Home ইসলাম মাহে রমযানের ফযীলত, বিধি-বিধান ও পূর্ণাঙ্গ মাসআলা

মাহে রমযানের ফযীলত, বিধি-বিধান ও পূর্ণাঙ্গ মাসআলা

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

‘রমযান’ শব্দটি ‘রমযুন’ মূলধাতু হতে নির্গত। রমযুন অর্থ ‘দহন’ ‘জ্বলন’। রোযা রাখার কারণে ক্ষুধার তীব্রতায় রোযাদারের পেট জ্বলতে থাকে। আর এ অবস্থা বুঝানোর জন্যে আরবী ভাষায় বলা হয়, ‘আস-সায়েমু ইয়ারমুযু’, অর্থাৎ- রোযাদার দগ্ধ হয়। এ শব্দ থেকেই গঠিত হয় ‘আর-রামাযাউ’ তথা উত্তাপের তীব্রতা। সুতরাং ‘রমযান’ অর্থ- দহন ও তীব্রতা। এ অর্থের দিক থেকে রমযান হল, অব্যাহত তীব্র দহনের সমষ্টি। (আল-জামে লি-আবী আব্দিল্লাহ শামসুদ্দীন আল কুরতুবী- ২/১৯৫)।

আল্লামা শামসুল আইম্মা সারাখসী (রাহ.) রোযার পরিচয় এভাবে উল্লেখ করেন- ‘রোযার নিয়তে মুসলিম সুস্থ ব্যক্তি এবং হায়েয-নিফাসমুক্ত মহিলার সুবহে সাদিক থেকে সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত থাকাকে রোযা বলা হয়’। (মাবসূতে সারাখসী- ৩/৫৪)।

এ সংজ্ঞার সারসংক্ষেপ হলো, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনটি কাজ থেকে বিরত থাকা- ক. আহার করা। খ. পান করা। গ. সহবাস করা।

মাহে রমযানকে ‘রমযান’ হিসেবে নামকরণের কারণ হল, রমযান মাসের নেক আমল সমস্ত গুনাহকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়। কারো মতে, এ মাসে মানুষের মন ওয়াজ-নসীহত ও পরকালের চিন্তার কারণে বিশেষভাবে উত্তাপ গ্রহণ করে থাকে। যেমন সূর্যতাপে বালুকারাশি ও প্রস্তরসমূহ উত্তপ্ত হয়ে থাকে। (আল-জামে লি-আবী আব্দিল্লাহ শামসুদ্দীন আল কুরতুবী- ২/১৯৫)।

এ তাৎপর্যপূর্ণ মাস সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন- “শাহরুন মুবারাকুন” অর্থাৎ- রমযান অত্যন্ত বরকতপূর্ণ একটি মাস। বরকত শব্দের অর্থ আধিক্য ও প্রাচুর্য। এ মাসে আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দার প্রতি অশেষ কল্যাণ ও বিশেষ রহমত অবতীর্ণ করেন। মানুষ যাতে কষ্টকে স্বীকার করে আল্লাহর ইবাদতের দিকে ধাবিত হয়। কারণ, রমযান মাসে ক্ষুধা-পিপাসার কষ্ট ভোগ করা খুবই কঠিন কাজ। রমযানের রোযার মতো অন্য কোনো ইবাদতে এত কষ্ট করতে হয় না। এ জন্যেই আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাওয়াব এ ইবাদতে অনেক বেশি। তাই তো আল্লাহ তাআলা বলেন- রোযাদারের প্রতিদান আমি আল্লাহ নিজ হাতে দান করব।

রোযার উদ্দেশ্য

বিষপানে যেমন বাহ্যিক জীবনের অবসান হয়, পাপানুষ্ঠানেও তেমনি মানবতার মৃত্যু ঘটে। বছরের একমাস পানাহার ও স্ত্রী সহবাস হতে বিরত থেকে পাপ-প্রবৃত্তি দমন ও সংযম সাধনাই রোযার উদ্দেশ্য। এ দিকে ইঙ্গিত করেই হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, রোযা রেখেও যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মিথ্যাচার ত্যাগ করে না, তার এই পানাহার পরিত্যাগে বা রোযাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (সহীহ বুখারী, বাবু মান লাম ইয়াদা কাওলায যূও ওয়াল আমালা বিহি ফিস সাওম)। এ রোযার দ্বারা তার যিম্মা থেকে ফরযিয়্যাত আদায় হবে বটে; সে কোনো সাওয়াব পাবে না।

রোযার ফযীলত ও উপকারিতা

রোযা মানুষের দেহ ও আত্মার নানাবিধ উপকার সাধন করে। রোযা দ্বারা মানুষের আত্মার পবিত্রতা ও চিন্তা-শক্তির প্রখরতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আবহমানকাল হতেই মুনি-ঋষিগণকে উপবাস করতে এবং সুফী সাধকদেরকে রোযা রাখতে দেখা যায়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানেও এর বিশেষ উপকারিতা স্বীকৃত হয়েছে। ডা. সলোমন তার স্বাস্থ্যবিধিতে মানবদেহকে ইঞ্জিনের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ইঞ্জিন রক্ষাকল্পে মাঝে মাঝে সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে চুল্লি হতে ছাই ও আঙ্গার সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাশন করা যেমনটা আবশ্যক, উপবাস দ্বারা মাঝে মাঝে ‘পাকস্থলী’ হতে অজীর্ণ খাদ্য নিষ্কাশন করাও তেমনটা দরকার।

রোযার ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এর কয়েকটি নিচে পেশ করা হলো-

হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের নিয়তে রমযানের রোযা রাখে, তার পূর্বের (সগীরা) গুনাহসমূহ মাফ করা হয়। (সহীহ বুখারী, বাবুন, সাওমু রমযানা ইহতিসাবান মিনাল ঈমান)।

হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন- মানব সন্তানের প্রতিটি আমল তার জন্যে, রোযা ব্যতীত। কেননা রোযা আমারই জন্যে এবং আমিই তার প্রতিফল দান করবো (যত ইচ্ছা তত)। রোযা হচ্ছে মানুষের জন্যে (দোযখের আগুন হতে রক্ষার) ঢাল স্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারো রোযার দিন আসে, সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়, সে যেন বলে, আমি একজন রোযাদার। কসম সে সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ! রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার কাছে মেশকের খুশবু থেকেও অধিক সুগন্ধময়। রোযাদারের জন্যে দু’টি আনন্দ রয়েছে। একটি ইফতারের সময় এবং অপরটি বেহেশতে আপন পরওয়ারদিগারের সাক্ষাৎ লাভের সময়। (সহীহ বুখারী, বাবু হাল ইয়াকূলু ইন্নী সাঈমুন; সহীহ মুসলিম, বাবু ফযলিস সাওম)।

হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রাহ.) থেকে বর্ণিত, হযরত সালমান ফারসী (রাযি.) বলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীগণকে সম্বোধন করে শা’বান মাসের শেষ দিন ভাষণ দিলেন যে, হে লোক সকল! মহা পবিত্র ও বরকতপূর্ণ একটি মাস তোমাদের ওপর ছায়া বিস্তার করছে। এ মাসে এমন একটি রাত্রি রয়েছে, যা বরকত ও ফযীলত, মাহাত্ম্য ও মর্যাদা হিসেবে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ মাসে দিনের বেলায় রোযা রাখাকে আল্লাহ তাআলা ফরয করেছেন এবং রাতের বেলায় দাঁড়ানোকে নফল করেছেন। যে ব্যক্তি এ মাসে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় একটি সুন্নাত বা নফল আদায় করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে অন্যান্য সময়ের ফরয ইবাদতের সমান সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করবে, সে অন্যান্য সময়ের সত্তরটি ফরয ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে। এ মাস সবর, ধৈর্য ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাস। আল্লাহ তাআলা সবরের প্রতিদানে জান্নাত দান করবেন। রমযান মাস পরস্পর হৃদ্যতা ও সৌজন্য প্রদর্শনের মাস। এ মাসে মু’মিনের রিযিক প্রশস্ত করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, আল্লাহ তাআলা তার সকল পাপ মাফ করে দিবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি দান করবেন। আর তাকে রোযাদারের সমপরিমাণ সওয়াব দিবেন। কিন্তু রোযাদারের সাওয়াব থেকে সামান্য পরিমাণও হ্রাস করা হবে না।

হযরত সালমান ফারসী (রাযি.) বলেন, আমরা আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মাঝে অনেকেই দরিদ্র, রোযাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। তারা এ সাওয়াব কীভাবে অর্জন করবেন? রাসূলুল্লাহ(সা.) বললেন, যে ব্যক্তি রোযাদারকে একটা খেজুর, সামান্য দুধ কিংবা এক চুমুক সাদা পানি দ্বারাও ইফতার করাবে, তাকেও আল্লাহ তাআলা এ সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে তৃপ্তিসহ ইফতার করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে আমার ‘হাউজে কাওসার’ হতে এমন পানীয় পান করাবেন, ফলে জান্নাতে প্রবেশের আগ পর্যন্ত সে আর পিপাসার্থ হবেন না। রমযান এমন একটি মাস, যার প্রথম ১০ দিন রহমতের বারিধারায় পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় ১০ দিন ক্ষমা ও মার্জনা এবং শেষ ১০ দিন জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভের জন্যে। যে ব্যক্তি রমযান মাসে নিজের অধীনস্ত লোকদের শ্রম-মেহনত হাল্কা করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করবেন। হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ এর রেওয়ায়াতে এও রয়েছে যে, (রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন) চার কাজ রমযান মাসে বেশি বেশি করো। দু’টি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যে এবং দু’টি যা না করে তোমাদের উপায় নেই। আর তা হল-

ক. কালিমায়ে তাইয়্যিবা বেশি বেশি পাঠ করা। খ. ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে পড়া। গ. আল্লাহ তাআলার কাছে জান্নাতের দোয়া করা। ঘ. জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্যে প্রার্থনা করা। (আসসহীহ লি আবী বকর মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে খুযায়মা আন নিশাপুরী, মৃত্যু- ৩১১ হি., পৃষ্ঠা নং- ৩/১৯১, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, বৈরুত, লেবানন)।

আরও পড়তে পারেন-

হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, পবিত্র রমযান উপলক্ষে আমার উম্মতকে পাঁচটি বস্তু (বিশেষভাবে) দেয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী উম্মতকে দেয়া হয়নি। যথা- ক. রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার কাছে মৃগনাভী হতেও বেশি পছন্দনীয়। খ. সমুদ্রের মাছও রোযাদার ব্যক্তির জন্যে ইফতার পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে। গ. প্রতিদিন রোযাদারের জন্যে জান্নাতকে সুসজ্জিত করা হয় এবং আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দাগণ দুনিয়ার কষ্ট-ক্লেশ থেকে মুক্ত হয়ে অচিরেই তোমাদের কাছে আসবে। ঘ. রমযানে মারদুদ শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, যার কারণে সে ওই সব পাপকাজ করাতে সক্ষম হয় না, যা অন্য সময় করাতে পারে। ঙ. রমযান মাসের শেষরাতে রোযাদারগণের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। সাহাবাগণ আরজ করেন, এ ক্ষমা কি শবে-ক্বদরে হয়ে থাকে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, না; বরং নিয়ম হলো, শ্রমিকের কাজ শেষ হলে সে প্রতিদান পায়। (মুসনাদে আহমদ; বায়হাকী)।

যাদের ওপর রোযা ফরয : কোনো ব্যক্তির ওপর রোযা ফরয হওয়ার জন্যে নিচের শর্তগুলি থাকা প্রয়োজন। ক. মুসলমান হওয়া। খ. আক্বেল (বোধসম্পন্ন) হওয়া। গ. বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হওয়া। ঘ. সুস্থ হওয়া। ঙ. মুকীম হওয়া। চ. নারী হলে হায়েয ও নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া। (ফাতাওয়া আলমগীরী- ১/২৫৭)।

