Home রাজনীতি ছাত্র জমিয়তের তরবিয়াতী ইজতেমায় মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী গুরুত্বপূর্ণ যেসব কথা বলেছেন

ছাত্র জমিয়তের তরবিয়াতী ইজতেমায় মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী গুরুত্বপূর্ণ যেসব কথা বলেছেন

ছাত্র জমিয়তের তারবিয়াতী ইজতেমায় বক্তব্য রাখছেন মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। ছবি- উম্মাহ।

শতাব্দীর প্রাচীনতম ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠন, আকাবির ও আসলাফের রেখে যাওয়া আমানত, সৎ রাজনীতি ও আকাবীরে দেওবন্দের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের অঙ্গ সংগঠন ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা ক্যাম্পাস শাখার উদ্যোগে এক তরবিয়াতী (প্রশিক্ষণ) ইজতেমায় গতকাল (১০ আগস্ট) শুক্রবার সকাল ৯টায় শুরু হয়ে বিকেল ৫টায় শেষ হয়।

জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার আল-কাসেম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত তরবিয়াতী ইজতেমায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী। প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর সহসভাপতি ও অন্যতম নীতি নির্ধারক শায়খুল হাদীস আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক। সভাপতিত্ব করেছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় অর্থসম্পাদক এবং ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা ক্যাম্পাস শাখার সভাপতি মুফতী জাকির হোসাইন কাসেমী।

তরবিয়াতী ইজতেমায় বিশেষ আলোচক হিসাবে বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য পেশ করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর যুগ্মমহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। তিনি ছাত্র জমিয়তের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়ে বলেন, রাজনীতির পাঠ অনেক কঠিন ও সাধনার বিষয়। উপযুক্ত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ এবং নীতি-আদর্শের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য ছাড়া রাজনীতি করা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকে অগ্রসর হওয়া অনেকটা মাঝ দরিয়ায় নাবিকহীন জাহাজের মতো। সুতরাং ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত নেতাকর্মীদেরকে আগামীতে দেশ ও জাতিকে দক্ষতার সাথে নেতৃত্ব দিতে মুরুব্বীদের তত্ত্বাবধানে থেকে উপযুক্ত জ্ঞান অর্জন এবং দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করে যোগ্য হয়ে গড়ে উঠতে হবে।

মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী ছাত্র জমিয়তের নেতাকর্মীদেরকে উদ্দেশ্য করে আরো বলেন, রজনীতির ময়দানে সফলতা পেতে হলে এবং উপযুক্ত নেতা হিসেবে গড়ে উঠতে চাইলে ১১টি গুণাবলী অর্জন করতে হবে। এসব গুণাবলী অর্জন করতে না পারলে রাজনীতির ময়দানে কেউ ইতিবাচক ভূমিকা যেমন পালন করতে পারবেন না, তেমনি নেতৃত্বে নিজের দৃঢ় অবস্থানও নিশ্চিত করতে পারবেন না। এই ১১টি গুণাবলী ও যোগ্যতা হচ্ছে, যথা-

১. আদর্শ রাজনীতিবিদ ও নেতাদের জীবনী পড়া। কারণ, রাজনীতির ময়দানে দিক-নির্দেশনা লাভ, প্রতিকূলতার মোকাবেলা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কৌশলী হতে হলে অবশ্যই পূর্বসুরী সফল রাজনীতিবিদদের জীবনী মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। এতে কর্মপন্থা নির্ধারণ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সহযোগিতা পাওয়া যায়।

২. উদারমনা হওয়া তথা অনেক বড় মনের অধিকারী হওয়া। কারণ, সংকীর্ণমনা কোন মানুষ কোন যোগ্যতা বলে নেতা হতে পারলেও তাকে আদর্শ নেতা বলা যাবে না। কারণ, সংকীর্ণমনারা দলের ভেতরে এবং যে কোন দায়িত্বে আসীন হতে পারলে স্বৈরাচারি নেতায় পরিণত হয়ে পড়েন। সংকীর্ণমনারা কখনোই সহকর্মী ও অধঃস্তনদের প্রতি ন্যায়চারি হতে পারেন না, যে কারণে তারা ন্যায়নিষ্ঠ ও জনপ্রিয় নেতা হতে পারেন না। সংকীর্ণমনা হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তারা ঝুঁকি নিতে পারেন না। সবসময় হীনমন্যতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগে থাকেন।

