Home ইতিহাস ও জীবনী জ্যোতির্ময় আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.)

জ্যোতির্ময় আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.)

।। ফয়সল আহমদ জালালী ।।

জ্যোতির্ময় আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.) মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন পরপারে। ২০২০ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে। তিনি ছিলেন সব অঙ্গনের উলামায়ে কিরামের পৃষ্ঠপোষক। তালিবুল ইলমদের একজন দরদী অভিভাবক । সর্ব স্তরের আলেমদের অন্যতম মুরববী । ইসলামী রাজনীতির মাঠে ছিলেন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী । ইসলাম ও মুসলিমের যে কোন প্রয়োজনে ছিলেন সব সময় সোচ্চার।

তাঁর তাকওয়া-পরহেজগারী ছিল প্রশ্নাতীত। ছিলেন তাওয়াক্কুল-আল্লাহর উপর ভরসা রাখার এক উজ্জ্বল নমুনা। বিনয় ছিল যার জীবনের ভূষণ। কর্মহীন ও আশ্রয়হীন আলেমদের ছিলেন আশ্রয় দাতা। ছিলেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কিরামের মধ্যমণি। কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড-বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’র সিনিয়র সহ সভাপতি, আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’র কো-চেয়ারম্যান, ঐতিহ্যবাহী জামেয়া মাদানিয়া বারিধারা’র প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল, রাজনীতিতে ছিলেন প্রাচীন রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’র মহাসচিব এবং ইসলামী স্বার্থ সংরক্ষণ মূলক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম’র মহাসচিব। সর্বোপরি ছিলেন মুসলিম উম্মাহর এক হুশিয়ার কাণ্ডারি । আরবীতে এধরনের ব্যক্তিত্বকে বলে ‘মাজমা’উল কামালাত’-পরিপূর্ণতা গুণের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব।

শিক্ষা জীবন

আল্লামা নূর হুসাইন ১৯৪৫ সালের ১০ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ উপজেলাধীন চড্ডা নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল ওয়াদুদ। বাড়ির পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়। এখানে চতুর্থ শ্রেনী শেষ করে চড্ডার কাশিপুর কাশেমুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর ভর্তি হন বরুড়া উপজেলাস্থ আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসায়। এখানে হিদায়া জামাত পর্যন্ত তিনি অধ্যয়ন করেন।

দারুল উলূম দেওবন্দে

বিশ্ব বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দে লেখা-পড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন নূর হুসাইন। নির্ধারিত সময়ে দারুল উলূমে পৌঁছাতে না পেরে ভর্তি হন ভারতের সাহারানপুর জেলার বেড়ীতাজপুর মাদ্রাসায়। এখানে জামাতে জালালাইন সমাপ্তির পর দারুল উলুম দেওবন্দে চলে যান। এবার ভর্তি হওয়ার সুযোগ লাভ করেন দারুল উলূমে। এখানে তাঁর অধ্যয়নকাল ছিল মোট ৩ বছর । তিনি দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) সমাপ্তির পর আরবি সাহিত্য ও দর্শনে উচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন।

তাঁর খ্যাতিমান শিক্ষকগণের অন্যতম ছিলেন ফকীহুল মিল্লাত মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী, আনজার শাহ কাশ্মীরি, ফখরুদ্দীন আহমদ মুরাদাবাদী, মুহাম্মদ সালেম কাসেমী প্রমুখ।

কর্ম জীবন

ভারতের মুজাফরর নগর জেলা থেকেই আল্লামা কাসেমীর শিক্ষাদান কাজ শুরু হয় । আর তা ছিল কাসিম নানুতুবি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মুরাদিয়া মাদ্রাসা থেকে । এই শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা । এখানে ১ বছর অধ্যাপনার পর ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। মাতৃভূমিতে ফিরে এসে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার নন্দনসার মুহিউস সুন্নাহ মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস ও মুহতামিম পদে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি জামেয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় চলে আসেন । এখানে তিনি ৪ বছর অধ্যাপনা করেন, একই সাথে ছাত্রাবাসের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন।