চাঁদ সংক্রান্ত কয়েকটি মাসআলা

মাসআলাঃ ২৯শে শা’বান চাঁদ দেখা গেলে রোযা রাখতে হবে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে এবং চাঁদ দেখা না গেলে, পরের দিন রোযা রাখবে না। হাদীস শরীফে ‘ইয়াওমুশ শাক’ তথা সন্দেহের দিনে রোযা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। শা’বান মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হওয়ার পর রোযা রাখবে। তবে কারো কারো মতে ইয়াওমুশ শাকে খাওয়াস তথা উলামায়ে কিরামের জন্যে গোপনে রোযা রাখা বৈধ। আর আওয়াম বা সাধারণ মানুষ এ দিনে রোযা রাখবে না। (বাদায়েউস সানায়ে- ২/২১৬)।

মাসআলাঃ ২৯ তারিখে রমযানের চাঁদ দেখা না গেলে দুপুরের এক ঘন্টা পূর্ব পর্যন্ত কিছুই পানাহার না করে চাঁদের সংবাদের অপেক্ষা করবে। কোথাও চাঁদ দেখার খবর এলে রোযার নিয়ত করবে। আর না এলে পানাহার করবে। (নূরুল ইজাহ- ৬৩)।

মাসআলাঃ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে মাত্র একজন সত্যবাদী দ্বীনদার মহিলা বা একজন পুরুষের সাক্ষ্যতেই রমযানের চাঁদ প্রমাণিত ও সাব্যস্ত হবে। (কুদুরী- ৭৯)।

মাসআলাঃ আকাশ সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে দু’চারজনের সাক্ষ্যে চাঁদ ওঠা প্রমাণিত হবে না। তা রমযানের চাঁদই হোক বা ঈদের। অবশ্য যদি এত লোকে চাঁদ দেখার প্রমাণ দেয়, যাতে মনে দৃঢ় ধারণা হয় যে, এত লোক কিছুতেই মিথ্যা কথা বলতে পারে না, তবে চাঁদ ওঠা প্রমাণিত হবে। (কুদুরী- ৪৫ পৃষ্ঠা)।

মাসআলাঃ অনেক সময় দেশব্যাপী এমনভাবে খবর প্রচারিত হয় যে, কাল চাঁদ দেখা গেছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একজনেও চাঁদ দেখেছে বলে সারা দেশে খুঁজে তার প্রমাণ পাওয়া গেল না, শরীয়তে এ ধরনের ভিত্তিহীন গুজবের কোনো মূল্য নেই। (আদ-দুররুল মুখতার- ১/১৪৫)।

রোযার নিয়ত ও কতিপয় জরুরী মাসআলা

মাসআলাঃ নিয়ত বলা হয়, অন্তরের ইচ্ছা ও আগ্রহকে। এটি মনে মনে হোক বা মুখের উচ্চারণে। রোযার জন্যে নিয়ত করা শর্ত। ফলে রোযার জন্যে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস বর্জনের মতো নিয়ত করাও ফরয। শুধু মনে মনে ‘আমি আগামী কাল রোযা রাখব’ বা ‘রোযা রাখার জন্যে সাহরী খাচ্ছি’ এতটুকু নিয়ত করলেও তা সহীহ হয়ে যাবে। তবে নিয়ত মুখে পড়া ফরয নয়; কেবল মনে মনে সংকল্প করলেই যথেষ্ট হবে। আর ‘আগামী কাল আমি রোযা রাখবো’ শুধু এতটুকু বললেও যথেষ্ট হবে। তবে যদি কেউ মনের চিন্তা এবং সংকল্পের সঙ্গে মুখেও বাংলা বা আরবীতে কিংবা যে কোনো ভাষায় নিয়ত করে তা আরো উত্তম হবে; কিন্তু একে জরুরি মনে করা বিদআত। (ফাতাওয়া আলমগীরী- ১/২৫৭, মাকতাবায়ে ইত্তিহাদ; আদ্দুরুর মুখতার- ১/১৪৭)।

মাসআলাঃ প্রত্যেক রোযার জন্যে প্রতি দিন নতুনভাবে নিয়ত করা আবশ্যক। (ফাতাওয়া আলমগীরী- ১/২৫৭, মাকতাবায়ে ইত্তিহাদ)।

মাসআলাঃ সূর্যাস্ত যাওয়ার পূর্বেই যদি কেউ এ নিয়ত করে যে, ‘আমি আগামীকাল রোযা রাখব’ তার এ নিয়ত ধর্তব্য হবে না। তবে সূর্যাস্ত যাওয়ার পরে নিয়ত করলে তা সহীহ হবে। (আদ-দুরুল মুখতার- ২/৩৭৭, ফাতাওয়া শামী- ২/৩৭৭, এইচ এম সাঈদ)।

মাসআলাঃ বেলা দ্বিপ্রহরের এক ঘন্টা পূর্ব পর্যন্ত নফল রোযার নিয়ত করা জায়েয। সুতরাং কারো বেলা দশটা পর্যন্ত রোযা রাখার নিয়ত ছিলো না আবার পানাহারও করেনি এবং রোযা ভঙ্গের অন্য কোনো কাজও করেনি, এরপর সে নফল রোযার নিয়ত করেছে, তার রোযা হয়ে যাবে। (আদ-দুররুল মুখতার- ১/১৪৬)।

মাসআলাঃ ফরয, নফল ও নযরে মুআয়ইনের রোযার নিয়ত দিনের দ্বিপ্রহরের এক ঘন্টা পূর্বে করলেও তার রোযা হয়ে যাবে, যদি রোযা ভঙ্গের কোনো কাজ সে এ সময় না করে থাকে। (আদ-দুররুল মুখতার- ১/১৪৬)।

