Home ইতিহাস ও জীবনী আল্লামা কাসেমী (রাহ.): আপোষহীন এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের চিরবিদায়

আল্লামা কাসেমী (রাহ.): আপোষহীন এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের চিরবিদায়

।। মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী ।।

মহান রাব্বুল আলামিন যুগে যুগে তাঁর এমন কিছু বান্দাহকে দুনিয়াতে পাঠান যারা বিশেষভাবে শুধু আল্লাহর বিধান প্রচার-প্রসারের দায়িত্ব পালন করেন এবং এভাবেই আল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত এই ধারা চালু রাখবেন।

যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ দেশ-জাতি ও ধর্মের বৃহত্তর খেদমত আঞ্জাম দিয়ে ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল তালিকায় নাম অঙ্কিত করে নেওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন এবং যখনই কোন তাগুত শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তখনই যে সকল আল্লাহর বান্দাহগণ তাদের ঈমানী শক্তির তরবারি দ্বারা তাগুত শক্তিকে দ্বিখন্ডিত করে দিয়েছেন, দেশের দ্বীনি অঙ্গনের অন্যতম প্রাণপুরুষ হযরত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) তাঁদের অন্যতম।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.) একটি নাম, একটি ইতিহাস। যিনি ইসলামী রাজনীতির একটি ধ্রুবতারা। তিনি ছিলেন একাধারে দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ আলেমেদ্বীন, শায়খুল হাদিস, মহাপরিচালক, ইসলামি রাজনীতির কর্ণধার, আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। এমন আরও অনেক অভিধায় ভূষিত করা যায় তাঁকে। সর্বোপরী দ্বীনের এমন কোন শাখা-পল্লব নেই যে শাখা-পল্লবে বিচরণ করেননি তিনি।

৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বঙ্গভূমিতে যে কজন বিপ্লবী আলেমের আবির্ভাব ঘটেছে নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.) তাঁদের প্রথম সারির অন্যতম একজন। কিংবদন্তি সমতুল্য এই কীর্তিমান পুরুষ ছিলেন দ্বীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন মর্দে মুজাহিদ। তিনি নানা প্রতিকূলতার মাঝেও পুরোটা জীবনে দ্বীনের নানামুখী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। বিশেষ করে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ও জামিয়া সুবহানিয়া মাদরাসার মহাপরিচালক ও শায়খুল হাদিস হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

সাথে সাথে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ সফল রাজনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের অন্যতম ইসলামী রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব। যাঁর বিচক্ষণ ও বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে দ্বীনি দাওয়াত ও বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং জমিয়তকে বাংলাদেশের অন্যতম ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে সমাদৃত করতে সক্ষম হয়েছেন।

বলতে গেলে বাংলাদেশে জমিয়তের এত দূর পর্যন্ত আসা, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা, বিশেষ করে ইসলামী রাজনীতিকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য। কওম ও মিল্লাতের জন্য তাঁর মত এরকম দরদী জাগরুক প্রাণ আমাদের বাংলাদেশে খুব কমই আছেন।

আরও পড়তে পারেন-

তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ অন্যতম কাণ্ডারি। হেফাজতের শুরুলগ্ন থেকেই তিনি সংগঠনের জন্য নিষ্ঠার সাথে ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি ছিলেন হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগরীর আমীর।

যখনই ইসলামবিরোধী কোন অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তখনই তাঁর ডাকে হাজার হাজার তৌহিদী জনতা রাস্তায় নেমে এসেছেন। তাঁর নেতৃত্বে পুরো ঢাকায় সৃষ্টি হতো হেফাজতে ইসলামের গণজোয়ার । তিনি হেফাজতে ইসলামের মরহুম আমীর, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর সাবেক সফল মুহতামিম হযরত আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রাহ.) এর অন্যতম ভাবশিষ্য ছিলেন এবং তাঁর খুব কাছের ও পছন্দের একজন ব্যক্তি ছিলেন।
২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চে যখন ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কুরুচিপূর্ণ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল, তখন আল্লামা আহমদ শফী (রাহ.)এর ডাকে দেশের সর্ববৃহৎ দ্বীনি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন দেশের লক্ষ-কোটি তৌহিদী জনতা। হেফাজতের সেই গণজাগরণে আল্লামা কাসেমীর নেতৃত্ব ও অনন্য ভূমিকা অনস্বীকার্য।

হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক লংমার্চ, তৎপরবর্তী হেফাজতের ডাকে দেশের সর্ববৃহৎ ‘ঢাকা অবরোধ’ কর্মসূচিতে লক্ষ-কোটি ইসলামপ্রেমী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। তাঁর হুংকারে বাতিলের মসনদ কেঁপে উঠতো। তিনি ছিলেন ইসলামী জাগরণের এক মহাবীর। এ ছাড়া দেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকাতে হেফাজতের যত আন্দোলন, কর্মসূচি ও বিক্ষোভ-সমাবেশ হত, প্রায়শই তাঁর নেতৃত্বে বাস্তবায়ন হতো। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি হেফাজতের মহাসচিবের গুরুদায়িত্বে অভিষিক্ত হন। সেদিন তিনি হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে অংশগ্রহণ করতে উম্মুল মাদারিস হাটহাজারী মাদরাসায় ছুটে এসেছিলেন। সেদিনটি ছিল ঐতিহাসিক একটি দিন।

সেদিন তাঁর সাথে আমার মুসাফাহা ও কুশল বিনিময় হয়েছিল। আমি হেফাজতের একজন কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল হওয়ার সুবাদে বিদগ্ধ এ ব্যক্তিত্বের সাথে মঞ্চে বসার খোশনসিবও সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর উপস্থিতিতে কাউন্সিল অনুষ্ঠান আরও প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল। অনুষ্ঠান শেষে দেয়া তাঁর জ্বালাময়ী বক্তব্যে সকলের আত্মার খোরাক মিটেছিল।

তাঁর সাথে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। হেফাজতের বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত হত। এ ছাড়াও বিভিন্ন জায়াগায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে আমার দেখা হত। হেফাজতের কাউন্সিলের আগে সর্বশেষ তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিল গত ১০শে অক্টোবর কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার মোল্লা কমিউনিটি সেন্টারে একটি অনুষ্ঠানে। সেখানে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিল, দীর্ঘক্ষণ কথাও হয়েছিল। তিনি এত অসাধারণ একজন ব্যক্তি, অথচ তার কথাবার্তা আলাপচারিতা একদম সাধারণ ও বিনয়ী প্রকৃতির। দেখা হলেই আমি তাঁর কাছ থেকে দু’আ নিতাম। বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ, কুশল ও মতবিনিময় হত।

২০২০ সালের ১৩ডিসেম্বর, রোজ রবিবার। এই দিনটি অন্যদিনের মত নয়; বেদনাবিধুর দিন। কারণ এই দিনটিতে মহান আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় বিধান অনুযায়ী ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরতরে চলে যান বাংলার কোটি জনতার প্রাণের স্পন্দন, ইসলামের বীর সিপাহসালার, বিপ্লবী রাজনীতিবিদ মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.)।

সেদিন দুপুর সোয়া একটার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুর ৩-৪ মিনিট পর তাঁর একান্ত প্রেসসচিব মাসিক মুঈনুল ইসলামের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক মাওলানা মুনির আহমদের মাধ্যমে আমি তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পাই। তবে আমার বিশ্বাস তিনি কোনদিন বিস্মৃত হবেন না। এ জাতি তাঁর অমর কীর্তির কারণে তাঁকে মনে রাখবেন যুগ-যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন তাঁর কীর্তি এবং অগণিত ভক্ত, অনুরক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের স্মৃতি ও হৃদয়ে ।

– মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী, সিনিয়র মুহাদ্দিস, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী চট্টগ্রাম এবং সহকারী মহাসচিব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।