Home ইতিহাস ও জীবনী বাঙালী উৎসের সন্ধান!

বাঙালী উৎসের সন্ধান!

।। মালেকা ফেরদৌস ।।

মাসুদুল হক নামের এক লেখকের ফেসবুকে একটা লেখা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র বাঙালিত্ব নিয়ে ইতিহাসবিকৃত এক অমার্জনীয় প্রশ্ন হাজির করেছেন। নীতি ও আদর্শের দায়বোধ থেকে এই নিয়ে কিছু না লিখে পারিনি।

উপমহাদেশের এ অঞ্চলে কারা বাঙালী আর কারা বাঙালী না, তা জানতে হলে আমাদের ইতিহাসের অনেক পেছনে যেতে হবে। আর কারাই বা এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র, তাও জানতে হবে। বাংলার ভূমিপুত্র বলতে এখন কেউ নেই। বলা হয়ে থাকে আদি বাংলায় অষ্ট্রিক, দ্রাবিড় আর ভোটচীনা জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। আর ছিল ক্লান বা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা। এখানে সবাই বহিরাগত এমন কি দ্রাবিড়রাও। আর্য, সেমিটিকরা তো বহিরাগতই। সত্তর ভাগ অষ্ট্রিক, বিশ ভাগ ভোটচীনা, পাঁচ ভাগ নিগ্রো, বাকি পাঁচভাগ সেমিটিক, কেন্দ্রীয় এশিয়, কিছু পরিমান ইউরোপীয় রক্ত বাঙালীর শরীরে বহমান।

বাঙালীর শরীরে আর্য রক্ত কমই আছে। এটার অন্যতম কারণ জাতিভেদ প্রথা, বর্ণাশ্রমাশ্রয়ী সমাজ ব্যবস্থা। অসবর্ণে বিবাহ নিষিদ্ধ। যেটুকু আর্যরক্ত আছে, তা মুসলিম ইরানী তুরানীদের মধ্যে বিয়ে ব্যবস্থার ফলে। আর ব্রাহ্মণদের দ্বারা নিগৃহীত অচ্ছুত ছোট জাতের নারীদের মধ্যে (দাস) সংঘটিত অবৈধ সন্তানদের মধ্যে। তাই মিশ্ররক্ত প্রসূত স্বভাব সাঙ্কর্যই বর্তমান বাঙালী আর তার চরিত্র। ভাগ্যান্বেষণের জন্য অনেক জাতী গোষ্ঠীই ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে। শুধু মুসলিমরাই নয়। সিরাজই শুধু অবাঙালি নয়। তার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল তারাও অবাঙালি। বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে যারা জয় পেয়েছিল তারাও বাঙালী নয়।

এজন্যই আমি বাঙালী কারা বলতে চেয়েছি। সেনরাও বাঙালী ছিলেন না। ইংরেজরাও বাঙালী নয়। তবে দোষ কেন শুধু সিরাজের। বরং মুসলিম শাসকেরা এসে এদেশের ভাষা মাটি মানুষের সাথে মিশে গিয়েছিল। এখানের মানুষের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তুর্কি, ইরান, মধ্য এশিয়া ও আরব মুসলিম, যারাই বিজয়ী হয়ে এসেছিলেন তারাই এখানের জনগোষ্ঠির সাথে মিশে গেছেন। কোন কোন শাসকরা ফিরে গেলেও রাজ অমাত্য, সেনাবাহিনী, ইসলাম প্রচারক, পীর আউলীয়ারা ফিরে যাননি। তাঁরা ইসলামের মহান বৈশিষ্ট সাম্য মৈত্রী ভ্রাতৃত্ববোধ দিয়ে সাধারণ মানুষকে জয় করেছেন। শেখ, খান, সৈয়দ, মির্যা, চৌধুরী, সবাই অত্র অঞ্চলের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে গেছেন।