মাসআলাঃ ক্বাযা, মান্নত ও কাফফারার রোযার নিয়ত সুবহে সাদিকের আগেই করতে হবে। অন্যথায় তার রোযা হবে না, বরং তা নফল রোযা বলে বিবেচিত হবে। (কুদুরী- ৭৯)।

মাসআলাঃ রমযান মাসে যদি নির্দিষ্ট করে রমযান মাসের রোযা বা ফরয রোযা বলে নিয়ত নাও করে, শুধু এতটুকু নিয়ত করে, আজ আমি রোযা রাখবো অথবা রাতে মনে মনে বলে, আগামীকাল রোযা রাখবো, তাহলে তাতেই রমযানের রোযা সহীহ হয়ে যাবে। (মুলতাকাল আবহুর- ৫/৪৩)।

মাসআলাঃ কেউ রমযান মাসে রমযানের রোযা না রেখে যদি বলে আমি এখন নফল রোযা রাখি পরে রমযানের রোযার কাযা করে নেব, তবুও তার রমযানের ফরয রোযা শুদ্ধ হবে, নফল হবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া- ১/২৫৮, মাকতাবায়ে ইত্তিহাদ)।

মাসআলাঃ কোনো কারণে বিগত রমযানের রোযা বাদ পড়েছিলো, সারা বছর সে রোযার ক্বাযা আদায় করা সম্ভব হয়নি, এখন পুনরায় রমযান মাস এসে গেছে, এ অবস্থায় যদি সে গত রমযানের ক্বাযা রোযার নিয়ত করে, তবুও এ রমযানের রোযাই হবে, গত রমযানের রোযার ক্বাযা আদায় হবে না। ক্বাযা রোযা রমযানের পরে রাখতে হবে। (আদ-দুররুল মুখতার- ১/১৪৭)।

মাসআলাঃ কেউ মান্নত করেছিলো যে, আমার অমুক কাজ হয়ে গেলে আমি আল্লাহ তাআলার জন্যে দু’টি বা একটি রোযা রাখবো। তারপর তার সে উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে; কিন্তু সে মান্নতের রোযা রাখেনি। যখন রমযান মাস এসেছে, সে ওই রোযা রাখার ইচ্ছা করলো। এখন যদি সে মান্নতের রোযার নিয়ত করে তবুও তার রমযানের রোযাই আদায় হবে, মান্নতের রোযা আদায় হবে না। সে মান্নতের রোযা রমযানের পরে রাখবে। মোটকথা, রমযান মাসে সে যে রোযারই নিয়ত করুক, তাতে রমযানের রোযাই হবে। রমযান মাসে অন্য কোনো রোযা হবে না। (কুদুরী- ৮২ পৃষ্ঠা)।

সাহরী সম্পর্কীয় কয়েকটি মাসআলা

মাসআলাঃ রোযা রাখার উদ্দেশ্যে শেষ রাতে যা কিছু আহার করা হয়, তাকে সাহরী বলা হয়। সাহরী খাওয়া সুন্নাত। ক্ষুধা না থাকলে অন্তত দু’একটি খোরমা বা অন্য কিছু খাবে। কিছু না থাকলে একটু পানি হলেও পান করবে। (সহীহ বুখারী, বাবু বারকাতিস সাহূরি- ১৯২৩)।

মাসআলাঃ রোযাদার ব্যক্তির জন্যে রাতের শেষভাগে সুবহে সাদিকের পূর্বে সাহরী খাওয়া সুন্নাত এবং বিশেষ বরকতময়। রাতের প্রথমার্ধ্ব অতিক্রান্তের পর যখনই পানাহার করবে সাহরী খাওয়ার সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু রাতের শেষাংশে খাওয়া উত্তম। মুয়াজ্জিন যদি সুবহে সাদিকের পূর্বেই আযান দিয়ে দেয়, তাহলে সুবহে সাদিক পর্যন্ত সাহরী খেতে কোনো প্রকার অসুবিধা নেই। সাহরী খাওয়ার পর রোযার নিয়ত মনে মনে করলেই যথেষ্ট হবে। (আল-হিদায়া- ১/১৮৬)।

মাসআলাঃ সাহরী যথাসম্ভব বিলম্বে খাওয়া ভালো। আবার এতটা বিলম্বে করা ঠিক নয় যাতে সুবহে সাদিক হওয়ার আশঙ্কা হয় এবং রোযায় সন্দেহ আসতে পারে। (আল-হিদায়া- ১/১৮৬)।

মাসআলাঃ রাতে ঘুম না ভাঙ্গার কারণে সাহরী খেতে না পারলে সাহরী না খেয়ে রোযা রাখবে। সাহরী না খাওয়ার কারণে রোযা ছেড়ে দেয়া দুর্বল ঈমানদারের লক্ষণ এবং গুনাহের কাজ।

মাসআলাঃ কেউ যদি বিলম্বে ঘুম থেকে জেগে ‘এখনো রাত আছে মনে করে’ সাহরী খায়, পরে জানতে পারে যে, তখন রাত ছিলো না, তবে ওই রোযার ক্বাযা আদায় করতে হবে, কাফফারা দিতে হবে না। কিন্তু ওই দিন কিছু খেতে পারবে না। যদি সূর্যাস্ত হয়ে গেছে মনে করে ইফতারী করার পর জানতে পারে যে, তখন সূর্যাস্ত যায়নি, তারও একই হুকুম তথা ওই রোযার ক্বাযা করতে হবে, কাফফারা দেয়া লাগবে না। (আল-হিদায়া- ১/১৮৭)।

ইফতার সম্পর্কীয় কিছু মাসআলা

মাসআলাঃ যখন নিশ্চিতরূপে জানতে পারে যে, সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, তখন আর দেরী না করে তাড়াতাড়ি ইফতারী করা মুস্তাহাব। বিলম্বে ইফতারী করা মাকরুহ। (মারাকীউল ফালাহ)।

