Home ইতিহাস ও জীবনী সীরাতে তাইয়্যেবাহ: রাসূলুল্লাহ (সা.)এর অনুপম জীবনালেখ্য

সীরাতে তাইয়্যেবাহ: রাসূলুল্লাহ (সা.)এর অনুপম জীবনালেখ্য

।। মাওলানা ড. আবদুর রাজ্জাক ইস্কান্দার ।।

یَا صَاحِبَ الجَمَالِ وَ یَا سَیِّدَ البَشَرْ
       مِنْ وَجْھِکَ الْمُنِیْرِ لَقَدْ نُوِّرَ الْقَمَرْ
لَا یُمْکِنُ الثَّنَاءُ کَمَا کَانَ حَقَّہ
       بعد از خدا بزرگ توئی قصہ مختصر

হে সৌন্দর্যের আধার, হে মানবজাতির নেতা!
তোমার চেহারার উজ্জ্বলতায় চাঁদও আলোকিত।
তোমার প্রকৃত প্রশংসা সম্ভব নয় কখনোই-
সত্য তো এটাই: আল্লাহর পরে তুমিই শ্রেষ্ঠ।

প্রারম্ভিক জীবন

বংশপরিচয়: মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম।

কুনিয়ত: আবুল কাসেম।

মাতার নাম: আমিনা বিনতে ওয়াহাব।

জন্ম: সোমবার, ১২ রবিউল আউয়াল, আমুল ফীল (হাতির বছর)।

জন্মের আগেই পিতা আবদুল্লাহ সফররত অবস্থায় মদীনায় ইন্তিকাল করার ফলে নবী কারীম (সা.)এর লালন-পালনের দায়িত্ব নেন দাদা আবদুল মুত্তালিব। শৈশবে তাঁকে দুগ্ধপান করান হালিমা সাদিয়া (রাযি.)।

ছয় বছর বয়সে মা আমিনা রাসূলুল্লাহ (সা.)কে মাতুলালয়ে নিয়ে যান। ফেরার পথে আবওয়া নামক স্থানে তিনি ইন্তিকাল করেন। এরপর হযরত (সা.)এর লালন-পালনের ভার নেন উম্মে আইমান (রাযি.)। আট বছর বয়সে দাদাও ইন্তিকাল করেন। তখন রাসূল (সা.)এর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নেন চাচা আবু তালিব।

নয় বছর বয়সে চাচার সঙ্গে প্রথমবার শামে সফর করেন। পরবর্তীতে পঁচিশ বছর বয়সে পুনরায় শামে যান, এ সফর ছিল খদিজা আল-কুবরা (রাযি.)এর ব্যবসার কাজে। সফর শেষে দু’মাসের মধ্যে তাঁর সঙ্গেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে কুরাইশদের সঙ্গে কাবা শরীফের পুনর্নির্মাণে অংশ নেন; স্বয়ং পাথর বহন করেন। হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের ক্ষেত্রে গোত্রগুলোর মধ্যে যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল, তিনি সেটা নিজ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সঙ্গে এমনভাবে সমাধান করেন যে, সকলে সন্তুষ্ট হন।

শিক্ষা ও চরিত্রগঠন

রাসূলুল্লাহ (সা.) অনাথ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন। যখন সমাজে সর্বত্র বিরাজ করছিল মূর্তিপূজা ও অজ্ঞতার অন্ধকার। কিন্তু আল্লাহর হিফাজতে তিনি শৈশব থেকেই যাবতীয় অপবিত্রতা ও কুসংস্কার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। কোনো পার্থিব শিক্ষাগুরু না থাকা সত্ত্বেও তাঁর চরিত্র, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের বিকাশ সমানতালে চলতে থাকে।

এমনকি সমাজের সব মানুষ একবাক্যে তাঁকে ‘আল-আমীন’ (বিশ্বাসযোগ্য) ও ‘আস্-সাদিক’ (সত্যবাদী) উপাধি দ্বারা সম্মানিত করে।

একটি বিখ্যাত কবিতার পংক্তি এখানে যেন স্বতঃসিদ্ধ হয়ে ওঠে-

مری مشّاطگی کی کیا ضرورت حسنِ معنی کو
کہ فطرت خود بخود کرتی ہے لالہ کی حنا بندی

“অর্থের সৌন্দর্যে কোনো প্রসাধনের প্রয়োজন হয় না;
প্রকৃতি স্বয়ং লাল ফুলকে রাঙিয়ে দেয় হেনা রঙে”।

নির্জনতা ও ইবাদত

শৈশবে কিছুদিন অল্প পারিশ্রমিকে মক্কার লোকদের ছাগল চরিয়েছেন। কিন্তু যৌবনে তিনি নির্জনতা পছন্দ করতে শুরু করেন। প্রায়ই হেরার গুহায় একাধিক রাত একাকী ইবাদতে কাটাতেন।

নবুওয়াতের পূর্বেই তাঁর স্বপ্নসমূহ সত্য হতে শুরু করে। রাতে যা দেখতেন, ঠিক তাই দিবালোকে প্রতিফলিত হতো।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর শিক্ষা ও চরিত্রগঠনের ধারা

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সীরাতের প্রতিটি দিক অনন্য এবং উম্মতের জন্য দিশারী আলোকস্তম্ভ। যদিও আপনার التشریعی دور (শরীয়ত ঘোষণার সময়কাল) نبوت লাভের পর থেকে শুরু হয়েছে, কিন্তু তার পূর্ববর্তী শৈশব ও যৌবনের জীবনও উম্মতের জন্য শিক্ষা ও হিদায়াতপূর্ণ দৃষ্টান্তে ভরা।

