Home ইতিহাস ও জীবনী ভাষাতত্ত্ববিদ ও জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: জীবন ও কর্ম

ভাষাতত্ত্ববিদ ও জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: জীবন ও কর্ম

।। মুহাম্মদ আসাদ ।।

ভাষাতত্ত্ববিদ ও জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ। ভাষা ও ভাষাতত্ত্বে ছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতার নাম মফিজউদ্দিন আহমদ। মাতার নাম হুরুন্নেসা। শহীদুল্লাহ নামটি তাঁর মা পছন্দ করে রেখেছিলেন।

ড. শহীদুল্লাহর বংশ পরিচয় সম্পর্কে জানা যায়, সৈয়দ আব্বাস আলী মক্কী নামে এক কামিল দরবেশ চতুর্দশ শতকে দক্ষিণ বাংলায় ইসলাম প্রচার করেন। পীর গোরাচাঁদ নামেও তিনি পরিচিত। ১২৬৫ সালে পবিত্র মক্কানগরে এই সাধকের জন্ম। কারো কারো মতে তিনি হযরত শাহজালালের (রহ) ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম। হাড়োয়ায় পীর গোরাচাঁদের মাজার অবস্থিত।

ড. শহীদুল্লা ‘র আদি পুরুষ শেখ দারা মালিক এই দরবেশ সাহেবের প্রধান খাদেমরূপে হিন্দুস্থান থেকে এ দেশে আগমন করেন এবং তাঁর দরগাহের বংশানুক্রমিক খাদেমরূপে বহাল হন। ইনিও একজন কামেল দরবেশ ছিলেন। শহীদুল্লাহ সাহেবের রক্তে এই কামেল দরবেশের রক্তধারা এবং পীর গোরাচাঁদের রুহানী ফায়েজ প্রবাহিত হয়েছিল। গ্রামের পাঠশালাতেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পাঠশালার পড়া শেষ করে তিনি হাওড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন।

বাল্যকাল থেকেই তাঁর বই পড়ার দারুণ নেশা ছিল। সেই সময় থেকেই তাঁর ভাষা শেখার আগ্রহ জন্মে। স্কুল জীবনেই তিনি আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি এবং উড়িয়া ভাষা পড়তে শিখেছিলেন। হাওড়া জেলা স্কুলে পড়ার সময় তাঁর শিক্ষক ছিলেন আচার্য হরিনাথ দে। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা ভাষাবিদ। তাঁর সংস্পর্শে এসেই শহীদুল্লাহ ভাষা শেখায় অনুপ্রাণিত হন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে ১৯০৪ সনে তিনি কৃতিত্বের সাথে সংস্কৃতসহ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে এবং ১৯০৬ সালে এখান থেকে এফ এ পাস করেন। বিএতে ভর্তি হন প্রথমে হুগলী কলেজে। ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হলে তিনি গ্রামে চলে আসেন।

১৯০৮-৯ সালে তিনি যশোর জিলা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে বিএ পাস করেন। বাঙালি মুসলিম ছেলেদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম সংস্কৃতি নিয়ে অনার্স পাসের কৃতিত্ব অর্জন করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিষয়ে এমএ পড়তে চাইলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিষয়ের অধ্যাপক পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী মুসলিম ছাত্রকে সংস্কৃত পড়াতে অস্বীকার করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জীর অনুরোধে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং এম এ ডিগ্রি লাভ করেন (১৯১২)। এ সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ভাষাতত্ত্ব বিভাগ খোলা হয়।

১৯১১-১৫ সালে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন। ১৯১৩ সালে তিনি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় জার্মানিতে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্যে ভারত সরকারের বৃত্তি লাভ করেন। কিন্তু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ছাড়পত্রের অভাবে তাঁর বিদেশ যাত্রা ব্যর্থ হয়। ১৯১৪ সালে তিনি বিএল পাস করেন।

১৯১৫ সালে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর অনুরোধে তিনি সীতাকু-ু হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি নিজ মহকুমা শহর বশিরহাটে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ওকালতিতে তাঁর ব্যাপক প্রসার হয়। একবার তিনি বশিরহাট পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। ১৯১৭ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৮-১৯২১ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি ও সমিতির মুখপাত্র বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন।

১৯১৯-১৯২১ সাল পর্যন্ত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শরৎকুমার লাহিড়ী গবেষণা সহায়ক পদে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাসের উপর বেশ কযেকটি ব্যাখ্যামূলক প্রবন্ধ লেখেন, যা সে সময়ে গুণীদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে।

