Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বই পড়ুন সত্যের চশমা পরে

বই পড়ুন সত্যের চশমা পরে

।। কাজী হামদুল্লাহ ।।

মূল কথায় যাবার আগে একটি কথা মনে পড়ছে বারবার। সেদিন আমাদের উলুমে হাদিসের লাইব্রেরিতে কিছু কিতাব দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। প্রথম দিনেই দারুণ একটা হোঁচট খেয়েছিলাম। ইলমের ক্ষেত্রে যাদেরকে আমরা খেয়ানত করতে দেখি অহরহ তাদের অনেক বইই এখানে রাখা। সেদিন থেকে মনে মনে একটা অস্থিরতা নিয়েই দিন যাচ্ছিলো। বিশেষ করে ‘সিলসিলাতুল আহাদিস’ ও ‘আসাদুল গাবাহ’ (যার তাহকীকে সমস্যা) এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তো যাই হোক, কয়েকদিন পরে মুহতারাম উস্তাদ আব্দুল্লাহ নাজীব সাহেব বিষয়টি ক্লিয়ার করে দেন। তিনি বলেন- এখানে কিতাবগুলো রাখা হয়ে শুধু তা’বীরান। অর্থাৎ বিভিন্ন ভুলভাল কিতাবের অসংগতিগুলো কী এবং তার সমাধান কী তা বের করার জন্য। এরপরে মুহতারাম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন- কিতাব পড়তে হবে ‘নাকেদানা’। অর্থাৎ পড়তে হবে, তবে ভাল ও মন্দের বিচার করে। ভুল ও সঠিকের বিশ্লেষণ করে। এমন নয় যে, বইয়ে যা পড়ব তার সবই সঠিক, বই যা বলেছে তা-ই দলিল। বইয়েও ভুল থাকতে পারে। বইয়েও বিভ্রান্তি আসতে পারে, সেটা মাথায় রেখেই বই পড়তে হবে।
তাদবীনুল হাদিস নামে একটি কিতাব আছে। আল্লামা মুনাযের আহসান গিলানী রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেন। কিতাবটি মূলত উর্দু। ড. আব্দুর রাযযাক ইসকান্দর এর আরবি অনুবাদ করেছেন। আর তাখরিজ করেছেন প্রোথিতযশা খ্যাতিমান মুহাদ্দিস ড. বাশশার আওয়াদ মা’রুফ হাফিজাহুল্লাহ। এই কিতাবের এক জায়গায় তিরমিযির একটি হাদিস এনেছেন লেখক। তার রাবির মধ্যে একজনের নাম বলেছেন ‘আব্দুর রহমান বিন যায়েদ’। এই রাবির হালত দেখতে গিয়ে দেখি যে, ঘটনা মিলছে না। পরে তিরমিযি এবং অন্যান্য কিতাব খুলে দেখি এই রাবির নাম আসলে আব্দুর রহমান বিন যায়েদ নয়, বরং আব্দুর রহমান বিন ইয়াযিদ। বিষয়টি যদি আমি তাহকিক না করতাম, ভুলটাই জেনে থাকতাম এবং সেটাই মানুষকে বলতাম।
এ জন্যই হুজুর বলেছেন, নাকেদানা পড়তে হবে। সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা জেনেই পড়তে হবে। আমরা অনেকেই আরেকজনের কথাকে রদ করার জন্য বিস্তর পড়াশোনা করি। এ পড়াশোনার জন্য একটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষ রাখা দরকার। পৃথিবীতে কুরআন ছাড়া এমন কোন গ্রন্থ নেই যা অন্য কোন বই/কিতাব দিয়ে রদ করা যায় না। এ বৈশিষ্ট্য কেবল কুরআনের জন্যই নির্ধারিত। সুতরাং কাউকে রদ করার জন্য নয়, পড়তে হবে সত্যকে জানার জন্য এবং মিথ্যাকে রদ করার জন্য।
কয়েকদিন আগে আমার কাছের একজন ছেলে বলছিল, ‘মুসলমানরা ইতিহাসের শুরু থেকেই বিশ্বায়নের উর্ধ্বগতি থেকে পিছিয়ে আছে।’ আরেকদিন বলছিল, ‘তুর্কিদের জন্য বাঙলা সাহিত্যে অন্ধকারযুগের আবির্ভাব ঘটেছে।’ আমি বুঝতে পারছিলাম যে, ইদানীং সে এমন কিছু বই পড়ছে, যা তার ব্রেনওয়াশ করছে। এমন কী সে এটাও বলতে চাইছে, ‘কবি নজরুলকে নিয়ে মুসলমানরা খুশি হবার কিছু নেই। তিনি মুসলিম কবি ছিলেন না।’ তার কথায় আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।
পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, সে প্রচুর পড়ছে। কিন্তু দুঃখজনক হল, তার পড়াটা নাকেদানা হচ্ছে না। সত্যানুসন্ধানী চশমাটা খুলে বই পড়ছে সে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে বেশ কিছু শ্রেণীভেদ আমরা দেখতে পাই। আরবিতে একে বলে ‘মানহাজুত তারিখিয়্যাহ’। আমরা যদি শ্রেণীবিভাগ না জেনেই আবোলতাবোল পড়া শুরু করে দিই, তাহলে আমাদের বিচ্যুতি নিশ্চিত। যেমন, ভারতীয় প্রায় হিন্দু ঐতিহাসিকরা সুলতান মাহমুদ গজনবী রহিমাহুল্লাহকে তাদের ইতিহাসে চিহ্নিত করেছে লুটেরা-ডাকাত বলে। যিনি এ দেশের নারীসমাজ ও ধর্মীয় কালচারকে রক্ষার জন্য আজীবন সংগ্রামী পণ করেছিলেন, তাকেই ওরা বলে সন্ত্রাসী। তুর্কিদেরকে এ দেশের সব হিন্দু ঐতিহাসিক এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত কিছু মুসলিম ঐতিহাসিকও বাঙলাভাষার হন্তারক বলে। কিন্তু তুর্কিদের পূর্ববর্তী সেন রাজাদের শাসনামল তাদের চোখে পড়ে না। যারা পাকিস্তানীদের মত করে এদেশের মানুষের উপরে সংস্কৃতভাষা চাপিয়ে বাংলাকে নিষিদ্ধ করেছিল।
ইতিহাস নয় শুধু, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ কাজটি রয়েছে। সব লেখকরাই নিজেদের সার্কেল, নিজেদের মানহাজ লক্ষ রেখে তার লেখা তৈরি করেছে। তবে হ্যাঁ, প্রকৃত ও সত্যকে তুলে ধরার মত বইও রয়েছে। সুতরাং এখন আমাদের কাজ হল, এলোমেলো নয়, সুশৃঙ্খলভাবে পরিকল্পনা করে পড়া। মানহাজ ও মতাদর্শকে সামনে রেখে পড়া।
প্রাচীন মিশরের গোড়ার ইতিহাস জানতে সেদিন কিছু বই পড়ছিলাম। হুট করে একটি বিষয়ের সত্যতা জানতে নেটে সার্চ করতে গিয়ে ‘ইশটিশন ব্লগের’ একটি লেখা সামনে এল। বিশাল লেখাটার পুরোটাই পড়লাম। চরমভাবে মিথ্যাচারে ভরা পুরো লেখাটা। যেমন, “মিশর যখন তার হাজার বছরের ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় হিংস্র আরবরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন কথিত নবীর অর্থলোভে (নাউজুবিল্লাহ)এই মিশর সভ্যতার ক্ষেত্রে আর সামনে এগুতে পারে না।”
মজার বিষয় হল, ইশটিশনে প্রকাশিত লেখাটিকে স্বরচিত বলা হলেও, আসলে তা নয়। রাশিয়ায় জন্ম নেয়া পাশ্চাত্য লেখক ‘আইজাক অাসিমভ’ এর ইতিহাসগ্রন্থ, যা বাংলায় অনুবাদ করেছে দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মন নামে একজন, সে বইয়ের কপিপেস্ট এটা। আর এ বিষয়টি আমার চোখে পড়েছে ইশটিশনের লেখাটা পড়ার মিনিট দশেক পরেই। ফলে আমার জন্য বোঝা সহজ হয়ে গিয়েছে, এখানে জালিয়াতি ছাড়া আর কিছু নেই। যদি এ বিষয়টি আমার আগে জানা না থাকত, আমিও ধোঁকায় পড়তাম না, এর কী গ্যারান্টি?
মোটকথা, আমাদের জন্য পড়া দরকার। প্রচুর পড়া দরকার। তবে তারচে’ও গুরুত্বপূর্ণ এবং দরকারি বিষয় হল, সচেতনতা। মানহাজ, পথ ও মত ঠিক রেখে বই পড়া। বইকে নীরব হন্তারকও বলা হয়। আমরা ভাববো একটি, কিন্তু বই গোপনে আমাদেরকে ভাবাবে আরেকটা। এজন্য বই পড়ার আগে বইকে জানতে হবে। তারও আগে বইয়ের লেখককে জানতে হবে। আর সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সত্যানুসন্ধানী চশমাটি পরেই বই-কিতাব পড়তে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।