শৈশবকালেও ন্যায়বোধ

শিশুকালেই ন্যায়বোধ ও অপরের অধিকারের প্রতি যত্নশীলতা প্রকাশ পায়। যেমন, দুধ মাতা হালিমা সাদিয়া (রাযি.) এক দিকের স্তন থেকে দুধ খাওয়ানোর পর অপর দিকটি শিশু মুহাম্মদ (সা.)এর দিকে বাড়িয়ে দিতেন; কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতেন না- কারণ, সেটি তাঁর দুধভাইয়ের অধিকার।

সমষ্টিগত কাজে আগ্রহ

ছোটবেলা থেকেই সামাজিক কাজে মুহাম্মদ (সা.)এর প্রবল আগ্রহ ছিল। যখন কুরাইশরা বায়তুল্লাহ শরীফের পুনর্নির্মাণে ব্যস্ত, তখন তিনি তাদের সঙ্গে পাথর বহন করছিলেন।

লজ্জাশীলতা ও পর্দার প্রতি স্বভাবজাত অনুরাগ

একদিন চাচা আব্বাস (রাযি.) দেখলেন- মুহাম্মদ (সা.) কাঁধে পাথর বহন করছেন, আর ভারী পাথরের চাপে কাঁধ নগ্ন হয়ে গেছে। তিনি দয়া করে হযরতের কোমরের কাপড় খুলে কাঁধে রাখেন। তখন লজ্জাশীলতার কারণে হযরত অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং জ্ঞান ফিরেই বলেন- “আমার কাপড় আমাকে ফিরিয়ে দাও।”

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব

হযরত (সা.) শৈশবে কুরাইশদের ছাগল চরিয়ে উপার্জিত মজুরি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। বয়স বাড়লে গ্রহণ করেন ব্যবসার মহান পেশা। সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত হিসেবে শীঘ্রই সমাজে পরিচিতি পান এবং সকলে হযরত (সা.)কে ডাকতে থাকেন “আস্-সাদিক আল-আমীন” (সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী)।

বিচক্ষণতা ও মীমাংসার ক্ষমতা

বায়তুল্লাহ পুনর্নির্মাণকালে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে কুরাইশ গোত্রগুলোর মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এমনকি রক্তপাতের আশঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু হযরত (সা.) এমন এক প্রজ্ঞাময় সমাধান দিলেন, যাতে সবাই সন্তুষ্ট হলো এবং বিরোধ মিটে গেল।

শৈশব থেকেই সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার স্বীকৃতি

সততা ও আমানতের জন্য রাসূল (সা.) ছোটবেলা থেকেই সমাজে “আস্-সাদিক, আল-আমীন” উপাধিতে সম্বোধিত হতেন। শুধু বন্ধু-বান্ধব নয়, শত্রুরাও হযরতের এই বৈশিষ্ট্য স্বীকার করতে বাধ্য হতো। কুরাইশরা সর্বসম্মতভাবে বলেছিল- “আমরা বারবার পরীক্ষা করেছি, কিন্তু মুহাম্মদকে সর্বদা সত্যবাদিই পেয়েছি”।

এই সবকিছুই ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অদৃশ্য তালীম ও প্রস্তুতি- কারণ, হযরতকে ভবিষ্যতে নবুওয়াত ও রিসালাত-এর মহান মর্যাদায় ভূষিত করা হবে এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন- لَقَدْ کَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُوا اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًا অর্থাৎ- “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ- তার জন্য, যে আল্লাহর সাক্ষাৎ ও পরকাল কামনা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে”। (সূরা আল-আহযাব- ২১)।

নবুওয়াত প্রাপ্তি

যখন মুহাম্মদ (সা.)এর বয়স চল্লিশে পৌঁছাল, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে নবুওয়াতের মহান দায়িত্বে ভূষিত করলেন। হেরা গুহায় অবস্থানকালে হযরত জিবরাঈল (আ.) হাজির হয়ে সূরা ইকরা’-এর প্রথম আয়াতসমূহ পাঠ করালেন। এরপর কিছু সময়ের জন্য ওহী বন্ধ থাকে, তারপর ধীরে ধীরে ধারাবাহিকভাবে নাযিল হতে থাকে।

এই ওহী পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব অর্পিত হলো ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.)এর ওপর, যিনি সর্বদাই নবীগণের কাছে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত থেকেছেন। তাঁর সম্পর্কে কুরআনে এসেছে- إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُوْلٍ كَرِيْمٍ، ذِيْ قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِيْنٍ، مُطَاعٍ ثَمَّ أَمِيْنٍ অর্থাৎ- “এ কুরআন এক সম্মানিত ফেরেশতার আনীত বাণী, যিনি শক্তিশালী, আরশের মালিকের সান্নিধ্যে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, সেখানে যাঁর নির্দেশ মানা হয় এবং যিনি অতি বিশ্বস্ত”। (সূরা আত-তাকভীর- ১৯-২১)।

ওহীর এ আলোকধারায় নবী কারীম (সা.) এমন এক পূর্ণাঙ্গ চরিত্রে রূপান্তরিত হন, যার প্রতিটি দিক উম্মতের জন্য আদর্শ। তাঁর জীবন উম্মতের প্রতিটি সদস্যের জন্য শ্রেষ্ঠতম নমুনা, যাকে সামনে রেখে জীবনের সব ক্ষেত্রেই মানুষ সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম।

দাওয়াত ও তাবলীগ

প্রথমদিকে নবী কারীম (সা.) গোপনে দাওয়াত ও তাবলিগ শুরু করেন। এই পর্যায়ে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন-

* নারীদের মধ্যে: উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাযি.)।
* পুরুষদের মধ্যে: হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.)।
* শিশুদের মধ্যে: হযরত আলী (রাযি.)।
* আযাদ করা দাসদের মধ্যে: হযরত যায়েদ ইবনে হারিসা (রাযি.)।
* দাসদের মধ্যে: হযরত বিলাল (রাযি.)।
এরপর ধীরে ধীরে আরও বহু মুক্ত মানুষ ও দাস ইসলাম গ্রহণ করেন।