১৯৮২ সালে তিনি জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে চলে আসেন। এখানে তাঁর অধ্যাপনাকাল ছিল মোট ৬ বছর। ১৯৮৮ সালে ঢাকার কূটনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিত গুলশানের বারিধারায় জামিয়া মাদানিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগে জামেয়া মাদানিয়া কিছু দিনের জন্য তাঁর হাত ছাড়া হয়ে যায়। এর সুফলে ১৯৯৮ সালে ঢাকার উত্তরাস্থ ধউর নামক স্থানকে মাহমূদ নগর নাম দিয়ে সেখানে জামিয়া সুবহানিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এদু’টি প্রতিষ্ঠানের শায়খুল হাদীস ও মহাপরিচালক ছিলেন। এছাড়াও তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৪৫টি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তিনি অভিভাবক/পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

আরও পড়তে পারেন-

শুনেছি ,আল্লামা কাসেমী (রাহ.) বছর কয়েক আগে বলে গিয়েছেন, ইন্তেকালের পরে ও নিজের সন্তানকে তাঁর পরিচালনাধীন জামেয়া মাদানিয়া বারিধারায় উস্তাদ/ মুহতামিম/কিংবা কোনও কমিটিতে যেন রাখা না হয়। মাদ্রাসা,খানকা ও বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠানে গদ্দিনিশীন করার প্রতিযোগিতার এই যুগে এই ওসিয়তকে কে কীভাবে নিবেন জানি না। আমি মনে করি এটি কোন ব্যক্তির উচ্চাঙ্গের বুজুর্গ হওয়ার বাস্তব সাক্ষ্য । আল্লামা কাসেমী রাহ. ছিলেন নি:সন্দেহে বড় মাপের বুজুর্গ, ইসলামী আন্দোলনের মহান মুখলিস নেতা হিসেবে মুসলিম জনসাধারণের মাঝে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল। এছাড়াও তিনি প্রায় ৪৫টি মাদ্রাসা পরিচালনার কাজে যুক্ত ছিলেন।

সংক্ষিপ্ত পারিবারিক পরিচিত

পারিবারিক জীবনে তিনি ২ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক । বড় ছেলের নাম যুবায়র হুসাইন ও ছোট ছেলের নাম জাবির কাসেমী। তাঁর ছোট ছেলে জাবির কাসেমী একজন যোগ্য আলেম ও জামিয়া মাহমুদিয়া ইসহাকিয়া মাদ্রাসা, মানিকনগরের শিক্ষক ।

ছাত্রদের সাথে পিতা-পুত্রের আচরণ

ছাত্রকালে শিক্ষার্থীরা চায় শিক্ষকদের উষ্ণ সান্নিধ্য। শাসনের সাথে চায় শিক্ষাগুরুর প্রীতি ও ভালবাসা। কোন শিক্ষক রূঢ় আচরণ করলে ও মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না তাদের। তবে সবার সব আচরণ মনে রাখে তারা। আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী এমন এক উস্তাদ ছিলেন যিনি ছাত্রদেরকে পিতৃস্নেহ দিয়ে লালন করতেন। তালিবুল ইলমরা ও তাঁকে পিতৃতুল্য মনে করত। কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় ছাত্ররদেরকে তিনি ‘বাজি’-বাবা বলে সম্বোধন করতেন। ছাত্ররা ও সম্মান করে তাঁকে ‘বাজি’-বাবার মত সম্মান করত। শুধু ছাত্রকালেই তা সীমিত নয় আলিম হয়ে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার পর ও তাদের শ্রদ্ধাবোধ অব্যাহত থাকত।