মাসআলাঃ মেঘলা দিনে একটু দেরী করে ইফতার করা ভালো। কেবল ঘড়ির ওপর নির্ভর করা ভালো নয়। কারণ ঘড়ির সময় অনেক সময় ভুল হয়ে থাকে। কারো আযানের ওপর পূর্ণ আস্থাবান হওয়াও ঠিক নয়। কেননা মুয়াজ্জিনেরও ভুল হতে পারে। কাজেই ঈমানদারের দিলে সূর্য ডুবার সাক্ষ্য না দেয়া পর্যন্ত সবর করাই ভালো। (মারাকীউল ফালাহ)।

মাসআলাঃ সর্বাপেক্ষা উত্তম হলো, খোরমা দিয়ে ইফতার করা। খোরমার অভাবে অন্য কোনো মিষ্টি জাতীয় জিনিস দিয়ে এবং তার অভাবে পানি দিয়ে ইফতার করা ভালো। কেউ কেউ লবণ দিয়ে ইফতার করাকে সাওয়াব মনে করেন, এটা ভুল ধারণা। (সুনানুত তিরমিযী- ১/১৮৮)।

মাসআলাঃ সূর্যাস্ত নিশ্চিত হওয়ার পর কোনো ব্যক্তি ইফতার করলে তাকে তিরস্কার করা জায়েয হবে না, যদিও সে ঘণ্টা বা সাইরেন দেয়ার পূর্বে ইফতারী করে থাকে।

মাসআলাঃ ইফতারী সামনে নিয়ে ‘ইয়া ওয়াসিয়াল ফাদলিগ ফিরলী’ (হে মহান দয়ালু! আমাকে ক্ষমা করুন) দোয়াটি পড়া সুন্নাত।

মাসআলাঃ ইফতার সামনে রেখে হাত উঠিয়ে সম্মিলিতভাবে দোয়া করা কোনো নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে বা খায়রুল কুরুন হতে প্রমাণিত নয়, তাই তা বিদআত।

মাসআলাঃ রাসূলুল্লাহ (সা.) ইফতারের সময় ‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিযকিকা আফতারত’ু (আল্লাহ! আমি তোমারই জন্যে রোযা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিযিকে রোযা খুলেছি) দোয়াটি পড়তেন। (সুনানু আবী দাঊদ, বাবুল কাওলি ইনদাল ইফতার)।

মাসআলাঃ হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইফতারের পর ‘যাহাবায যামাউ ওয়াব তাল্লাতিল উরূকু ওয়া সাবাতাল আজরু ইনশাআল্লাহ’ (তৃষ্ণা দূর হলো, শিরা উপশিরা সিক্ত হলো এবং আল্লাহ চাহে তো সাওয়াবও নির্ধারিত হলো) দোয়াটি পাঠ করতেন। (সুনানু আবী দাঊদ, বাবুল কাওলি ইনদাল ইফতার)।

যে সব কারণে রোযা ভঙ্গ হয়

১. নাকে অষুধ প্রবেশ করালে। এটা পূর্বকালের ডাক্তারদের ধারণা মতে। তবে বর্তমানের ডাক্তারদের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে কানে কোনো প্রকার তরল বস্তু ব্যবহার করার দ্বারা রোযা ভঙ্গ হবে না। কারণ বর্তমানের ডাক্তারদের ভাষ্যমতে কান এবং গলা উভয়ের মাঝে কোনো ছিদ্রপথ নেই। ফলে কানে অষুধ ব্যবহার করলে তা গলায় পৌঁছার আশংকা নেই। কিন্তু যদি কানের পর্দা ফাটা হয়, তাহলে কানে অষুধ ব্যবহারের দ্বারা রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। (আদ-দুরুল মুখতার- ৩/৩৭৬)।

২. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভর্তি বমি করলে। (রদ্দুল মুহতার, বাবু মা ইউফসিদুস সাওম ওয়া মা লা ইউফসিদুহু)।

৩. কুলি করার সময় গলার ভিতরে পানি চলে গেলে। (আদ-দুরুল মুখতার- ৩/৩৭৪)।

৪. নারীকে চুমো, স্পর্শ, হস্তমৈথুন ইত্যাদির কারণে বীর্য বের হলে।

৫. খাদ্য হিসেবে গণ্য নয় এমন বস্তু গিলে ফেললে।

৬. আগর বাতির ধোঁয়া ইত্যাদি ইচ্ছা করে নাক অথবা গলার মধ্যে প্রবেশ করালে। বিড়ি সিগারেট পান করলে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া- ১/২০৪)।

৭. ভুলক্রমে খানা খাওয়ার পর রোযা ভঙ্গ হয়ে গেছে মনে করে পুণরায় ইচ্ছা করে খানা খেলে।

৮. রাত বাকী আছে মনে করে সুবহে সাদিকের পর খানা খেলে।

৯. দিন বাকী থাকতে সূর্য প্রায় ডুবে গেছে মনে করে ইফতার করলে। উল্লিখিত কর্মগুলো দ্বারা রোযা ভঙ্গ হয়ে যায়। এতে ক্বাযা ওয়াজিব হয়। কিন্তু কাফফরা ওয়াজিব নয়। (আদ-দুরুল মুখতার- ৩/৩৭৫)।

১০. ইচ্ছা করে স্ত্রী সহবাস বা পানাহার করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এ জন্যে ক্বাযা ও কাফফারা উভয় ওয়াজিব হবে।

১১. দাঁত দিয়ে রক্ত বের হলে যদি থুথুর সঙ্গে রক্ত গিলে ফেলে তবে রোযা ভঙ্গ হবে। কিন্তু রক্ত যদি থুথুর চেয়ে কম হয়, যাতে রক্তের স্বাদ পাওয়া না যায়, তবে রোযা ভঙ্গ হবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া- ১/২০৫)।

