Home ইসলাম মসজিদুল আকসার সর্বশেষ অটোমান প্রহরীর সন্ধানে

মসজিদুল আকসার সর্বশেষ অটোমান প্রহরীর সন্ধানে

মুসলমানদের ধর্মীয় তৃতীয় পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদ । -ফাইল ছবি।

উসমানি সেনাবাহিনী জেরুজালেম ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে মসজিদুল আকসায় ছোট্ট রিয়ারগার্ড বাহিনী রেখে যায়। যারা মসজিদের ভেতর শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও লুটতরাজ ও হয়রানি বন্ধে প্রহরী হিসেবে কাজ করত। ঐতিহ্য অনুসারে যুদ্ধজয়ীরা দখলকৃত শহরের রিয়ারগার্ড সৈন্যদের কখনো যুদ্ধবন্দী হিসেবে বিবেচনা করে না। তাছাড়া ব্রিটিশ সেনাবাহিনী জেরুজালেমে প্রবেশের পর তাদের নিরাপত্তায় স্থানীয় ছোট্ট সৈন্যদলের প্রয়োজন ছিল। যারা স্থানীয় জনসাধারণের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থেকে তাদের রক্ষা করবে। 

তুরস্কের ইদগির প্রদেশের কর্পোরাল হাসান ছিলেন আল আকসার সর্বশেষ প্রহরী। তিনি ছিলেন অটোমান সেনাবাহিনীর ভারী মেশিনগান দলের একজন সদস্য। ১৯৮২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যিনি উসমানি সেনাবাহিনীর একজন সদস্য হয়ে দীর্ঘ ৫৭ বছর জেরুজালেমের পবিত্র মসজিদুল আকসার প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উসমানি খেলাফত পতনের পরও দীর্ঘকাল তিনি এ দায়িত্ব পালন করে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেন।

১৯৭২ সালের ৪ মে তুরস্কের রাজানীতিবিদ ও সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল ইসরায়েল ও জেরুজালেম পরিদর্শনে যান। জেরুজালেম ভ্রমণের শেষ দিন শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। তুর্কি সাংবাদিক ইলহান বারদাকসিও ছিলেন ওই প্রনিধি দলের মধ্যে। তিনি বর্ণনা করেন, ‘ভ্রমণের চতুর্থ দিনও অন্যান্য সাধারণ ভ্রমণের মতো ছিল। তবে চতুর্থদিন জেরুজালেম এসে এক আবেগময় দৃশ্য অবলোকন করি। তা শুধু আমার জীবনে নয়, বরং ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ 

ইলহান বলেন, ‘ইসরায়েল সরকার আমাদের জন্য ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শনের ব্যবস্থা করেন। আমি মনে মনে জেরুজালেম ও মসজিদুল আকসা দেখার অপেক্ষায় অস্থির। অবশ্য তখন প্রচণ্ড গরম পড়ছে। ঘামে আমার পুরো দেহ ভেজা। আল আকসায় পৌঁছলে আমার মধ্যে কম্পন শুরু হয়। সেখানের ছবি তুলতে গিয়েও হাত কেঁপে ওঠে।’ 

অবশেষে আমরা মসজিদের উঁচু প্রাঙ্গণে গিয়ে উঠি। এ স্থানটি ‘ফিনাউ ইসনাই আশারা আলফি শুমআতান’ বা ১২ শ মোমবাতির চত্বর নামে ইতিহাসে পরিচিত। কারণ ১৫১৬ সালে সুলতান প্রথম সেলিম জেরুজালেম বিজয় করে তাতে ১২ শ মোমবাতি জ্বালিয়েছেন। আর সেনাবাহিনী সদস্যরা রাতেরবেলা বাতির আলোতে ইশার নামাজ আদায় করেছেন।

kalerkantho
মসজিদুল আকসায় সর্বশেষ প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অটোমান সেনা সদস্য কর্পোরাল হাসান। 

এমন সময় সাংবাদিক ইলহান মসজিদ চত্বরে একজন বয়োবৃদ্ধ লোককে দেখতে পান। তাঁর গায়ে খুবই পুরোনো কাপড়। বয়স প্রায় ৯০ বছর হবে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তাঁর গায়ের কাপড়ে অনেক তালি দেওয়া হয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটি সাংবাদিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। 

মসজিদ চত্বরের সরকারি কর্মকর্তাকে বয়োবৃদ্ধ লোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘আমি তাঁর চিনি না। হয়ত কোনো পাগল হবেন। তিনি সব সময় এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। কখনো কারো সঙ্গে কথা বলেন না। কিছু জিজ্ঞেসও করেন না। কারো দিকে তাকান না।’ 