ছাত্রদের কর্মজীবনের প্রতি ও নজর

শায়খুল হাদীস নূর হুসাইন এমন এক দরদী অভিভাবক ছিলেন যার অভিভাবকত্ব ছাত্রদের কর্মজীবন পর্যন্ত অব্যাহত থাকত। এমনকি ছাত্রদের বিয়ে-শাদীর প্রতি ও খেয়াল রাখতেন। পড়ন্ত বয়সে ছাত্রদের সন্তানদের বিয়েতে উপস্থিত হয়ে তদারকি ও বিয়ের খুৎবা দিতে ও তাঁকে দেখা যেত। তাঁর অনেক ছাত্র আছেন যারা আলিম হয়ে বিশাল বিশাল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। কেউ হয়েছেন মুহাদ্দিস, মুফাসসির কিংবা ওয়াজের মঞ্চের খ্যাতিমান বক্তা। কেউ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন লেখক-গবেষক হিসেবে কেউবা রাজপথ কাঁপানো রাজনীতির নেতা হয়ে। পিতা হয়ে শশুড় হওয়ার অপেক্ষমান বয়সে পৌঁছে ও ছাত্ররা তাঁকে ভুলত না। শুধু ‘ভুলত না’ শব্দ এখানে মানানসই নয়, সব ছাত্ররা তো উস্তাদকে সারা জীবনই মনে রাখে। আমি সেই মনে রাখার কথা বলছি না। আমি বলছি তাঁর এই বয়সের ছাত্ররা তাদের সন্তানদের বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তাঁর মতামতকে শিরোধার্য মনে করতেন। ছাত্রদের এমন উস্তাদ বাবা হিসেবে বিবেচিত হতেন মরহুম কাসেমী।

সাদামাটা এক মনীষী

একদা জামেয়া মাদানিয়া বারিধারায় দুপুরের সময় অফিস কক্ষে উপস্থিত ছিলাম আমি। কওমী মাদ্রাসাগুলোতে সাধারণত নিচে বসেই অফিস করা হয়। তবে মুহতামিম মহোদয়ের বিছানা থাকে কিছুটা শান শওকতের। তাঁর সামনে থাকে সাজানো গোছানো কোন টেবিল বা বাক্স। কাসিমী সাহেব এমন এক প্রিন্সিপাল ছিলেন সাজানো গোছানো কেন তাঁর সামনে কোন সাধারণ টেবিল ও দেখা গেল না। সবার সাথে সমান তালে বসে মাদ্রাসার খবর নিচ্ছেন।

বিভিন্ন দায়িত্বশীলগণ এসে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন। তিনি ও সাধারণ ভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এটি এভাবে কেন, সেটি সেভাবে হলনা কেন, এসব কৈফিয়ত কার কাছ থেকে নিতে দেখা গেল না। খাবার হাজির হল, সেখানেই দস্তারখানা বিছিয়ে উপস্থিত সবাইকে নিয়ে খেতে বসে গেলেন। উপস্থিতির তুলনায় খাবারের পরিমাণ বেশি ছিল না। তবুও না খেয়ে কেউ থাকতে পারেননি। বোর্ডিং বা এখান থেকে সেখান থেকে খাবার নিয়ে আস, এমন কথা ও কাউকে বলেননি।

ঐক্যের মধ্যমণি

উলামায়ে কিরামের মাঝে বিভিন্ন ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক বিষয়। মাওলানা কাসিমীর মেজাজ ছিল মধ্যপন্থার। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে আপোসহীন হয়ে ও পরমতকে সম্মান করার এক আদর্শ মানব ছিলেন তিনি। তিনি তাঁর পসন্দের জামা ও টুপিতে ছিলেন অবিচল। সারাজীবন পোষণ করতেন নিজস্ব নজরিয়া। ভিন্ন লেবাস ও ভিন্ন নজরিয়াকে ঘৃণা করে কথা বলতে শুনিনি কখনো। সব মত ও পথের মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। পাশে বসে আলাপ চারিতায় সংকোচ বোধ করতেন না।

হেফাজতের সেকেণ্ড ইন কমান্ড নির্বাচিত হওয়ার পর সব তবকার উলামায়ে কিরামের মধ্যমণি হয়ে উঠেন তিনি। হয়ত আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে উলামায়ে কিরামের ঐক্য আরও সুদৃঢ় হত । মহান আল্লাহর অমোঘ বিধানের অধীনে আমরা সবাই। “আনতা তুরীদ আনা উরীদ ফা’আআলুল লিমা য়ুরীদ”-তুমি চাও, আমি চাই । আল্লাহ যা চান তাই হয়।