পরে আল্লাহর পক্ষ থেকে খোলাখুলি দাওয়াত দেওয়ার হুকুম এলো। তখন নবী কারীম (সা.) সমগ্র জাতিকে পূর্ণ শক্তি ও দৃঢ়তার সঙ্গে আহ্বান জানাতে শুরু করলেন- “শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো, মূর্তিপূজা ত্যাগ করো”। কেউ আহ্বান গ্রহণ করল, আবার কেউ নিজেদের বিভ্রান্ত পথেই রয়ে গেল।

হাবশায় হিজরত

কুরাইশরা নবী কারীম (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)কে নানা রকম যন্ত্রণা দিতে শুরু করে। অবশেষে নবুওয়াতের ৫ম বছরে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের হাবশায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। এটাই ছিল প্রথম হিজরত। একই বছরে হযরত উমর (রাযি.) এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)এর চাচা হযরত হামজা (রাযি.) ইসলাম গ্রহণ করেন।

নবুওয়াতের ৭ম বছরে কুরাইশরা একটি চুক্তি করে- “যতদিন না মুহাম্মদ (সা.)কে আমাদের হাতে সোপর্দ করা হয়, ততদিন আমরা বনি হাশিম ও বনি আবদিল মুতালিবের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন রাখব।” ফলশ্রুতিতে নবী কারীম (সা.) ও তাঁর পরিবারকে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে ‘শিআবে আবি তালিব’-এ অবরুদ্ধ রাখা হয়। তখন রাসূল (সা.) সাহাবিদের আরেকবার হাবশায় হিজরত করার অনুমতি দেন। একে দ্বিতীয় হিজরত বলা হয়।

নবুওয়াতের ১০ম বছরে কুরাইশদের কয়েকজনের প্রচেষ্টায় এই চুক্তি ভঙ্গ হয় এবং মুসলমানরা অবরোধ থেকে মুক্তি পায়। একই বছরে নাজরানের একদল খ্রিস্টান ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু এ বছরই রাসূল (সা.)এর আশ্রয়দাতা চাচা আবু তালিব এবং অন্তরের সাথি, সহধর্মিণী হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাযি.) ইন্তিকাল করেন। এতে করে কুরাইশদের নির্যাতন আরও বেড়ে যায়।

নবী কারীম (সা.) তখন তাবলীগে-দ্বীনের উদ্দেশ্যে তায়েফ গমন করেন। কিন্তু সেখানকার লোকেরা তাঁর কথা শোনার পরিবর্তে উল্টো নিপীড়ন শুরু করে। এ বছরকে বলা হয় “আমুল হুজন” বা শোকের বছর।

নবুওয়াতের ১১তম বছরে রাসূল (সা.)কে মিরাজের অলৌকিক ঘটনা দান করা হয় এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হয়। হজ্জের মৌসুমে তিনি আরবের বিভিন্ন গোত্রকে দাওয়াত দেন। তখন ইয়াসরিবের (মদীনার) খাজরাজ গোত্রের ছয়জন ইসলাম গ্রহণ করে।

নবুওয়াতের ১২তম বছরে আউস ও খাজরাজ গোত্রের বারো ব্যক্তি রাসূল (সা.)এর হাতে বাইআত গ্রহণ করে। একে বলা হয় বাইআতে আকাবা ঊলা।

নবুওয়াতের ১৩তম বছরে মদীনার সত্তর জন পুরুষ ও বিশজন নারী নবী কারীম (সা.)এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। একে বলা হয় বাইআতে আকাবা সানিয়া।

মদীনায় হিজরত

এসময় মদীনার ঘরে ঘরে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। নবী কারীম (সা.) সাহাবিদের মদীনায় হিজরত করতে নির্দেশ দেন। কুরাইশরা এ খবর পেয়ে দারুন নাদওয়ায় সমবেত হয়ে নবী কারীম (সা.)কে হত্যার ষড়যন্ত্র রচনা করে এবং তাঁর গৃহ অবরোধ করে ফেলে। কিন্তু আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন।

রাসূল (সা.)কে হিজরতের হুকুম দেওয়া হলো। তিনি শান্তচিত্তে মুশরিকদের অবরোধ থেকে বের হয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.)এর ঘরে পৌঁছালেন। তাঁকে সঙ্গী করে গারে সওরে আশ্রয় নিলেন। সেখানে তিন দিন অবস্থান শেষে হিজরত করে মদীনার নিকটবর্তী কুবায় পৌঁছালেন।

হিজরতের পর ইসলামের নতুন যুগ

হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়। নবী কারীম (সা.) কুবায় চৌদ্দ দিন অবস্থান করেন এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপর মদীনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ করেন। সেখানে হযরত আবু আইয়ুব আনসারি (রাযি.)এর ঘরে অস্থায়ীভাবে থাকেন। পরে মসজিদে নববীর ভিত্তি স্থাপন করা হয়।

এই সময় থেকে ইসলামে আযান চালু হয়, জিহাদের হুকুম আসে এবং নবী কারীম (সা.) দাওয়াত ও জিহাদের উদ্দেশ্যে সাহাবিদের ছোট-বড় দল পাঠানো শুরু করেন।

সারইয়া ও গাযওয়াত

যে যুদ্ধাভিযানে নবী কারীম (সা.) নিজে অংশগ্রহণ করেন, তাকে গাযওয়া বলা হয়। আর যে অভিযানে তিনি নিজে যাননি, বরং সাহাবিদের দল পাঠিয়েছেন, তাকে সারইয়া বলা হয়।

রাসূল (সা.)এর সরইয়ার সংখ্যা ছিল ৪৭ এবং গাযওয়াতের সংখ্যা ছিল ২৭। হিজরতের প্রথম বছরেই তিনি তিনটি সারইয়া প্রেরণ করেন, তবে তখনো কোনো মুখোমুখি যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।

