Home স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা স্মার্টফোনের অধিক ব্যবহারে বাড়ছে চোখের রোগ, বড় হচ্ছে চশমার বাজার

স্মার্টফোনের অধিক ব্যবহারে বাড়ছে চোখের রোগ, বড় হচ্ছে চশমার বাজার

দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনে থাকা, ডায়াবেটিস, হাইপারটেশনসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার কারণে সব বয়সী মানুষের চোখের রোগ বাড়ছে। চোখের রোগ বৃদ্ধির কারণে চশমার ব্যবহার বাড়ছে, ফলে বড় হচ্ছে চশমার বাজার।  

ইস্পাহানী আই ইনস্টিটিউট এন্ড হসপিটালের কনসালট্যান্ট রেটিনা সার্জন এবং ইউভিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. মমিনুল ইসলাম বাঁধন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘মোবাইল ফোন ব্যবহার করার কারণে চোখে মাইনাস পাওয়ার ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন সবুজে যাচ্ছে না, অধিক সময় ঘরে থাকছে। যে বয়সে শিশুদের দৃষ্টি তৈরি হয় সে বয়সে তারা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকায় দৃষ্টি তৈরি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। চোখের সমস্যা বাড়ার একটি বড় ফ্যাক্টর এটি। এছাড়া এখন অল্প বয়সে মানুষের ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশনের কারণে চোখের রোগ বাড়ছে’। 

কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে স্কুল, বাইরে যাওয়া, খেলাধুলাও বন্ধ থাকায় শিশুদের মধ্যে ডিভাইস আসক্তি অনেক বেড়ে গেছে। খেলা, অনলাইন ক্লাস সবকিছুতেই শিশুদের ডিভাইসের ব্যবহার বেড়েছে। এতে করে ‘ড্রাই আই’ থেকে শুরু করে রেটিনার কার্যকারিতা কমে যাওয়া ও মাইনাস পাওয়ার বেড়ে যাওয়াসহ শিশুদের বিভিন্ন ধরণের চোখের রোগ বাড়ছে। 

মমিনুল ইসলাম বাঁধন বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে শিশুদের চশমা পরার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। করোনার কারণে শিশুরা বাসা থেকে বের হতে পারছেনা তাই সারাদিন মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অনলাইন ক্লাস। সে কারণে এখন মাইনাস পাওয়ারের চশমার ব্যবহার বাড়ছে, যাদের আগে থেকেই মাইনাস পাওয়ার ছিলো তাদের চশমার পাওয়ার আরো বেড়েছে। পাশাপাশি আমাদের অনেক রোগী মাথা ব্যথা, চোখে ব্যথার অভিযোগ করছে’।   

আরও পড়তে পারেন-

ভিশন চক্ষু হাসপাতালের  গ্লুকোমা বিশেষজ্ঞ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. সিদ্দিকুর রহমান টিবিএসকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে রোগীরা দীর্ঘদিন চিকিৎসা সেবা থেকে দূরে থাকায় এখন হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় বাড়ছে’। 

বড় হচ্ছে চশমার বাজার

১৯৪৮ সালে ঢাকার পাটুয়াটুলিতে ‘কামাল অপটিকস’ নামে প্রথম একটি চশমার দোকান স্থাপিত হয়। এখন এই পাটুয়াটুলিতেই ৫ শতাধিক পাইকারি চশমার দোকান। মানুষের চোখের সমস্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সানগ্লাসের চাহিদা বাড়ায় সারাদেশে চশমা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। দেশে প্রতিবছর চশমার বিক্রি ১০ শতাংশের বেশি হারে বাড়ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ চশমা শিল্প ও বণিক সমিতি।

দোকানের পাশাপাশি ভ্রাম্যমান চশমা বিক্রেতাসহ এ খাতে এখন প্রত্যক্ত ও পরোক্ষভাবে এক লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। 

বাংলাদেশ চশমা শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি সানাউল্লাহ খান বলেন, ‘সমিতির নিবন্ধিত সদস্য রয়েছে আড়াইশ। অথচ সারা দেশে প্রায় পাঁচ হাজার চশমা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অন্যদিকে চশমার কাঠামো আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি’।

পুরোটাই বিদেশনির্ভর 

দেশের বাজারে যত ধরনের চশমা ও এর অনুষঙ্গ বিক্রি হয় তার প্রায় শতভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করা। ঢাকার মিরপুরে ‘স্মৃতি অপটিকস’ নামে একটি কোম্পানি মেটাল চশমা উৎপাদন করে। তবে এর উপকরণও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় কোম্পানিটিকে। দেশে প্লাস্টিক চশমার কয়েকটি কারখানা থাকলেও তাদের উৎপাদন মোট চাহিদার ২ শতাংশের কম।  

পাটুয়াটুলির পাইকারি চশমা বিক্রেতা ‘মডার্ন অপটিকস’ এর স্বত্বাধিকারী আবছার উদ্দিন বলেন, ‘চীনের ব্যবসায়ীদের আপনি যত কম টাকায় চশমা বানিয়ে দিতে বলবেন, ওরা তত কম দামে বানিয়ে দিতে পারবে। ওরা দশ টাকায়ও ফ্রেমসহ একটি চশমা বানিয়ে দিতে পারবে। তাছাড়া এ পণ্যটির আমদানিও খুব সহজ। তাই যুগ যুগ ধরে আমদানি নির্ভর থাকছে চশমার বাজার’।  