রাজনীতিবিদ কাসিমী

একজন জাতীয় রাজনীতিবিদ ছিলেন মাওলানা নূর হুসাইন কাসিমী। উপমহাদেশের প্রাচীন ইসলামী রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে আজীবন ছিলেন তিনি। দল ত্যাগ, নতুন দল গঠন, দল পরিবর্তন ও দল ভাঙ্গা গড়ার রাজনীতির সাথে তিনি কস্মিনকালেও জড়িত হননি। জীবনের প্রথম দিকে নীরবে রাজনীতি করতেন । শেষ জীবনে ছিলেন রাজনীতিতে সরব। নির্বাচিত হন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব। জোটগত রাজনীতির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ছিলেন অন্যতম। ২০ দলীয় ঐক্য জোটে ছিল তাঁর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশে। দলটির মহাসচিব হিসেবে জোটে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষে তিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন।

জোটের শীর্ষ নেতাদের সাথে নিয়মিত বৈঠকে দলের কার্যনির্বাহী হিসেবে তিনিই অংশ গ্রহণ করতেন। সেখানেও তিনি তাঁর চিরাচরিত রুমাল ও লাঠি নিয়ে উপস্থিত হতেন। যেখানেই যেতেন তিনি তাঁর স্বকীয়তা বিসর্জন দিতেন না। ১৯৭৫ সালে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।

উচ্চ ফোরামের নেতৃত্ব

১৯৯০ সাল থেকে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন । ৭ নভেম্বর ২০১৫ সালে তিনি প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলের মহাসচিব নির্বাচিত হন।

২০২০ সালের ৩ অক্টোবর তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। আইন অনুসারে একই সাথে তিনি আল-হাইআতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়া’র সহ-সভাপতি ছিলেন।

২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এর পূর্বে তিনি হেফাজতের ঢাকা জেলার সভাপতি ছিলেন। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের ১৩ দফা দাবি আদায়ে ঢাকা অবরোধে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন।

তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি

পীরে কামিল মাওলানা নূর হুসাইন কাসিমী ছিলেন আত্মশুদ্ধির নীরব এক সাধক। তাযকিয়া ও ইহসানের বাস্তব এক নমুনা রেখে গেছেন তিনি তাঁর উত্তরসূরিদের জন্য। তাঁর তাসাওউফ সাধনায় ছিল না কোন লৌকিকতা। পীর মুরীদীর নামে তিনি কোন আস্তানা আর খানকাহ গড়ে তুলেননি। মুরীদ আর খলীফা বৃদ্ধির কোন কসরত করেননি।

ইসলাহী মাহফিল আর জোড় ইত্যাদির নামে পাবলিকের সমাগম আহ্বান করেননি। তাঁর যেই পরিমাণ ভক্ত আর অনুরক্ত ছিল, আহ্বান করলে বছরে দু’য়েকবার হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটাতে পারতেন। চাইলে হাজার কতক খলীফা বা মাজায রেখে যেতে পারতেন। জানা গেছে তাঁর খিলাফত লাভে ধন্য হয়েছেন মাত্র তিন জন। মাওলানা কাসিমীর আত্মশুদ্ধি ছিল দুনিয়ার মোহ বর্জনের, মহান আল্লাহর উপর সর্বাত্মক ভরসা রাখার, লোক দেখানো ও শোনানোর কাজ থেকে দূরে থাকার, আত্মম্ভরিতা পরিহার করার, একান্তে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ও সর্বোপরি মহানবী সা,এর অনুকরণে আল্লাহর গোলামী ও জীবন যাপনের ।