হিজরতের পর যুদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা

২য় হিজরী:

এই বছরে সংঘটিত হয়- গাযওয়া দুওয়ান, গাযওয়া বওয়াত, গাযওয়া উশাইরা এবং গাযওয়া বদর সুগরা। একই বছরে কিবলা পরিবর্তনের হুকুম আসে; রমযানের রোযা, যাকাত ও ফিতরার বিধান জারি হয়।

রমযান মাসেই সংঘটিত হয় ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মহাযুদ্ধ- গাযওয়া বদরুল কুবরা। নবী কারীম (সা.)এর সঙ্গে ছিলেন ৩১৩ জন সাহসী সাহাবী, আর কুরাইশরা এসেছিল এক হাজার সৈন্য নিয়ে। তবুও পরাজয় ঘটে কুরাইশদের। তাদের বহু নেতা নিহত হয়, সত্তর জন বন্দী হয়, আর মুসলমানদের চৌদ্দজন সাহাবী শাহাদাত লাভ করেন।

একই বছরে আরও কয়েকটি অভিযান হয়- গাযওয়া কারকারাতুল কুদর, গাযওয়া বনু ক্বাইনুকা এবং গাযওয়া সুয়াইক। তবে এসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।

এ বছরই সংঘটিত হয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক ঘটনা-

* হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাযি.)এর সঙ্গে হযরত ফাতিমাতুয্যাহ্রা (রাযি.)এর বিবাহ।
* উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাযি.)এর নবী কারীম (সা.)এর গৃহে রুখসতী।

৩য় হিজরী:

এই বছরে গাযওয়া গাতফান ও গাযওয়া বুহরান সংঘটিত হয়, কিন্তু মুখোমুখি যুদ্ধ হয়নি।
এরপর ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ- গাযওয়ায়ে উহুদ। কুরাইশরা আরবের অন্যান্য গোত্রকে সঙ্গে নিয়ে বদরের প্রতিশোধ নিতে উহুদ পর্বতের পাদদেশে সমবেত হয়। নবী কারীম (সা.) এক হাজার সাহাবী নিয়ে মদীনা থেকে বের হন। তবে মাঝপথে ৩০০ জন মুনাফিক সরে দাঁড়ায়। ফলে অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়।

প্রথমে মুসলমানরা বিজয়ী হয়। কিন্তু উহুদের এক গিরিপথে অবস্থানরত তীরন্দাজদের একটি অংশ নবী কারীম (সা.)এর নির্দেশ অমান্য করে স্থান ত্যাগ করে। শত্রুরা সুযোগ নিয়ে পশ্চাৎদিক থেকে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। সত্তর জন সাহাবী শাহাদাত লাভ করেন, যাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন হযরত হামযা (রাযি.)। নবী কারীম (সা.)এর চেহারা মুবারক রক্তাক্ত হয়, সামনের দাঁত ভেঙে যায়।

পরদিন তিনি সাহাবীদের নিয়ে শত্রুর পিছু ধাওয়া করে হামরাউল আসাদ পর্যন্ত যান; কিন্তু শত্রুরা পালিয়ে যায়। এ বছরই মদ্যপান স্থায়ী হারাম হওয়ার আয়াত নাযিল হয়।

৪র্থ হিজরী:

এই বছরে গাযওয়া বনু নযীর সংঘটিত হয়। নবী কারীম (সা.) তাদের অবরুদ্ধ করেন এবং শেষে নির্বাসিত করেন।
এরপর গাযওয়া যাতুর রিকাআ হয়। সেখানে “সালাতুল খাওফ” (ভয়ের নামায) এবং “তায়াম্মুম”-এর হুকুম নাযিল হয়।

পরে গাযওয়া উহুদ সুগরা সংঘটিত হয়। কুরাইশরা উহুদের যুদ্ধ শেষে ঘোষণা দিয়েছিল- “আগামী বছর আমরা আবার এই স্থানে যুদ্ধ করব”। নবী কারীম (সা.) প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাহিনী নিয়ে উহুদে বের হন, কিন্তু কুরাইশরা উপস্থিত হয়নি।

৫ম হিজরী:

এই বছরে গাযওয়া দৌমাতুল জান্দাল সংঘটিত হয়; শত্রুরা তাদের পশুপাল রেখে পালিয়ে যায়। এরপর হয় গাযওয়া বনু মুসত্বালিক। এই যুদ্ধে গোত্রটির দশজন নিহত হয়, বাকিরা বন্দী হয়। বন্দীদের মধ্যে ছিল গোত্রপ্রধান হারিসের কন্যা হযরত জুওয়াইরিয়া (রাযি.)। নবী কারীম (সা.) তাঁকে মুক্ত করে বিবাহ করেন। এই বিবাহের সুবাদে গোত্রের সব বন্দী মুক্ত হয় এবং বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন।

এ বছরই সংঘটিত হয় গাযওয়া আহযাব (খন্দকের যুদ্ধ)। কুরাইশরা আরবের বহু গোত্র ও ইহুদিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা অবরোধ করে। মুসলমানরা প্রতিরক্ষায় দীর্ঘ একটি খন্দক খনন করে। পনেরো দিন অবরোধ চলতে থাকে। অবশেষে আল্লাহ তাআলা ঝড়ো বাতাস ও ফেরেশতাদের সৈন্য প্রেরণ করে শত্রুদের ব্যর্থ করে দেন।

এরপর হয় গাযওয়া বনু কুরাইযা। অঙ্গীকার ভঙ্গের অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একই বছরে হজ্জ ফরয হয় এবং নারীদের জন্য পর্দার আয়াত নাযিল হয়।

৬ষ্ঠ হিজরী:

এই বছরে গাযওয়া বনু লিহইয়ান, গাযওয়া গাবাহ এবং হুদায়বিয়ার সন্ধি সংঘটিত হয়। নবী কারীম (সা.) ১৪০০ সাহাবীকে নিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় উমরার নিয়তে মক্কার উদ্দেশে রওনা হন। কুরাইশরা হুদায়বিয়ায় এসে বাধা দেয়। দীর্ঘ আলোচনার পর একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়, যাতে অন্যতম শর্ত ছিল- দশ বছর পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হবে না।

এ সময়েই রাসূল (সা.) সাহাবীদের সঙ্গে বাইআতে রিজওয়ান করেন। একই বছরে তিনি বিভিন্ন রাজা ও সম্রাটের কাছে ইসলামের দাওয়াতি চিঠি পাঠান। এদের মধ্যে কয়েকজন ইসলাম গ্রহণ করে।

৭ম হিজরী:

হুদায়বিয়া থেকে ফেরার পর মুসলমানরা খাইবার জয় করেন। হাবশায় অবস্থানরত মুহাজির সাহাবীরাও ফিরে আসেন। ফাদাক কোনো যুদ্ধ ছাড়াই মুসলমানদের হাতে আসে। এরপর গাযওয়া ওয়াদিল কুরা সংঘটিত হয়। একই বছরে নবী কারীম (সা.) সাহাবিদের নিয়ে “উমরাতুল কাযা” সম্পন্ন করার জন্য মক্কায় প্রবেশ করেন। সেখানে তিন দিন অবস্থান করে ফিরে আসেন।

৮ম হিজরী:

এই বছরে সংঘটিত হয় গাযওয়া মুতা। এতে ধারাবাহিকভাবে মুসলিম বাহিনীর তিনজন সেনাপতি শাহাদাত লাভ করেন- হযরত যায়েদ ইবনে হারিসা (রাযি.), হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রাযি.) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাযি.)। এরপর নবী কারীম (সা.) হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাযি.)কে সেনাপতি নিয়োগ করেন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলমানরা বিজয় অর্জন করেন এবং প্রচুর গনিমতের মাল লাভ করেন।

এ বছরই ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা সংঘটিত হয়- মক্কা বিজয়। কুরাইশরা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করেছিল। নবী কারীম (সা.) দশ হাজার সাহাবীকে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। কুরাইশরা অস্ত্র সমর্পণ করে। রাসূল (সা.) সর্বজনীন নিরাপত্তা ঘোষণা করেন। তিনি কাবাঘরের চারপাশ থেকে সমস্ত মূর্তি ধ্বংস করেন এবং আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে মূর্তিভাঙার জন্য সাহাবিদের প্রেরণ করেন।

মক্কার বিজয় ও রাসূলে কারীম (সা.)

এর শত্রুদের প্রতি আচরণ

কে না জানে, মক্কার তেরো বছরের জীবনে মুশরিকরা নবী করীম (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)এর উপর কী কী অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল! তাঁদের তপ্ত মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল, আগুনের অঙ্গারের উপর নিপতিত করা হয়েছিল, ঘরবাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছিল, এমনকি তাঁদেরকে শহীদও করা হয়েছিল। স্বয়ং রাসূলে আকরাম (সা.)কেও নানাভাবে কষ্ট দেওয়া হয়েছে- পথে কাঁটা বিছানো হয়েছে, সিজদার সময় উটের নাড়িভুঁড়ি তাঁর পবিত্র মাথার উপর নিক্ষেপ করা হয়েছে; এমনকি তাঁকে হত্যার নোংরা ষড়যন্ত্রও রচিত হয়েছিল। হিজরতের পর যখন নবী কারীম (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম মদীনায় পৌঁছালেন, তখনও তাদের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত চালানো হলো, যার পরিণতিতে সংঘটিত হলো বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ।

কিন্তু আজ মক্কা বিজিত হয়েছে। নবী কারীম (সা.) একজন বিজেতার মর্যাদায় নগরীতে প্রবেশ করলেন; কিন্তু দুনিয়ার যালিম সম্রাটদের মতো অহঙ্কারী ভঙ্গিতে নয়, বরং গভীর বিনয় ও নম্রতার সাথে- মাথা নত, হৃদয় পরিপূর্ণ কৃতজ্ঞতায় রঙিন- হাজারো আনসার-মুহাজির সহচরের সাথে মহান রবের শুকরিয়া আদায় করতে করতে। তিনি বাইতুল্লাহকে মূর্তিমুক্ত করলেন এবং তার তাওয়াফ সম্পন্ন করলেন। এ সময় বিরাট জনসমাগম হলো। কুরাইশরা তাঁর সামনে এসে বসলো, আর তাঁদের হৃদয়-মস্তিষ্কে ভেসে উঠলো অতীতের সব অপরাধ- যা তাঁরা নবী কারীম (সা.) ও তাঁর সাহাবাদের সাথে করেছিল। আজ তারা সবাই অপরাধীর আসনে নতশিরে বসে আছে।

আরও পড়তে পারেন-

আজ যদি তাঁর স্থানে দুনিয়ার অন্য কোনো বিজেতা সম্রাট হতেন, তবে শত্রুদের সাথে আচরণ করতেন ইতিহাসের স্বৈরশাসকদের মতোই- রক্ত ও প্রতিহিংসার উল্লাসে। কিন্তু তিনি তো আল্লাহর রাসূল (সা.), তিনি তো রহমাতুল্লিল আলামিন। তিনি তো নৈতিকতার সেই উচ্চচূড়ায় অধিষ্ঠিত, যার প্রশংসা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা করেছেন- وَاِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیْمٍ অর্থ: “আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত”। (সূরা আল কলম- ৪ আয়াত)।

নবী কারীম (সা.) তাঁদের উদ্দেশে বললেন- “তোমাদের কী ধারণা, আজ আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে যাচ্ছি?”