১২. রোযা অবস্থায় পেশাবের রাস্তায় কোনো অষুধ রাখা অথবা তেল ইত্যাদি কিছু টপকানোর কারণে রোযা ভাঙ্গবে না। তাই যদি কেউ অষুধ রাখে, তাহলে তার রোযা ভঙ্গ হবে না। (পূর্ববর্তী ডাক্তারদের গবেষণা মতে ফুক্বাহায়ে কেরাম এর দ্বারা রোযা ভাঙ্গার মত দিয়ে ছিলেন। তবে বর্তমানের ডাক্তারদের গবেষণা মতে ফুক্বাহায়ে কেরাম এর দ্বারা রোযা না ভাঙ্গার ফাতাওয়া দিয়েছেন। কেননা তা পেটে পৌঁছে না। আর পেটে না পোঁছলে রোযাও ভঙ্গ হবে না)।

১৩. ধাত্রী যদি প্রসূতির প্রসবদ্বারে আঙ্গুল প্রবেশ করায় কিংবা কোনো মহিলা নিজেই নিজের যৌনিতে আঙ্গুল প্রবেশ করায়, তবে রোযা ভঙ্গ হবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া- ১/২০৫)।

১৪. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাদ্য যদি একটি বুটের দানা বা এর চেয়ে বড় হয়, তাহলে এটা গিলে ফেলার দ্বারা রোযা ভঙ্গ হবে। বুটের দানার চেয়ে ছোট হলে ভঙ্গ হবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া- ১/২০৩)।

১৫. যদি কেউ সাহরী খেয়ে পান মুখে দিয়ে চিবাতে চিবাতে ঘুমিয়ে পড়ে এবং পান মুখে থাকা অবস্থায় ভোর হয়ে যায়, তবে তার রোযা শুদ্ধ হবে না। রোযা ক্বাযা রাখতে হবে।

১৬. কাউকে জোরপূর্বক কিছু খাইয়ে দিলে রোযা ভঙ্গ হবে এবং ক্বাযা করতে হবে, তবে কাফফারা ওয়াজিব হবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া- ১/২০৪)।

যে সব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না

১. মিসওয়াক করা। ২. মাথায় বা গোঁফে তেল দেয়া। (ফাতাওয়া আলমগীরী- ১/২৬২, মাকতাবায়ে ইত্তিহাদ)। ৩. চোখে অযুধ বা সুরমা ব্যবহার করা। (আল-হিদায়া- ২/২৫৭, ইদারাতুল কুরআন)। ৪. গরম বা পিপাসার কারণে গোসল করা। ৫. খুশবু ব্যবহার বা তার ঘ্রাণ গ্রহণ করা। ৬. ভুলে পানাহার করা অথবা অনিচ্ছায় গলায় ধূলাবালি কিংবা মাছি ঢুকে যাওয়া। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী- ১/২৬৬, মাকতাবায়ে ইত্তিহাদ)। ৭. ইঞ্জেকশন বা টিকা দেয়া। (ইমদাদুল ফাতাওয়া- ২/১৪৫, মাকতাবায়ে যাকারিয়া)। ৮. কানে পানি প্রবেশ করা। (ফাতাওয়া আলমগীরী- ১/২৬৬, মাকতাবায়ে ইত্তিহাদ)। ৯. অনিচ্ছাকৃত বমি হওয়া। (আল-হিদায়া- ২/২৫৮, ইদারাতুল কুরআন)। ১০. দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বের হওয়া। তবে তা গলায় প্রবেশ করলে রক্তের পরিমাণ বেশি বা বরাবর হলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি থুথু বেশি হয়, তাহলে রোযার কোনো সমস্যা হবে না। (ফাতাওয়া আলমগীরী- ১/২৬৬, মাকতাবায়ে ইত্তিহাদ)।

যে সব কারণে রোযা মাকরুহ হয়

ক. বিনা কারণে কোনো জিনিস চিবানো বা লবণ ইত্যাদির স্বাদ গ্রহণ করে ফেলে দেয়া এবং টুথপেস্ট, মাজন ও কয়লা ইত্যাদি দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা মাকরুহ। কিন্তু গলার ভেতর প্রবেশ করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। (আদ-দুরুল মুখতার- ৩/৩৯৫)।

খ. গোসল ফরয অবস্থায় সারা দিন গোসল না করে থাকা। (আদ-দুরুল মুখতার- ৩/৩৯৫)।

গ. সিঙ্গা লাগানো অথবা কোনো রুগীকে রক্ত দান করা, যা সিঙ্গা লাগানোর অন্তর্ভুক্ত। (আল-মাওসূআতুল ফিকহিয়্যা- ২৮/৬৯)।

ঘ. পরনিন্দা চর্চা ততোধিক গুনাহের কাজ। (আদ-দুরুল মুখতার- ৩/৩৬৭)।

ঙ. ঝগড়া-ঝাটি বা অন্য কারণে মানুষ কিংবা প্রাণী বা জড়পদার্থ ইত্যাদিকে গালি দেয়া। (আদ-দুরুল মুখতার- ৩/৩৬৭)।

চ. রোযাদার মহিলার জন্যে ঠোঁটে রঙিন জিনিস লাগানো জায়েয বটে। কিন্তু তা মুখের ভিতরে প্রবেশ করার আশংকা থাকলে মাকরুহ।

ছ. রোযা রাখা অবস্থায় ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্ত বের করলে রোযা নষ্ট হয় না। অবশ্য যদি এতই দূর্বল হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে যে, রোযা রাখার শক্তিই হারিয়ে ফেলবে, তাহলে মাকরুহ হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া- ৪/৪২৫)।

জ. রোযা অবস্থায় দাঁত উঠানো এবং দাঁতে অষুধ ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজনে জায়েয। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে মাকরুহ। যদি রক্ত অথবা অষুধ পেটের মধ্যে প্রবেশ করে অথবা থুথুর চেয়ে তা বেশি পরিমাণ হয়ে যায়, অথবা রক্ত বা অষুধের সমপরিমাণ স্বাদ অনুভূত হয়, তাহলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। (আদ্দুরুল মুখতার- ৪/৪২৭)।