চশমাশিল্পের ব্যবসায়ীরা জানান, চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম, রিডিং ফ্রেম, গ্লাস, স্ক্রু সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু কাঁচামালের ওপর বাড়তি শুল্ক থাকায় দেশে চশমা তৈরির খরচ বেশি পড়ে যায়। দেশে আমদানি করা চশমার ৯০ শতাংশই চীন থেকে আসে। তা ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, থাইল্যান্ড থেকেও চশমা আমদানি করা হয়।

অনিয়ন্ত্রিত আমদানি ও দাম

দেশে চশমার বিশাল বাজার গড়ে উঠলেও এর বড় অংশই আসে অবৈধ পথে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অবৈধ পথে বা বেশি দামের চশমাকে কম দাম দেখিয়ে আমদানি করা হয়। ২০১৮ সালে রাজধানীর চকবাজার, জিঞ্জিরা, পাটুয়াটুলী এলাকার প্রায় ৪০ জন অবৈধভাবে চশমা আমদানিকারককে সনাক্ত করেছিল এনবিআর।

এনবিআরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দেশে ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০০ টাকা পর্যন্ত দামের চশমা ও ফ্রেম বিক্রি হলেও অধিকাংশ চশমা আমদানি হয় ১০-১৫ টাকায়।

বাংলাদেশ চশমা শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল হক শিকদার দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, ‘১০-১৫ টাকা দেখিয়ে বেশি দামের চশমা নিয়ে আসেন কিছু ব্যবসায়ী। চশমা আমদানিতে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে শুল্কায়ন করতে হয়। কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তারা তা ঠিকমতো করছেন না’। 

চশমার অবৈধ বাজারের প্রমাণ পাওয়া যায় এ খাত থেকে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ চিত্রেও। ২০১৮ সালে কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সনাক্তকরণের মাধ্যমে ভ্যাট আহরণ শুরু করার পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে চশমা খাত থেকে মাত্র ১০৩ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অথচ এর আগের বছর এ খাত থেকে মাত্র ১৫ কোটি টাকা পেয়েছিল এনবিআর। 

চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এ খাত থেকে শুধু ভ্যাট বাবদই ৫৪ কোটি টাকা পেয়েছে সংস্থাটি। চশমার লেন্স ভ্যাটমুক্ত তবে ফ্রেম ও সাধারণ গ্লাসে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানিকারকরা এলসিতে চশমার নামমাত্র দাম উল্লেখ করে। কম দামে চশমা এনে বেশি দামে বিক্রি করে। আবার অধিকাংশ বিক্রেতাই নিবন্ধনহীন। ফলে এ খাতে প্রকৃতপক্ষে কত টাকা বিক্রি হয় বের করা সম্ভব হচ্ছে না।  

চোখের চিকিৎসায় ও চিকিৎসক তৈরিতে গড়ে উঠছে ইনস্টিটিউট 

চোখের সমস্যা বাড়ার কারণে চোখের হাসপাতালের পাশাপাশি চিকিৎসক তৈরির জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রভৃতিতে রোগীদের স্বল্পমূল্যে সেবা দেয়ার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করা হচ্ছে।

অফথ্যালমলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের তথ্য অনুসারে, দেশে স্পেশালাইজড ডাক্তার আছেন ১৩০০ জন। রেটিনা, গ্লুকোমাসহ  সাব-স্পেশালাইজড বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন প্রায় ১০০ জন। তবে দেশে চাহিদার তুলনায় চক্ষু বিশেষজ্ঞ যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন ডা. সিদ্দিকুর রহমান। 

তিনি বলেন, ‘এখন মাত্র ১৩০০ জন চোখের চিকিৎসক রয়েছেন। দেশের জনসংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যা আরো কয়েক হাজার হওয়া প্রয়োজন’।

সব উপজেলায় হবে কমিউনিটি ভিশন সেন্টার

চোখের চিকিৎসায় দেশের সব উপজেলায় পর্যায়ক্রমে কমিউনিটি ভিশন সেন্টার গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১১ই মার্চ প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে পাঁচ বিভাগের আওতাধীন ২০ জেলার ৭০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপিত ‘কমিউনিটি ভিশন সেন্টার’ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকার কমিউনিটি ভিশন সেন্টারের মাধ্যমে সারা দেশের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ চক্ষু চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে সকল উপজেলায় এই সেন্টার স্থাপন করবে। আধুনিকায়নের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে সরকার। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি উপজেলায় এই সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা আমরা পর্যায়ক্রমে করে দেব। ইতোমধ্যে আরো ১১০টি ভিশন কমিউনিটি সেন্টার স্থাপনের বিষয়ে চিন্তা করছি এবং সে পদক্ষেপ নিচ্ছি। এর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন’।  সূত্র- টিবিএস।

প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন- আব্বাস উদ্দীন নয়ন ও তাওছিয়া তাজমীম

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।