দুনিয়া ত্যাগী মহান এই সাধক রেখে গেছেন কোটি কোটি টাকা মূল্যের বহু দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। রেখে যাননি নিজের কোন প্লট, ফ্ল্যাট বা মাথা গোঁজার সাধারণ বাড়ি। বিশাল বিশাল ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে গেছেন । এগুলোতে নিজের ছেলে, জামাই বা নিকটাত্মীয় কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যাননি। এমনকি শিক্ষক হিসেবে ও তাদেরকে নিয়োগ করেননি। শুনেছি ইনতিকালের পূর্বে বলে গিয়েছেন, তাঁর অবর্তমানে ও যেন নিজের ছেলেকে যেন জামেয়া বারিধারায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত করা না হয়। আত্মশুদ্ধিতে কি পরিমাণ বলীয়ান হলে একজন মানুষ নিজের স্বার্থ ও আপনজনের স্বার্থকে এভাবে বিলিয়ে দিতে পারেন ! উলামা, মাশায়েখ, খানকাহের পীর-মুরশিদের জন্য এক উজ্জ্বল নমুনা রেখে গেছেন মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী।

তাঁর মুরশিদ

আত্মশুদ্ধি বা তাযকিয়ায়ে নফসে মাওলানা কাসিমীর প্রথম মুরশিদ ছিলেন শায়খুল হাদীস মুহাম্মদ জাকারিয়া কান্ধালাবী র,। আল্লামা জাকারিয়া কেবল পীর ছিলেন না, আর শুধু উপমহাদেশই নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বে ইলমে হাদীসের এক স্বার্থক ভাষ্যকার ছিলেন তিনি । তাঁর প্রণীত গ্রন্থগুলো মুসলিম মিল্লাতের অমূল্য রত্ন।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ভারতের মুরাদিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনাকালে তাঁর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ফকীহুল উম্মাহ মাওলানা মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রাহ.)এর হাতে দ্বিতীয়বার বায়’আত হন মাওলানা কাসেমী। তাঁর নিকট থেকেই আত্মশুদ্ধিতে তিনি ইজাযত লাভে ধন্য হন। মুফতী মাহমূদ হাসান গাঙ্গুহী ছিলেন ফিকহে হানাফীর এক মুখপাত্র । ফাতাওয়ায়ে মাহমূদিয়া প্রণয়ন করে তিনি অমর হয়ে থাকবেন উলামায়ে কিরামের হৃদয়ে।

১৯৭৩ সালে শায়খুল হাদীস আল্লামা জাকারিয়া কান্ধালাবীর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন । ১৯৯৫ সালে মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহির কাছে থেকে খিলাফত লাভ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দ্বীন শিখতে হলে ব্যাপক অধ্যয়ন ও আহলে দ্বীনের সান্নিধ্য লাভ জরুরি। সাহাবায়ে কেরাম আদর্শ মানুষ হয়েছেন রাসূলুল্লাহ সা,এর সুহবত ও তারবিয়তের মাধ্যমে। পাপ ও তাকওয়া একসাথে চলতে পারে না। তাই পাপমুক্ত জীবনের সাধনা অপরিহার্য।

শায়খুল হাদীস হিসেবে

হাদিস শাস্ত্রে মরহুমের পাণ্ডিত্য ছিল সর্বজন স্বীকৃত। হাদীসের দরস প্রদানে তিনি তাঁর দেওবন্দী উস্তাদদের রীতি অনুসরণ করে চলতেন। বিশেষ করে আল্লামা আনজার শাহ কাশ্মিরি র, ও আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপূরী র,এর পাঠদান পদ্ধতি ছিল তাঁর কাছে প্রিয়। তাঁর কাছে হাদীস অধ্যয়নের জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে । দুর্বোধ্য বিষয়গুলো বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপনার দক্ষতার কারণে তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন । সুদীর্ঘ ৪৮ বছর তিনি হাদীস শাস্ত্রের অধ্যাপনা করেন। গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে তাঁর লাখ লাখ শিষ্য, ছাত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষী। হাজার হাজার বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামের ছিলেন তিনি উস্তাদ ।