যে সব কারণে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে

১. গর্ভবতী নারীর সন্তান কিংবা নিজের প্রাণনাশের ভয় হলে। তবে পরে ক্বাযা করা লাগবে, কাফফারা দেয়া লাগবে না।

২. অপরের সন্তানকে বুকের দুধ পান করানোর কারণে ধাত্রীর কিংবা সন্তানের কষ্ট হলে। তবে পরে এর ক্বাযা করা লাগবে, কাফফারা দেয়া লাগবে না। (ফাতাওয়া আলমগীরী- ১/২৭০, মাকতাবায়ে ইত্তিহাদ)।

৩. কোনো অসুখের কারণে রোযা রাখার শক্তি হারিয়ে ফেললে অথবা রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা হলে। তবে পরে এ রোযার ক্বাযা করতে হবে। (আল-মুহিতুল বুরহানী, আল-ফাসলুস সাবে ফীল আসবাবিল মুবিহাতি লিল ফিতর)।

৪. কেউ হত্যার হুমকি দিয়ে রোযা ভাঙতে বাধ্য করলে রোযা ভেঙে ফেলবে এবং পরে তার ক্বাযা করতে হবে।

৫. কোনো ব্যক্তি শরয়ী মুসাফির তথা নিজ বাড়ি থেকে শরয়ী ৪৮ মাইল দূরে সফর করার ইচ্ছায় বের হলে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া- ১/২৬৯, মাকতাবায়ে ইত্তিহাদ)।

৬. সফর অবস্থায় কষ্ট না হলে রোযা রাখা উত্তম। আর কষ্ট হলে রোযা না রাখতে পারবে। (শরহুল বিদায়া- ১/১৮৬)।

৭. রোযা অবস্থায় সফর শুরু করলে রোযা পুরো করা জরুরী। আর সফর অবস্থায় রোযা না রেখে বাড়ি ফিরে আসার পর, দিনের কিছু অংশ বাকী থাকলে, পানাহার থেকে বিরত থাকবে। কোনো ব্যক্তি পানাহার না করা অবস্থায় সূর্য ঢলে পড়ার দেড় ঘন্টা পূর্বে নিজ বাড়িতে ফিরে এলে নিয়ত করে রোযা রাখতে হবে। (আল-হিদায়া- ১/১৮৪)।

৮. কোনো রোগীর ক্ষুধা বা তৃষ্ণা এমন পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কোনো মুসলমান দ্বীনদার ডাক্তার রোযা ভঙ্গ না করলে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এ অবস্থায় রোযা ভঙ্গ করা ওয়াজিব। তবে পরে তার কাযা করতে হবে। (ফাতাওয়া শামী- ১/১৫৩, এস এম সাঈদ)।

উল্লেখ্য, যাদের রোযা ভাঙ্গার অনুমতি দেয়া হয়েছে, তাদের জন্যে রোযার সম্মানে প্রকাশ্যে কারো সামনে পানাহার না করা চাই।

কতিপয় চিকিৎসায় রোযার মাসায়েল

রোযা অবস্থায় রক্ত দেয়া-নেয়াঃ রোযা অবস্থায় রক্ত দিলে রোযা নষ্ট হবে না। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা.) রোযা অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়ে দুষিত রক্ত বের করেছেন। (সহীহ বুখারী- ১/২৬০, মাকতাবায়ে আশরাফিয়া)। শরীরে রক্ত প্রবেশ করানোর হুকুম ইঞ্জেকশনের মতোই, অর্থাৎ- রক্ত স্বাভাবিক প্রবেশ পথ দিয়ে প্রবেশ করে না এবং তা দেমাগ বা পেটে পৌঁছে না, তাই রক্ত নিলে রোযা নষ্ট হবে না।

ইঞ্জেকশন দিলে রোযা ভঙ্গ হবে নাঃ ইঞ্জেকশন দিলে রোযা ভঙ্গ হবে না। কেননা ইঞ্জেকশন দ্বারা বাইর থেকে শরীরের ভেতরে তরল বস্তু প্রবেশ করানো হয়। কিন্তু স্বাভাবিক অতিক্রমস্থল দিয়ে প্রবেশ করানো হয় না, বরং শরীরের গোশত ছেদ করে ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়। গোশতের ইঞ্জেকশন গোশতেই থেকে যায়। আর যদি কোন কারণে পুশ করা ইঞ্জেকশন পেট পর্যন্ত পৌঁছেই যায়, তাহলে তাও ঘামের মত চুইয়ে চুইয়ে যায়। বলাবাহুল্য যে, মানফাজ বা অতিক্রমস্থল দিয়ে প্রবেশ না করলে রোযা ভঙ্গ হবে না। আর শিরায় ইঞ্জেকশন পুশ করা হলে তা শিরাতেই চলাফেরা করে। শারীরিক আরামের কারণ হয়, তা পেট বা দেমাগে যায় না। (ফাতহুল কাদীর- ২/২৫৭)।

ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন গ্রহণঃ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্যে রোযা অবস্থায় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নেয়া বৈধ। এ কারণে রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। (ফাতহুল কাদীর- ২/২৫৭; আলাতে জাদীদাহ কে শরয়ী আহকাম- ১৫৩)।

কানে অষুধ ব্যবহারঃ কানে অষুধ, তেল ও পানি ইত্যাদি ব্যবহার করলে রোযা ভঙ্গ হবে না। কারণ, কান এবং গলা উভয়ের মাঝে কোনো ছিদ্রপথ নেই। তাই কানে অষুধ ব্যবহার করলে তা গলায় পৌঁছার আশংকা নেই। পূর্বকালে ডাক্তারদের ধারণা ছিলো, কান আর গলার মাঝে ছিদ্রপথ রয়েছে, তাই সে সময়ের উলামায়ে কিরাম রোযা ভঙ্গের ফতোয়া দিয়েছিলেন। বর্তমান যুগের ডাক্তারদের বাস্তবভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে, কানের পর্দা যদি ফাটা না থাকে, তাহলে কোনো বস্তু কান দিয়ে গলায় পৌঁছা সম্ভব নয়। পূর্ব যুগের ফক্বীহগণ (রাহ.) মাসআলার যে কারণ ও নীতিমালা বর্ণনা করেছেন এবং বর্তমানকালের ডাক্তারদের গবেষণা উভয়ের আলোকে একথা বলা যায়, কারো কানের পর্দা যদি ঠিক থাকে এবং কানে অষুধ, পানি অথবা অন্য কোনো তরল বস্তু দেয়া হয়, তাহলে রোযা ভঙ্গ হবে না।