তারা একবাক্যে জবাব দিল- “أخٌ کریمٌ وابنُ أخٍ کریمٍ”- আপনি একজন মহৎ ভাই এবং মহৎ ভাইয়ের সন্তান। আমরা আপনার কাছ থেকে সেই উদার ব্যবহারেরই প্রত্যাশা করি, যা একজন মহৎ ব্যক্তির কাছ থেকে করা হয়”। তখন নবী কারীম (সা.) তাঁদেরকে সেই একই কথা শুনালেন, যা একসময় হযরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ভ্রাতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন- لَا تَثْرِیْبَ عَلَیْکُمُ الْیَوْمَ ۚ یَغْفِرُ اللّٰہُ لَکُمْ ۚ وَهُوَ أَرْحَمُ الرّٰحِمِیْنَ অর্থ: “আজ তোমাদের প্রতি কোনো ভর্ৎসনা নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন; আর তিনি তো সর্বাধিক দয়াশীল”। (সূরা ইউসুফ- ৯২)। অর্থাৎ শুধু শাস্তি থেকে মুক্তি নয়, আমি আজ তোমাদের অপরাধগুলোও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি না, যাতে তিরস্কারের ক্ষত সৃষ্টি হয়। এরপর তিনি ঘোষণা করলেন- “اِذْهَبُوا فَأَنْتُمُ الطُّلَقَاءُ”- “যাও, তোমরা সকলে মুক্ত”।

আজ রহমত ও ক্ষমার দিন। যে আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে, সে নিরাপদ; যে নিজের ঘরের দুয়ার বন্ধ করবে, সে নিরাপদ; আর যে মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে, সে-ও নিরাপদ।

এ মহৎ চরিত্রেরই ফল হলো যে, তাঁদের অধিকাংশ ইসলাম গ্রহণ করলো, অন্তর-প্রাণ দিয়ে নবী করীম (সা.)কে ভালোবাসলো, আর শত্রু থেকে পরিণত হলো প্রকৃত বন্ধুতে।

রাসূলে আকরাম (সা.) কেবল কথায় উম্মতকে মহান চরিত্রের শিক্ষা দেননি, বরং তাঁর নিজের জীবনের প্রতিটি কর্মে সে চরিত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাঁর নৈতিক শিক্ষা তাঁর জীবনে দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট- যার অনুরূপ উদাহরণ মানবসভ্যতার ইতিহাসে নেই।

হুনাইন যুদ্ধ

মক্কা বিজয়ের পরপরই সংঘটিত হলো, হুনাইন যুদ্ধ। সাকিফ ও হাওয়াযিন গোত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। খবর পৌঁছাল নবী কারীম (সা.)এর কাছে। তিনি বারো হাজার সহচরকে নিয়ে তাদের মোকাবেলায় বের হলেন। কিছু মুসলমানের মনে এ ধারণা জন্মালো- এমন বিরাট বাহিনীকে পরাজিত করাইবা সম্ভব কীভাবে? কিন্তু শত্রুপক্ষ হঠাৎ তীরের ঝড় তুললো, মুসলমানদের পা দুলে গেল। তখন নবী করীম (সা.) অল্প কয়েকজন সাহাবীকে সাথে নিয়ে অটল থাকলেন। পরে মুসলমানরা পুনর্গঠিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো, শত্রু চূড়ান্তভাবে পরাজিত হলো। কেউ নিহত হলো, কেউ পালিয়ে গেল। তাদের নারী-শিশুরা বন্দি হলো, বিপুল সংখ্যক গবাদি পশু মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে এলো। যারা পালাতে সক্ষম হলো, তারা তায়েফে গিয়ে দুর্গবন্দী হলো। নবী কারীম (সা.) ঊনিশ দিন তায়েফ অবরোধ করলেন, পরে ফিরে এলেন জিরআনা হতে। হুনাইনের বন্দিদের সেখানেই রাখা হয়েছিল। এ সময়ে হাওয়াযিন গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে হুযূরে আকরাম (সা.)এর কাছে উপস্থিত হলো। তিনি তাঁদের বন্দিদের মুক্তি দিলেন। তারপর জিরআনাহ থেকে উমরার ইহরাম বেঁধে রাতে উমরা আদায় করে মদীনায় ফিরে গেলেন।

৯ম হিজরী

এ বছর সংঘটিত হলো তাবুকের যুদ্ধ। নবী কারীম (সা.)এর কাছে খবর এলো যে, রোমানরা প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি ত্রিশ হাজারের বাহিনী নিয়ে রোমের সীমান্তে অবস্থিত তাবুক পর্যন্ত পৌঁছালেন। কিন্তু রোমানরা মোকাবেলায় আসলো না। ওই অঞ্চলের আইলা নগরীর শাসকসহ অনেক গোত্র জিজিয়ার শর্তে সন্ধি করলো। এ বছরই হযরত আবু বকর (রাযি.)কে “আমীরুল হজ্জ” নিযুক্ত করা হলো। ঈদুল আযহার দিন ঘোষণা করা হলো- ভবিষ্যতে কোনো মুশরিক হজ্জ করতে পারবে না এবং কেউ উলঙ্গ হয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করতে পারবে না। একই বছরে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিদল এসে নবী কারীম (সা.)এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো। মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীন ইসলামে প্রবেশ করলো।

১০ম হিজরী

এই বছরে হযরত আলী (রাযি.)এর নেতৃত্বে একদল সেনা বনি মাযহিজ গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। সেখানে বিশজন নিহত হয়, বাকি সকলে ইসলাম গ্রহণ করে। এ বছরই হযরত মুআয ইবনে জাবাল ও আবু মূসা আশআরী (রাযি)কে শিক্ষা ও দাওয়াতের দায়িত্বে ইয়েমেনে পাঠানো হলো।