ইসলাম ও জাতীয় স্বার্থে

বহুমাত্রিক কাজে অংশগ্রহণ ছিল মাওলানা কাসিমীর অনন্য বৈশিষ্ট্য। ইসলাম ও মুসলিমের স্বার্থে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। জাতীয় শিক্ষানীতিতে ইসলামী শিক্ষার সংযোজন, ইসলাম বিরোধী নারীনীতি প্রনয়ণ ,মায়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন, মজলূম ফিলিস্তিনদের সমস্যা সমাধান, কাশ্মীরিদের বিশেষ অধিকার ফেরত দান, দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি ও ব্যাংক লুণ্ঠন এবং বিদেশে টাকা পাচার রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ছিলেন গণ মানুষের পক্ষে সোচ্চার। এসব বিষয়ে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে রাষ্ট্র নায়কের মত বিবৃতি ও মতামত পেশ করতেন।

তিনি ইসলাম বিরোধী যেকোন কাজে সরকার ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে হুশিয়ার করতেন । ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ, হাইকোর্ট অঙ্গন থেকে থেমিস দেবীর মূর্তি অপসারণ, ফ্রান্সে মহানবী সা, এর অবমাননাকর ব্যঙ্গ চিত্র প্রকাশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

পড়ন্ত জীবনে হুইল চেয়ারে বসে রাজপথে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে আজীবন সোচ্চার ছিলেন তিনি । বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলের নেতা হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। দেশের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতার পক্ষে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কথা বলতেন । দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম ও খুলাফায়ে রাশেদিনের আদলে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর আজীবন সাধনা।

হক ও ন্যায়ের পথে আপোসহীন

আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে উঠে দ্বীনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন মাওলানা কাসিমী। কোনো প্রলোভন ও চাপের কাছে মাথা নত করেননি তিনি। সত্য ও ন্যায়ের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে আমরণ লড়াই করে গেছেন তিনি । হক ও ন্যায়ের প্রশ্নে ছিলেন আপোসহীন সৈনিক ।

আত্মবিক্রয়, আত্মপ্রতারণা করেননি কোন দিন। বীর সাজার অস্থিরতা ছিলনা তাঁর অভিধানে। পার্থিব মোহ এবং শাসকদের তুষ্টি বিধানে পদলেহনের কোন ইতিহাস নেই তাঁর জীবনে । দেশ ও জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সুচিন্তিত আর বুদ্ধিমত্তার।

‘বাংলার মাদানী’

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ছিলেন শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী র, এর একনিষ্ঠ ভক্ত-অনুরক্ত । সেই মাদানী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ইলমী, সিয়াসী, রূহানী ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তিনি । এছাড়া শিরক, বিদআত, সামাজিক কুসংস্কার ও ব্রিটিশের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যেভাবে লড়াই করে গেছেন শায়খুল ইসলাম মাদানী তেমনি বাংলাদেশে নূর হোসাইন কাসেমী একই ভূমিকা পালন করেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সিপাহসালার হুসাইন আহমদ মাদানী র, এর উত্তরসূরি ছিলেন তাঁর সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ পুত্র আস’আদ মাদানী র,। নূর হুসাইন কাসিমী ছিলেন তাঁর একান্ত আস্থাভাজন । বাংলাদেশে আস’আদ মাদানীর স্থলাভিষিক্ত বিবেচিত হতেন তিনি ।

বাংলাদেশ থেকে দারুল দেওবন্দে পড়া লেখার জন্য যেতে বাংলাদেশ থেকে তাঁর সুপারিশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হত । সুপারিশ প্রদানে তিনি কোন ধরনের স্বজন প্রীতির আশ্রয় নিতেন না। স্বজন প্রীতি ছিল না তাঁর কোন কাজেই । এসব কারণে মাওলানা নূর হুসাইন কাসিমী বাংলার মাদানী বলে পরিচিত লাভ করেন ।

মধ্যপন্থা অবলম্বন

ব্যক্তি জীবনে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ছিলেন একজন উঁচু মাপের বুজুর্গ । নফল সালাত আদায় তাসবীহ তাহলীল, জিকির-আজকার, কুরআন তিলাওয়াত, ইসলামী গ্রন্থ অধ্যয়ন ইত্যাদির প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। প্রতি রমজান মাসে ৩০ দিন মসজিদে অবস্থান করে ইবাদতে মশগুল থাকতেন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সেই সময় দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা সীমিত রাখতেন।