ইনহেলার ব্যবহারের হুকুমঃ বলাবাহুল্য, অষুধটি স্প্রে করার সময় যদিও তা গ্যাসের মত মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে তা হলো- দেহ বিশিষ্ট তরল পদার্থ। আর এই তরল পদার্থ যখন মুখ দিয়ে প্রবেশ করে তখন তা পেটে পৌঁছে যায়। তাই রোযা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে শামী- ৩/৩৬৬, মাকতাবায়ে যাকারিয়া)।

চোখে ড্রপ ও মলম ব্যবহারঃ চোখের রোগে আক্রান্ত রোগীর জন্যে রোযা অবস্থায় চোখের ড্রপ, মলম বা সুরমা ব্যবহার করা জায়েয। এক্ষেত্রে গলায় ঔষধের স্বাদ অনুভূত হলেও রোযা ভাঙ্গবে না। (ফাতহুল ক্বাদীর- ২/২৫৭)।

নাকে ড্রপ বা অষুধ ব্যবহারঃ নাকে ড্রপ, তরল অষুধ অথবা পানি ইত্যাদি ব্যবহার করে ভিতরের দিকে টানলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। কারণ এর ফলে অষুধ ইত্যাদি গলায় চলে যায়। (আল-হিদায়া, ফাতহুল ক্বাদীর সংযুক্ত- ২/২৬৫-২৬৬)।

এন্ডোসকপি করলে রোযা ভঙ্গ হবে না

এন্ডোসকপি করার সময় সাধারণতঃ পাইপটিতে কোনো ধরনের মেডিসিন বা তৈল ব্যবহার করা হয় না। আর পাইপসহ যা কিছু ঢুকানো হয়, সব বের হয়ে আসে। রোযা ভঙ্গ হওয়ার মূলনীতিতে বলা হয়েছে- বাইর থেকে বস্তু অতিক্রমস্থল দিয়ে প্রবেশ করে পেট বা মস্তিষ্কে স্থির হতে হবে। কিন্তু এন্ডোসকপি করার সময় পাকস্থলীতে বাইর থেকে বস্তু প্রবেশ করে বটে, কিন্তু সেখানে স্থির থাকে না। তাই রোযা নষ্ট হবে না। ফিক্বহের কিতাবে এ ধরনের বেশ কিছু মাসআলা পাওয়া যায়। আল্লামা ইবনে নুজাইম (রাহ.) বলেন- ‘যদি কোনো সুতার সাথে খাদ্য বেঁধে তা কণ্ঠনালীতে প্রবেশ করানো হয়, আর সুতার অন্যদিক তার হাতে থাকে, তাহলে রোযা নষ্ট হবে না। তবে যদি খানা সুতা থেকে পৃথক হয়ে যায় তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে’। (আল বাহরুর রায়েক- ২/৪৮৭, মাকতাবায়ে যাকারিয়া)।

উল্লিখিত মাসআলা ও এন্ডোসকপির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মোটকথা, এন্ডোসকপি করলে রোযা নষ্ট হবে না। তবে যদি পাইপের সাথে কোনো ধরনের মেডিসিন বা তেল লাগানো হয়, যা পেটে থেকে যায়, তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।

আবার এন্ডোস্কপি করার সময় রক্ত বা ময়লার কারণে পাইপের বাল্ব প্রায়ই ঘোলাটে হয়ে যায়। যার কারণে পাইপের মাধ্যমে পানি দিয়ে ওই বাল্ব পরিষ্কার করতে হয়। এমন হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তাই যে ডাক্তার পরীক্ষা করাবেন তার থেকে জেনে নিতে হবে যে, পাইপের সাথে কোনো অষুধ দেয়া হয়েছে কি না বা ভেতরে পানি দেয়ার প্রয়োজন হয়েছে কি না। উল্লেখ্য, রমযান মাসে এন্ডোস্কপি করার প্রয়োজন হলে একান্ত নিরুপায় না হলে ইফতারের পর করবেন। (আল-মুহীতুল বুরহানী- ৩/৩৪৮)।

রমযানে অষুধের মাধ্যমে মহিলাদের মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ রাখা

রমযান মাসে অষুধ সেবনের মাধ্যমে কোনো মহিলা মাসিক স্রাব বন্ধ করে রাখলে তাকে নামায, রোযা ইত্যাদি সকল হুকুমই পালন করতে হবে। তথা এ পদ্ধতিতে মাসিক বন্ধ রাখলে পবিত্র অবস্থার সমস্ত বিধান তার জন্যে প্রযোজ্য হবে। তবে হায়েয-নেফাস শুরু হয়ে যাওয়ার পর যদি বন্ধ করা হয়, তাহলে দেখতে হবে হায়েযের ক্ষেত্রে ১০ দিন আর নেফাসের ক্ষেত্রে ৪০ দিনের ভিতর পুনরায় রক্ত দেখা দিয়েছে কিনা, দেখা দিলে তাকে হায়েয-নেফাসগ্রস্থ হিসেবে গণ্য করা হবে, নতুবা হায়েয-নেফাসমুক্ত বলে ধরা হবে।

উল্লেখ্য, স্রাব বন্ধের জন্যে অষুধ ইত্যাদির ব্যবহার না করাই ভালো। একান্ত কেউ করতে চাইলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। যেন তার স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যার সৃষ্টি না করে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক- ১/৩১৮)।

– আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফতি ও সহকারী পরিচালক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব- নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।