কর্মকর্তার উত্তরে ইলহান সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বলেন, ‘আমার বোঝার বাকি নেই যে, উপযুক্ত কারণ ছাড়া এ চত্বরে কেউ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তবে বুঝতে পারলাম না যে তাঁর ধবধবে সাদা দাড়ি কি দীর্ঘকালের পরিক্রমায় হয়েছে নাকি ভারী বোঝার কারণে।’ 

ইলহান বারদাকসি ভাবছিলেন ৯০ বছর বয়সী এ প্রবীণের সঙ্গে কথা বলবেন কিনা। বৃদ্ধের কাছে গেলেও তিনি নড়লেন না। তখন ইলহান বৃদ্ধকে সালাম দিলেন। বিরক্তি ভাব নিয়ে বৃদ্ধ সালামের উত্তর দেন। সালামের সুরে তুর্কি ভাব ছিল। ইলহান বলেন, আমার হাত কাঁপা শুরু করে। তাহলে ইনি কী তুর্কি? তবে তিনি এখানে কী করে এলেন? নানা প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এখানে কী করছেন জিজ্ঞেস করলে বৃদ্ধ জবাব দেন যে তিনি কর্পোরাল হাসান। অটোমান সেনাবাহিনীর ২০ তম কর্পোরেশন, ৩৬তম ব্যাটালিয়ন ও ৮ম স্কোয়াড্রন ভারী মেশিনগান দলের সদস্য তিনি। নিজের পরিচয় আগের চেয়ে জোর গলায় পুনরায় বললেন। 

‘তাঁর কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করি, ‘কি বললেন, আপনি উসমানি?  এবার তিনি গর্বের সঙ্গে হ্যাঁ বললেন। তিনি বললেন, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড আমাদের তুরস্কের ইগদির প্রদেশের বাসিন্দা কর্পোরাল হাসান। জেরুজালেমে নিয়োজিত অটোমান সেনাবাহিনীল ভারী মেশিনগান দলের সদস্য ছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ৫৭ বছর মসজিদুল আকসার পাহারা দিয়েছেন। 

kalerkantho
মসজিদুল আকসায় সর্বশেষ প্রহরী কর্পোরাল হাসান। 

‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমাদের সৈন্যরা সুয়েজ খাল ফ্রন্টে ব্রিটিশদের ওপর হামলা করেছিল। আমাদের সেনাবাহিনী তাতে পরাজিত হয়। ফলে সেনা প্রত্যাহার আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। একে একে আমাদের পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকারী ভূখণ্ড হাতছাড়া হয়ে পড়ে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশরা জেরুজালেম ফটকে ঢুকে শহরটি দখল করে নেয়। আর আমরা পবিত্র শহরের নিরাপত্তা দিতে রিয়ারগার্ড (rearguard) হিসেবে রয়ে যাই। (তৎকালীন সময়ের যুদ্ধরীতি মতে, বিজিত এলাকায় স্থানীয় সেনাবাহিনীর অল্প সংখ্যক সৈনিক রাখা হয়। যেন জনগন বিজয়ীদের বিরুদ্ধাচরণ করতে না পারে এবং শৃঙ্খলা ও সুরক্ষা বজায় রাখা সহজ হয়)। ইংরেজরা তাঁদের অবস্থান তখনকার রীতি অনুসারে মেনে নেয়। আমরা এখানে ৫৩ জন সদস্য ছিলাম। এমন সময় মন্ড্রোস চুক্তির আলোকে উসমানি সেনাবাহিনীকে ক্ষমতাচ্যুত করার খবর পাই।’ 

তখন ক্যাপ্টেন মোস্তফা আল-ইউজবাশি রক্ষী সেনাদের বলেন, ‘প্রিয় বীর সেনারা, উসমানি সম্রাজ্য কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। আমাদের গৌরবময় সেনাদের দেশছাড়া করা হচ্ছে। প্রিয় ইস্তাম্বুল আমাকে ডাকছে। আমাকে যেতে হবে। এ ডাকে সাড়া দিতে হবে। নতুবা নির্দেশ অমান্য করেছি বলে বলা হবে। তোমাদের কেউ চাইলে স্বদেশে ফিরতে পারবে। তবে আপনাদের বলব, আল কুদস বা জেরুজালেম সুলতান সেলিমের রেখে যাওয়া আমানত। তা ফেলে যাওয়া আমাদের উচিত হবে না। তাই আপনাদের এখানে প্রহরার দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করব। যেন কেউ বলতে না পারে, অটেমান সেনারা চলে গেছে। আমাদের সেনারা প্রথম কিবলার নিরাপত্তার দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবে তাই আমাদে শত্রুদের প্রকৃত বিজয় বলে গণ্য হবে। তাই তোমরা ইসলামের সম্মান ও উসমানি সেনাদের গৌরবকে পদদলিত হতে দেবেন না।’ 