মুসলিমরা জাতিভেদ প্রথা চালু করেনি। এ দেশের মানুষকে রাক্ষস বলে আখ্যায়িত করেনি। বাংলাভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে মুসলিমরা। মুসলিমরা বলেনি বাংলাভাষা পক্ষীভাষা। বলেনি বাংলায় যারা কথা বলবে তারা রৌঢ়ব নামক নরকে জ্বলবে। সিরাজকে নিয়ে বদনামের মিথ ছিল প্রায় ১০০ বছর। ইতিহাসের সত্য একদিন বেরিয়েই আসে। আজ সব সত্য সবাই জানছে। শুধু সিরাজ কেন, কোন ভারতীয় ঐতিহাসিকগণই মুসলিম শাসকদের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি একমাত্র রমেশচন্দ্র মজুমদার ছাড়া। অথচ ভারতবর্ষে মুসলিমদের দান অপরিসীম। রয়েছে ৮০০ বছর শাসনের ইতিহাস। বর্তমানে অবশ্য ভারতে অনেকেই নিরপেক্ষ ইতিহাসে বিশ্বাস করেন এবং সত্যি কথাটিই বলেন।

সিরাজের পরাজয়ের কারণ দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসাজস। এখানে সিরাজ মহান দেশ প্রেমিক। মীর জাফর আলী খান আর তার সহযোগিরা বিশ্বাস ঘাতক। মীর জাফর সিরাজের আত্মীয় বলেই মঞ্চে ছিলেন। বিশ্বাসঘাতকদের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। উমি চাঁদ, রায় দুর্লভ, নন্দ কুমারদের মত মুৎসুদ্দী বাংকাররা। সিরাজের খালা ঘষেটি বেগমও ছিলেন সিরাজের বিরুদ্ধে। সিরাজকে সরিয়ে শাসন ক্ষমতায় যাদের আনা হয়েছিল, তারা কোন বাঙালী ছিলেন?

উপমহাদেশ দু’শ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হল। সে ইতিহাস অনেক করুণ ও দীর্ঘ মর্মবেদনার। পরাধীনতার ১০০ বছর কেবল মুসলিমরাই ইংরেজদের বিরোধিতা করেছে। কারণ তারা রাজ্য হারিয়েছে ভাষা হারিয়েছে এবং নানাভাবে শাসকদের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছে। ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করেনি বলে মুসলিমদের কোন কাজ ছিল না।

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর মুসলিমদের অবস্থা ছিল ভীষণ করুণ। স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলিমদের এই বেদনা উপলব্ধি করে সিপাহি বিদ্রোহের পরে উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য ১৮৭৫ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, শুধু ইংরেজদের বিরোধিতা করে কোন কিছুই হবে না। ঢাকার নবাবরাও তাই করেছিলেন। শুধু ঢাকার নবাবরাই নয়, রবীন্দ্রনাথের পরিবার, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ সমাজ সংস্কারকগণ ইংরেজদের বিরোধিতা না করে কাজ করে গেছেন।

ঢাকার নবাবরা উর্দুভাষী হলেও তাদের জন্ম এদেশেই। তখনকার দিনে প্রত্যেক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ভাষা ছিল উর্দু ও ফার্সী। কাজী নজরুল ইসলামের পারিবারিক ভাষাও উর্দু ছিল। তিনি প্রথম লেখা শুরুই করেছিলেন উর্দুতে। নজরুলের পরিবারের এক পুরুষ ছিলেন লক্ষ্ণনৌর সম্মানিত কাজী। তারা ইংরেজদের তাড়া খেয়ে বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে এসে আশ্রয় নেন।

ঢাকার নবাবরা পূর্ব বাংলার চাষাভুষা মানুষের জন্য করেছেন। তাদের অধিকারের জন্য লড়েছেন । নবাব সলিমুল্লা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে সমার্থন দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল প্রতিষ্ঠায় তাদের অনন্য দান ও শ্রমের কথা আমরা মনে রাখি না। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই পূর্ব বাংলার মানুষের বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তার বিকাশ ঘটে।

বাংলার মুসলমানদের যতটুকু ইতিহাস আজ তার বড় অবদানই এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যায় কিংবা রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার ঐতিহাসিকগণ বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস লেখেনি বা কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। আর আমরা এখন খুঁজি কে বাঙালী আর কে বাঙালী না।

– মালেকা ফেরদৌস; কবি ও কথা সাহিত্যিক