পরিমিতিবোধ ও মধ্যমপন্থা অবলম্বন ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম বিশিষ্ট । উগ্রবাদিতা বা অতিমাত্রিক শৈথিল্যের পথ তিনি পরিহার করে চলতেন। সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত হলেও কমান্ডিং সেকটরে ছিলেন অকুতোভয়। বিনয়, সৌজন্য ও অতিথিপরায়ণতা ছিল তাঁর চরিত্রের আলোকিত দিক। যেকোন দল ও মতের মানুষকে সহজে আপন করে নেয়ার এক সহজাত গুণ ছিল তাঁর। উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টের মতো জটিল রোগে তিনি ছিলেন কাতর। সাথে বার্ধক্যের ভারে ন্যুজ এই সাধক সাহীহ বুখারির সবক প্রদান করতেন এর সাথে মাদ্রাসার প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করতেন একই সঙ্গে ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আঞ্জাম দিতেন।

কুরআন তিলাওয়াতে যত্নবান

কুরআনের মর্ম অনুধাবন, কুরআনের বিধিনিষেধ প্রতিপালন ও কুরআনের বিধান প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। কুরআন চর্চার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। রামাজান মাসে অধিকতর সময় কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং বিভিন্ন আয়াতের প্রয়োজনীয় নোট নিতেন। তিনি বলতেন, কুরআন হল ইলমে ওয়াহীর ফল্গুধারা এবং আল্লাহ তা’আলার মা’রিফাতের ধনভাণ্ডার। এই স্রোতধারায় অবগাহন ছাড়া প্রাজ্ঞ আলিম হওয়া সম্ভব নয়।’

নম্রতা ও অমুখাপেক্ষিতা

শায়খ নূর হুসাইন দু’টি গুণের প্রতি ছিলেন খুবই যত্নবান। এইগুণ দু’টির কারণে তিনি সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাহল, নম্রতা ও ইসতিগনায়ী। এ দু’টি গুণ অর্জনের জন্য ছাত্র ও শিষ্যদের নসিহত করতেন। বলতেন, নম্রতা অবলম্বন কর, অহঙ্কার বর্জন । ইসতিগনায়ী তথা পরমুখাপেক্ষিতা পরিহার কর। তাঁর দর্শন ছিল, এদু’টি গুণ অর্জন করতে পারলে ‘উলামায়ে কিরামের আত্ম সম্মান অটুট থাকবে । বিত্তশালী ও শাসক শ্রেণীর সাথে মাখামাখি তাঁর পসন্দ ছিল না। কাউকে অবজ্ঞা করাও তাঁর নীতি বিরোধী ছিল।

প্রতিকূলতায় ধৈর্য ধারণে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত জামেয়া বারিধারা কিছু দিনের জন্য দখল হয়ে গিয়েছিল। হাতছাড়া হয়ে গেলেও ধৈর্য হারাননি। অন্য জায়গায় অপরিসর স্থানে মাদরাসা স্থানান্তর করে পড়ালেখা অব্যাহত রাখেন। পরবর্তী কালে সেখানে ও আজিমুশ্বান একটি মাদ্রাসা গড়ে ওঠে।

ইন্তিকাল

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। এই জ্ঞানতাপসের ইন্তেকালে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত জানাযার সালাতে লাখো মানুষের ঢল নামে। জানাযার সময় নির্ধারিত হয় সকাল ৯ ঘটিকায়। সারা দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করেন। তাঁকে হারানোর বেদনায় বহু মানুষকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখা গেছে। এ যেন এক অভিভাবককে হারানোর বেদনা।

– ফয়সল আহমদ জালালী, লেখক ও গবেষক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এবং সিনিয়র মুহাদ্দিস, দারুল উলূম মাদ্রাসা, মিরপুর ১৩, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।