যাই। আল্লাহ বলেন-
فأما من طغى، وآثر الحياة الدنيا، فإن الجحيم هي المئوى

অর্থাৎ- “যে সীমালঙ্ঘন করলো, দুনিয়ার জিন্দেগীকে প্রাধান্য দিলো, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।”

ক্ষমতাও আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক নেয়ামত। এটাও আমাদের কাছে আমানত স্বরূপ। ক্ষমতার চেয়ারে বসে জোর গলায় কথা বললেই স্কলার হয়ে যায় না। ক্ষমতার চেয়ার থেকে গায়ের জোরে ফরমান জারী করলেই সেটা কুরআন-হাদীস হয়ে যায় না। বর্তমান ক্ষমতাধররা তো ক্ষমতার চেয়ার থেকে ইচ্ছেমত ফরমান জারী করে কুরআন-হাদীসকে বদলে দেয়ার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বিশ্বাসীরা তা না মানলে আবার রাষ্ট্রদ্রোহীর ট্যাগ পর্যন্ত লাগিয়ে দিচ্ছে। ক্ষমতার চেয়ারে বসে এমন কথা বলছে, যেন হাসান বসরী / বায়েজীদ বোস্তামী (রাহ.) বাংলার মাটিতে নেমে এসেছেন।

اگر صورة آدمى انساں بودے ٭ تو ابو جهل و احمد همساتھ بودے

অর্থাৎ- “মানুষ যদি কেবল আকৃতিতেই মানুষ হতো, তো আবু জেহেল আর আহমাদ (সা.) আকৃতিতে এক রকমই ছিলো।”

কিন্তু আবু জাহেলের ব্যপারে কত কঠিন কথা হাদীসে পাকে এসেছে যে-

هو فرعون لهذه الأمة، (أو كما قال ﷺ)

“সে (আবু জাহেল) হল এই উম্মাতের ফেরআউন।” ফেরআউনও মৃত্যুর সময় বাঁচার জন্য ঈমান এনেছিলো। পক্ষান্তরে আবু জাহেল যখন যুদ্ধক্ষেত্রে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে আছে, তখন আনসারী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাযি.) তার বুকের উপর গিয়ে বসেন। “আবু জাহেল তার দিকে তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে- আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ! তোর কতবড় সাহস! ফকিরের বেটা হয়ে আমার বুকে বসছোস! কি করবি? সাহাবী বলেন- তোর মাথাটা কেটে নিয়ে আমার নবীর পদতলে সোপর্দ করবো। আবু জাহেল বলে- মাথাটা কাটার সময় একটু ঘাড়ের নিচের থেকে কাটিস! যেনো দেখতে বড় দেখা যায়।” কতবড় স্পর্ধা! মৃত্যু সামনে উপস্থিত, কিন্তু তার দম্ভ এতটুকুও কমেনি। ফেরআউনের চেয়ে আরো ভয়ংকর।

বর্তমান ক্ষমতাধররা ক্ষমতার চেয়ারে বসে দম্ভ দেখায়। তারা গায়ের জোরে কুরআন-হাদীসের বিধান চেঞ্জ করে দিতে চায়। ফেরআউন যুগে যুগে আসে। ক্ষমতার দম্ভে আল্লাহর জমীনে আল্লাহর বিধানকে রহিত করে দিতে চায়। মনে রাখবেন, যেই জমিনের উপরে আপনি হুকুমত চালাচ্ছেন সে জমিনের নিচেও আরেকটা হুকুমত আছে। সেখানে কোন চেয়ার নেই, সেখানে মাখলুকের কোন হুকুমত চলে না, সেখানে হুকুমত চলে কেবল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার। আমার আপনার সবাইকেই একদিন সেখানে চলে যেতে হবে। যে চেয়ার রক্ষার জন্য এতোকিছু করছেন, সেই চেয়ার থাকবে আপনি থাকবেন না। যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য রবের না-ফরমানী করতে দ্বিধা করছেন না সেই ক্ষমতা ঠিকই থাকবে আপনি থাকবেন না। যাদের সন্তুষ্টি অর্জনার্থে এতো দম্ভোক্তি সেই কবর জগতে তাদের সন্তুষ্টি বিন্দুমাত্র কাজে আসবে না। এই আয়াত স্মরণ করুন-