প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জার্নালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জী প্রবন্ধগুলো পাঠ করে শহীদুল্লাহকে যে সংক্ষিপ্ত পত্র লিখেছিলেন তা ছিল : : Bar is not for you. come to our university স্যার আশুতোষের দুই বাক্যের এই চিঠি সেদিন শহীদুল্লাহর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। স্যার আশুতোষের এই অবদানের কথা শহীদুল্লাহ জীবনে কখনো ভোলেননি।

তিনি তাঁর ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত; গ্রন্থটি স্যার আশুতোষের নামে উৎসর্গ করতে গিয়ে এই পত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক (১৯২৫ পর্যন্ত) ছিলেন। ১৯২২-২৪ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে খ-কালীন অধ্যাপক ছিলেন।

১৯২৩ সালের ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত শান্তি নিকেতনের সমাবর্তন উৎসবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা সভার তিনি সভাপতি ছিলেন। ১৯২৬ সালে ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য ড. শহীদুল্লাহ ফ্রান্সে যান। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বৈদিক ভাষা, প্রাচীন ভাষা, তিব্বতী ভাষা চর্যাপদ অধ্যয়ন করেন। একই সাথে জার্মানীর ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও বৈদিক ভাষা, সংস্কৃত ভাষা ও প্রাকৃত ভাষার ওপর পড়াশোনা করেন। দুই বছর সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের নাম ‘ল্য শাঁ মিসতিক দ্য কান্নআদ্য সরহ’ প্রথম বারের মত ইউরোপীয়দের কাছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদকে তুলে ধরেন।

তিনি এও প্রমাণ করেন যে, বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে নয়, গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে এসেছে। যেখানে অধিকাংশ প-িত দাবি করেন বাংলা ভাষার উদ্ভব দশম শতাব্দীতে, সেখানে শহীদুল্লাহ দাবি করেন এর সূচনা সপ্তম শতাব্দীতে। এটি যে একটি অসাধারণ গবেষণা কর্ম হয়েছিল তাঁর স্বীকৃতিও তিনি লাভ করেছিলেন। ১৯২৮ সালে এটি প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী ত্রিশ বছরে ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর খ্যাতি স্বদেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯২৮ সালে অক্টোবর মাসে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নিখিল বঙ্গীয় মুসলিম যুব সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ আলাদা হলে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ও রিডার হিসেবে তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৪০-১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোস্ট ছিলেন।

১৯৪১ সালে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলনে ভাষাতত্ত্ব শাখার সভাপতি ছিলেন এবং বিশেষ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৯৪২ সালে ঢাকায় সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি কর্তৃক আয়োজিত ‘সোভিয়েত মেলা’ নামক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।

১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে জয়পুরে অনুষ্ঠিত পিইএন আয়োজিত নিখিল ভারত লেখক সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এই সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন- “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তাঁর চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গিতে দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই”।

১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে অতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে বাংলা বিভাগে পুনরায় যোগদান করেন এবং ৬ বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৩-১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ফরাসী ভাষায় খ-কালীন অধ্যাপক ছিলেন।

১৯৫৫ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালের নবেম্বর মাসে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অন ট্রেডিশনাল কালচার ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া-তে ইউনেস্কো মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন এবং সেমিনারে চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৫৯-৬০ সালে করাচিতে অবস্থিত উর্দু উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত উর্দু অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং এক বছর সেখানে অবস্থান করেন।

১৯৬০ সালের ১ জুলাই ‘পূর্ব পাকিস্তানী ভাষার আদর্শ অভিধান’ প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমীতে যোগদান করেন। ১৯৬১-৬৪ সালে বাংলা একাডেমীর ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক ছিলেন। একই সময়ে তিনি পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি হন। ১৯৬৩ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তানী ভাষা আদর্শ অভিধান’ প্রকল্পের প্রথম অংশ পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ প্রণয়নের কাজ সমাপ্ত করেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হন। একই সময়ে ঢাকার ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বাহী সভার সদস্য হন।

১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃক গঠিত বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির তিনি সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রথম ইমেরিটাস প্রফেসরের পদ লাভ করেন। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রাইড অব পারফরম্যান্স লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে ফরাসী সরকার তাকে নাইট অব দি অর্ডারস অব আর্টস এন্ড লেটারস পদক প্রদান করেন। আদমজী, দাউদ প্রভৃতি সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী সভাপতিরূপে দীর্ঘদিন তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