এ বছরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল নবী কারীম (সা.)এর শেষ হজ্জ- যা ইতিহাসে হজ্জাতুল বিদা, হজ্জাতুল বালাগ, হজ্জাতুল কামাল, হজ্জাতুত তামাম এবং হজ্জাতুল ইসলাম নামে খ্যাত। এ হজ্জে তিনি আরাফা ও মিনার প্রান্তরে প্রদত্ত খুতবায় দ্বীন ইসলামের মৌলিক নীতিমালা সুস্পষ্টভাবে শিক্ষা দিয়েছিলেন।

দ্বীন ইসলামের মৌলিক নীতির শিক্ষা

রাসূলে আকরাম (সা.)এর জীবন শুধু একজন সাধারণ মানুষের জন্য নয়, শাসক, বিচারক এবং সেনাপতি- সবার জন্যই এক পরিপূর্ণ আদর্শ।

শাসক ও রাষ্ট্রনায়কের জন্য আদর্শ

তিনি একজন ন্যায়নিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর শাসন ছিল ন্যায়, দয়া ও কল্যাণে পরিপূর্ণ, যা ইতিহাসে অনন্য। অতএব, একজন মুসলিম শাসকের জন্য তাঁর জীবনই সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত।

বিচারক ও আইনপ্রণেতার জন্য আদর্শ

তিনি কেবল রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না, বরং ছিলেন একজন সুবিচারক ও নিরপেক্ষ কাজী। তিনি এমন সব নীতি নির্ধারণ করেছিলেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত মানবসভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। তিনি ঘোষণা করেছিলেন- “আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মদ (সা.)এর কন্যা ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদও চুরি করতো, তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম।”

আরেক হাদিসে তিনি বলেন- “যদি মানুষের কাছে কেবল তাদের দাবি অনুযায়ী রায় দেওয়া হতো, তবে যে কেউ কারো রক্ত আর সম্পত্তির দাবি করতে শুরু করতো। কিন্তু দাবি প্রমাণের দায়িত্ব বাদীর উপর, আর আসামির উপর শপথের দায়িত্ব”।

সেনানায়ক ও যোদ্ধার জন্য আদর্শ

নবী কারীম (সা.)এর জীবন এক সেনাপতি ও বীর যোদ্ধার জন্যও সর্বোত্তম অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কারণ, তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল এক সামরিক নেতার দূরদৃষ্টি, সাহস ও সহযোদ্ধা সেনাদের প্রতি অপরিসীম মমতা।

নবী কারীম (সা.)এর বীরত্ব ও সাহস

নবী কারীম (সা.)এর সাহস ও বীরত্বের এমন দৃষ্টান্ত মিলবে যে, হুনাইন যুদ্ধে শত্রুদের তীরের ঝড় শুরু হতেই অনেক মুসলমান পিছু হটতে চাইলো। কিন্তু নবী কারীম (সা.) নিজের নিবেদিত সাহাবীদের সঙ্গে পিছিয়ে না গিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন- أَنَا النَّبِيُّ لَا كَذِبْ، أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ অর্থ- “আমি সত্যনিষ্ঠ নবী, আমি আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র”।

একবার মদিনাবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল যে, কোনো শত্রু আক্রমণ করতে যাচ্ছে। তারা দৌড়ে বেরিয়ে পরিস্থিতি পরীক্ষা করছিল। তখন তারা দেখলো নবী কারীম (সা.) একাই, এক ঘোড়ার পিঠে চড়ে শান্তভাবে ফিরে আসছেন এবং বললেন: “ভয় পেও না, আমি সবকিছু দেখেছি, কোনো বিপদ নেই”।

নবী কারীম (সা.) চাইতেন যে তাঁর উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তি হোক এক শক্তিশালী, সাহসী মুমিন। তিনি নিজে এটা স্পষ্টভাবে বলেছেন- “এক শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর কাছে অধিক মূল্যবান এবং প্রিয়, দুর্বল মুমিনের তুলনায়। উভয়েই উত্তম, তবে শক্তিশালী মুমিন শ্রেষ্ঠ”।

পরামর্শের সুন্নাত

তিনি যুদ্ধে অভিজ্ঞ সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং তা মানতেন, যেমন বদর ও খন্দকের যুদ্ধের ঘটনা প্রমাণ করে।

নবী কারীম (সা.)এর দয়া ও ন্যায়বিচার

এই সাহসী নেতৃত্বের পাশাপাশি তাঁর দয়া ও ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্তও অসাধারণ। যখন কোনো বাহিনী প্রেরণ করতেন, তখন স্পষ্ট নির্দেশ দিতেন যে- নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও ইবাদতে ব্যস্ত মানুষদের উপর কখনও আক্রমণ করা যাবে না।

ধৈর্য ও সহনশীলতা

ধৈর্য ও সহনশীলতায় তিনি সবাইকে পথ প্রদর্শন করেছেন। এক আরব চাঁদা চাচ্ছিল এবং তাঁর চাদর শক্তভাবে টেনে ধরে বলছিল: “আমাকে আল্লাহর সম্পদ থেকে কিছু দাও।” নবী কারীম (সা.) হাসলেন এবং নির্দেশ দিলেন- যথাযথ পরিমাণে দেওয়া হলো।

অটল সত্যনিষ্ঠা

নবী কারীম (সা.)এর ধৈর্য ও স্থিরতা এমনকি ইতিহাসে তুলনাহীন। শত্রুরা তাঁকে প্রলোভন দেখিয়েছিল- ধন-সম্পদ, সুন্দরী নারী এবং দুনিয়াবী জৌলুসের- যাতে তিনি তাঁর দাওয়াত পরিত্যাগ করেন। কিন্তু একটি প্রলোভনও তাঁকে প্রভাবিত করতে পারলো না। তিনি বললেন- “আল্লাহর কসম! যদি তারা সূর্যকে আমার ডান হাতে এবং চাঁদকে বাম হাতে রাখে, যাতে আমি দাওয়াত ত্যাগ করি, তবুও আমি তা ছাড়ব না; যতক্ষণ না আল্লাহ বিজয়ী করেন অথবা আমার মৃত্যু ঘটান”।