আরও পড়তে পারেন-

অতঃপর বৃদ্ধ বলেন, ‘আমরা কিছু লোক জেরুজালেমে রয়ে যাই। কারণ আমরা একথা শুনতে চাই না যে উসমানি সেনারা জেরুজালেম ছেড়ে চলে গেছে। আমরা চাই না মসজিদুল আকসা চার দশক পর কান্না করুক। আমরা চাই না আমাদের প্রিয়নবী (সা.) কষ্ট পাক। চোখের পলকে  অনেক বছর অতিবাহিত হয়। একেএকে আমার সঙ্গীরা ইহকাল থেকে বিদায় নেয়। শত্রুরাও আমাদের সরাল না। এখন একমাত্র আমি কর্পোরাল হাসান আজ অবধি দীর্ঘ ৪০ বছর পবিত্র আল আকসা পাহারার দায়িত্ব পালন করছি।’ 

এবার সাংবাদিক ইলহান বারদাকসিকে বৃদ্ধ বলেন, ‘আপনি আনাতোলিয়ায় গেলে তোকাত সানজাক এলাকায় যাবেন। সেখানে আমার কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মুস্তফার সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি আমাকে আল আকসা মসজিদে প্রহরায় নিযুক্ত করেন। এ গুরুদায়িত্ব পালনে আমাকে নির্বাচন করেন। আপনি তাঁর হাতে চুমু খেয়ে বলবেন, ‘আপনার নির্দেশনা মতে ইগদির প্রদেশের কর্পোরাল হাসান আজ অবধি জেরুজালেমে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দেননি। তিনি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।’ 

ইলহান বলেন, ‘আমি ইস্তাম্বুল থেকে এসেছেন শুনে বৃদ্ধ লোকটি উসমানি সম্রাজ্যের কথা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু তাঁকে কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি। শুধু এটুকু বলি যে আমাদের দেশ ভালো আছে। তখন তিনি আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করেন, আমাদে ভালো হলে এখানে কেন আসে না? কাফেরদের হাত থেকে আল আকসা মুক্ত করতে আসছে না কেন? আমি বললাম, তাঁরা একদিন আসবেন। ইনশাআল্লাহ।’ 

‘আমি বৃদ্ধের শুকনো হাতে চুমু খেলাম। খুব ভালোবাসা ও আবেগে দোয়া চেয়ে তাঁকে বিদায় জানাই। বিদায়কালে তিনি বললেন, ‘আনাতোলিয়ায় আমার সালাম পৌঁছে দেবেন। দেশবাসীকে সালাম জানাবেন।’ 

‘আমার প্রতিনিধি দলের কাছে ফিরে আসি। আমার পূর্বপুরুষের কীর্তিমাখা গৌরব যেন চোখের সামনে দৃশ্যমান। এখনও একজন উসমানি সেনাবাহিনীর সদস্য গৌরবের সঙ্গে আল আকসায় প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর মন আশায় ভরপুর। দেশের প্রতি তাঁর হৃদয় ভালোবাসায় পূর্ণ।’ 

‘স্থানীয় একজন গাইডকে আমি পুরো ঘটনা জানাই। নিজের ঠিকানা দিয়ে বলি, বৃদ্ধের সব খবর যেন আমাকে জানায়। আর দেশে ফিরে আমি বৃদ্ধের দেওয়া ঠিকানা মতে আনাতোলিয়ায় যাই। অনেক কষ্টকরে উল্লিখিত কমান্ডারের বাড়ি আবিষ্কার করি। কিন্তু জানতে পারি যে তিনি কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। আমি বৃদ্ধকে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হই।’ 

‘কয়েক বছর অতিবাহিত হয়। ১৯৮২ সালে আমি তুর্কি এজেন্সিতে কর্মরত ছিলাম। জেরুজালেম থেকে আমার নামে একটি টেলিগ্রাফ আসে। টেলিগ্রাফটি স্থানীয় ওই গাইড পাঠিয়েছে। তাতে ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কিছু লেখা হয়। অতঃপর বলা হয়, আজ মসজিদুল আকসার সর্বশেষ প্রহরী মারা গিয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৯৩ বছর।’ 

সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।