তার গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। এছাড়া তিনি ৪১টি পাঠ্য বইও লিখেছেন। ২০টি বই সম্পাদনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের উপর তার লিখিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। ভাষাতত্ত্বের উপর রয়েছে তার ৩৭টি রচনা। এছাড়া তিনি ৩টি ছোটগল্প এবং ২৯টি কবিতা লিখেছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনা কর্ম হলো-

গবেষণা- সিদ্ধা কানুপার গীত ও দোহা (১৯২৬), বাংলা সাহিত্যের কথা ১ম খণ্ড, (১৯৫৩) দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৬৫) বৌদ্ধ মর্মবাদীর গান (১৯৬০) ভাষাতত্ত্ব ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১), বাংলা ব্যাকরণ (১৯৩৫), বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৫৮)।

প্রবন্ধ পুস্তক

১। ইকবাল (১৯৪৫), ২। আমাদের সমস্যা (১৯৪৯), ৩। বাংলা আদব কি তারিখ (১৯৫৭), ৪। Essays on Islam (1945), 5| Traditional culture in East Pakistan (1963), 6| Hundred sayings of Holy prophet (1945), 7| Buddist mystic song (1960).

গল্প গ্রন্থ : রকমারি (১৯৩১)

শিশুতোষ গ্রন্থ : শেষ নবীর সন্ধানে, ছোটদের রাসূলুল্লাহ (১৯৬২) সেকালের রূপ কথা (১৯৬৫)।

অনুবাদ গ্রন্থ ১১টি : ১। দীওয়ানে হাফিজ (১৯৩৮)। ২। অমিয় শতক (১৯৪০)। ৩। রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম (১৯৪২)। ৪। শিকওয়াহ ও জওয়াব-ই-শিকওয়াহ (১৯৪২)। ৫। মহানবী (১৯৪৬)। ৬। বাইআত নামা (১৯৪৮)। ৭। বিদ্যাপতি শতক (১৯৪৫)। ৮। কুরআন প্রসঙ্গ (১৯৬২)। ৯। মহরম শরীফ (১৯৬২)। ১০। অমর কাব্য (১৯৬৩)। ১১। ইসলাম প্রসঙ্গ (১৯৬৩)।

তার অনুবাদ উচ্চমানের শিল্প কর্ম বলে স্বীকৃত। আল্লামা ইকবালের শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া এর উৎকৃষ্ট নিদর্শন। তার রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম পড়ে রবীন্দ্র বিষয়ক পণ্ডিত প্রথম নাথ বিশি বলেছিলেন, আপনার অনুবাদ পড়ে মনে হলো কবিত্ব ও পাণ্ডিত্য একই সাথে উপস্থিত।

সংকলন ও সম্পাদনা:

পদ্মাবতী (১৯৫০), প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে শেষ নবী (১৯৫২), গল্প সংকলন (১৯৫৩), আঞ্চলিক ভাষার অভিধান (দুইখ-), আঙ্গুর (শিশু পত্রিকা) ১৯২০, দি পিস (ইংরেজি মাসিক) ১৯২৩, বঙ্গভূমি (মাসিক সাহিত্য পত্রিকা) ১৯৩৭, তকবীর (পাক্ষিক পত্রিকা) ১৯৪৭।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার সুপারিশ করেন। এর প্রতিবাদে প্রথম লেখনী ধারণ করেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে তিনি বলেন : পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন, যেমন- পশতু, বেলুচি, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা। কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেই মাতৃভাষা রূপে চালু নয়।’ তিনি বলেছেন, “যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা রূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই”।

তিনি আরো বলেছেন, “বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দুভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদ রূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি”।

এই প্রতিবাদ অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রচেষ্টা করে গেছেন আজীবন। ১৯৫০ সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়ে সুধীজনের যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তার খসড়া ছিল তারই রচনা। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন আদর্শ স্থানীয়। ছাত্রদের প্রতি তার যে স্নেহশীলতা ছিল, তার তুলনা হয় না। বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি মোট একুশটি ভাষা জানতেন। তার মধ্যে রয়েছে- ইংরেজি, ফার্সি, সংস্কৃত, জার্মান, আরবি, উর্দু, হিব্রু, গ্রিক, ল্যাটিন, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি, তামিল, সিংহলি ইত্যাদি। বাংলা ছাড়াও তিনি ইংরেজি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন এবং ভালভাবে লিখতে পারতেন। তাঁর মতো পণ্ডিত ব্যক্তি আমাদের দেশে এ যাবত জন্মগ্রহণ করেননি।

১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকায় পরলোক গমন করেন।