ক্ষমা ও উদারতা

ক্ষমা ও উদারতায়ও তাঁর তুলনা নেই। মক্কার বিজয় উদাহরণ হতে পারে। তিনি নিজে বলেছেন- “যার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন, তার সঙ্গে পুনর্মিলন কর; যে কিছু না দেয়, তাকে দাও; যে অত্যাচার করে, তাকে মাফ কর; যে খারাপ আচরণ করে, তার সঙ্গে ভালো আচরণ কর”।

দানশীলতা

উপকার ও দানশীলতায়ও নবী কারীম (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ। সাহাবাগণ বলেন- “রাসূলুল্লাহ (সা.) সবচেয়ে উদার ছিলেন, বিশেষ করে রমযান মাসে আপনার দান ও উদারতার সমুদ্রই যেন ঢেউ খেলত”।

মহান চরিত্র ও উচ্চ নৈতিকতা

নবী কারীম (সা.)এর নৈতিকতা এমন উচ্চ স্তরের ছিল যে, আল্লাহ তাআলা নিজে তাঁর এই গুণাবলিকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন- “আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত”।

শ্রেষ্ঠ স্বামী, স্নেহশীল পিতা ও বিশ্বস্ত বন্ধু

নবী কারীম (সা.) একজন আদর্শ স্বামী, দয়ালু পিতা এবং বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন। তাঁর জীবনই সকল মুসলমানকে দেখিয়েছে যে, একজন স্বামীর কেমন হওয়া উচিত, একজন পিতার কেমন হওয়া উচিত এবং একজন সত্যিকারের বন্ধুর কেমন হওয়া উচিত।

সফল শিক্ষক ও মহান শিক্ষানুরাগী

নবী কারীম (সা.)এর আরেকটি বিশেষ গুণ হলো একজন পরিপূর্ণ শিক্ষক ও উস্তাদ হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন। তিনি শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদর্শ স্থাপন করেছেন। এই কারণেই যাঁরা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত এবং নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে দায়িত্বশীল, তাঁদের জন্য নবী কারীম (সা.)এর জীবন অনুকরণীয়।

১১তম হিজরী:

নবী কারীম (সা.)এর বিদায়

১১ হিজরিতে নবী কারীম (সা.) উসামা (রাযি.)এর নেতৃত্বে রোমানদের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন। তবে বাহিনী প্রেরণের আগে তাঁর শরীর অসুস্থ হয়ে পড়লো। এ সময় নবী কারীম (সা.) হযরত আয়েশা (রাযি.)এর ঘরে অবস্থান করলেন। নামাযের ইমামতি করার দায়িত্ব হযরত আবু বকর (রাযি.)কে দেওয়া হলো।

শনিবার, ১২ রবিউল আউয়াল, ৬৩ বছর বয়সে নবী কারীম (সা.) ইহলোক ত্যাগ করলেন। তিনি তখন আল্লাহর বার্তা সম্পূর্ণরূপে পৌঁছে দিয়েছেন এবং দাওয়াত ও হিদায়াতের দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেছেন। বুধবার রাতে তাঁকে গোসল দেওয়া হলো, তিনটি কাপড়ে কাফন দেওয়া হলো এবং মুসলমানরা শোকাহত হৃদয়ে পদে পদে জানাযার নামায আদায় করলো। হযরত আয়েশা (রাযি.)এর ঘরই তাঁর শেষ বিশ্রামের স্থান হলো।

সন্তানরা

নবী কারীম (সা.)এর তিন পুত্র ছিলেন: কাসেম, আবদুল্লাহ এবং ইব্রাহীম; সকলেই শৈশবেই পৃথিবী ত্যাগ করেন।

চার কন্যা ছিলেন: যয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম এবং ফাতিমা যাহরা।

স্ত্রীগণ

হযরত খাদিজাতুল কুবরা, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা, হাফসা, উম্মে সালমা, সাওদা, যয়নাব বিনতে জাহাশ, মাইমুনাহ, যায়নাব বিনতে খুজাইমা, জুওয়াইরা, সাফিয়া, উম্মে হাবীবা (রাযি.)।

হযরত খাদিজাতুল কুবরা এবং যায়নাব বিনতে খুজাইমা (রাযি.)এর মৃত্যু নবী কারীম (সা.)এর জীবদ্দশায় ঘটে। বাকি ৯ জন স্ত্রী নবী কারীম (সা.)এর ইন্তিকালের সময় উপস্থিত ছিলেন।

সৌন্দর্য ও চেহারা

নবী কারীম (সা.)এর সৌন্দর্য এবং চেহারার বর্ণনা লিখিত শব্দের পক্ষে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তবে হযরত হাসান ইবনে সাবিত-এর দুইটি ছড়া উপমা হিসেবে দেওয়া হলো-

وَأحْسَنَ مِنْکَ لَمْ تَرَقَطُّ عَیْنِيْ
                وَأجْمَلَ مِنْکَ لَمْ تَلِدِ النِّسَاء
خُلِقْتَ مُبَرَّئًا مِنْ کُلِّ عَیْبٍ
                کَأنَّکَ قَدْ خُلِقْتَ کَمَا تَشَاء

অর্থ- আপনার চেয়ে সুন্দর কোনোদিন দেখেনি আমার এই চোখ,
আপনার চেয়ে সুদর্শন কোনো মা জন্ম দেয়নি কোনো শিশুকে।
আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবরকম দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত করে,
যেন আপনি যেমন চেয়েছেন, ঠিক তেমন করেই আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

লেখক: প্রখ্যাত আলেম ও মুহতামিম, জামিয়াতুল উলূম আল-ইসলামিয়াহ আল্লামা বানূরি টাউন, করাচি, পাকিস্তান।

অনুবাদ: মাওলানা মুনির আহমদ

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।