فأما من طغى، وآثر الحياة الدنيا، فإن الجحيم هي المئوى

বর্তমানে আমরা একেবারে মুমূর্ষ না হলে আখেরাতের কথা মনেই করি না। পুত্র যখন দেখে যে, বাবার অবস্থা খারাপ তখন দৌঁড়ে মসজিদের হুজুরকে এসে বলে যে, ‘হুজুর! আব্বার অবস্থা খারাপ, তাড়াতাড়ি তওবা পড়িয়ে দেন’। অথবা পিতা নিজেই অস্ফুট কণ্ঠে বলে ‘হুজুরকে নিয়ে এসো, তওবাটা করে ফেলি’। কারণ, তখন মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়, মালাকুল মাউত হযরত আজরাঈল (আ.) তার ষোল কোটি দাঁত বের করে সামনে উপস্থিত হন। জাহান্নামের ভয়াবহতা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কিন্তু তখন তো তওবা কবুল হয় না। কারণ, না দেখে অদৃশ্যকে বিশ্বাস করার নাম ঈমান। দৃশ্যমান এর উপর ঈমান আনাকে ঈমান বলে না। إيمان بالغيب গ্রহণযোগ্য, إيمان بالشهادة গ্রহণযোগ্য নয়।

মৃত্যুর সময় তো ফেরআউনও ঈমান এনেছিলো। মূসা (আ.)এর পশ্চাদ্ধাবন করে নীল নদে ডুবে মরার সময় অবস্থা বেগতিক দেখে সেও বলেছিলো-
آمنت برب موسى وهارون “আমি মূসা এবং হারূনের (আ.) রবের উপর ঈমান আনলাম”। কিন্তু তার ঈমান গ্রহণযোগ্য হয়নি! প্রতি উত্তরে আল্লাহ বলেছিলেন- آلأن! وقد عصيت قبل وكنت من المفسدين “এখন? অথচ একটু আগেই না না-ফরমানী করলে? তুমি তো ফাসাদকারী ছিলে।”

তো আমাদের কি করতে হবে? আমাদের তাক্বওয়ার জিন্দেগী অবলম্বন করতে হবে। তাকওয়া কি? খুবই সহজ একটা বিষয়-

من خاف مقام ربه ونهى النفس عن الهوى، فإن الجنة هي المئوى

অর্থাৎ- “যে আল্লাহর সত্ত্বাকে ভয় করে নফসকে খাহেশাত থেকে মুক্ত রাখবে, তার ঠিকানা হবে চির শান্তির জান্নাত।”

যখন আমরা আল্লাহকে ভয় করবো, তাঁর কুদরতের উপর ঈমান আনবো, তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলবো এবং নিজেকে এক আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দিবো তখন আল্লাহও আমাদের হয়ে যাবেন। আমাদের চোখ সমূহ আল্লাহর কুদরতি চোখে রূপান্তর হবে। আমাদের কান সমূহ আল্লাহর কুদরতি কানে রূপান্তর হবে, আমাদের যবান আল্লাহর কুদরতি যবানে রূপান্তর হবে। অর্থাৎ আমাদের দ্বারা আর কোন গুনাহ হওয়ার আশংকা থাকবে না।”

– আল্লামা হাফেয নাজমুল হাসান, পরিচালক- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা, সাংগঠনিক সম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- উত্তরা রওজাতুস সালিহাত মহিলা মাদ্রাসা, খতীব-  উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদ এবং উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডট কম।

অনুলিখনে- মাহমূদ হাসান নাহিয়ান

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।