৩. পরোপকারের মানসিকতা লালন করা। একজন সৎ ও দক্ষ রাজনীতিবিদকে অবশ্যই সমাজ, দেশ ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখার মানসিকতা লালন করতে হবে। পরোপকারের চিন্তা লালন করেন, এমন একজন নেতা তৃণমূল পর্যায় থেকে সহজেই সকলের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠতে পারেন। পরোপকারের চিন্তাহীন স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার নেতা কখনোই দলে ও বাইরে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন না।

৪. বক্তব্য, ভাষণ ও বিতর্কে সংযত হওয়া এবং মিষ্টভাষী হওয়া। বৈঠক, জনসভা, জনসমাবেশে ফ্লোর পেলেই অসংযত ও লাগামহীন বক্তব্য দেওয়া যাবে না। বক্তব্য দিতে হবে পরিবেশের চাহিদা অনুযায়ী, গোছানো এবং বিষয়ভিত্তিক। বল্গাহীন আবেগ দিয়ে যেমন যা খুশী তা বলে সস্তা আবেগ তৈরি করা যাবে না, তেমনি বক্তব্য একেবারে আবেগহীনও রাখা যাবে না। বক্তব্য দেওয়ার সময় স্রোতাদের আগ্রহ বুঝে বক্তব্য দিতে হবে। বিরক্ত তৈরি করে, এমন বিষয়ে এবং অতিরিক্ত সময় নিয়ে বক্তব্য দেওয়া যাবে না। বক্তব্যের ভাষা সুমিষ্ট, যৌক্তিক, তথ্যভিত্তিক এবং আকর্ষনীয় উপস্থাপনার চেষ্টা করতে হবে।

৫. দূরদৃষ্টির অধিকারী হওয়া। পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার যোগ্যতা থাকা।

৬. দৃঢ়চেতা মনোভাবের অধিকারী হওয়া। হামলা, মামলা, হুমকি, ধমকির কাছে মাথানত না করার দৃঢ় মানসিকতা লালন করতে হবে। সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেওয়ার সময় যেমন বুদ্ধি-পরামর্শ ও যাছাই বাছাই করে নিতে হবে, তেমনি গৃহীত সিদ্ধান্তে ভুল প্রমাণিত না হলে যে কোন মূল্যে দৃঢ় ও অবিচল থাকতে হবে। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত ও মত পরিবর্তন দুর্বল নেতৃত্বের পরিচায়ক।

৭. দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে সদা সজাগ ও সতর্ক থাকতে পারা। প্রতিকূল বা অনুকূল পরিবেশে কখন কী করতে হবে না হবে, সে বিষয়ে সজাদ ও সতর্ক থাকার গুণাবলী অর্জন করতে হবে। দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে হলে সার্বিক পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে দলীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। জনমনোভাব এবং রাজনীতির গতি-প্রকৃতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। পরিবেশ অনুকূল না থাকলে অনেক সময় ইতিবাচক কথা না বলেও চুপচাপ সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়।

৮. নীতি-আদর্শের উপর অবিচল ও দৃঢ় থাকা। প্রতিকূল পরিবেশে হয়তো চুপ থাকা যায় সাময়িক; কিন্তু কোনভাবেই নীতি বা আদর্শ বদলানো যাবে না। নীতি ও আদর্শহীন রাজনীতিবিদ ব্যক্তিগত পর্যায়ে যত সৎই হোক না কেন, তিনি কখনোই মর্যাদাবান নেতা হতে পারেন না।

৯. একগুঁয়েমি পরিহার করা এবং নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেও গঠনমূলক যে কোন পরামর্শ ও প্রস্তাব গ্রহণে উদার মানসিকতা থাকা। কারণ, একগুঁয়েমি কখনোই মানুষ পছন্দ করেন না। নিজের মতকে সঠিক মনে হলে সেটা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে, অথবা অন্যদেরকে যৌক্তিকভাবে খণ্ডন করার আমন্ত্রণ জানাতে হবে। কিন্তু কোনভাবেই একগুঁয়েমির সাথে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা যাবে না। কারণ, এতে অনেকেই সংক্ষুব্ধ হয়ে পড়তে পারেন, যেটা ভবিষ্যতের জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

১০. নিজেকে খাদেম মনে করা এবং মাখদুম মনে না করা। রাজনীতির ময়দানে সহকর্মী ও অধঃস্থনদের প্রতি সবসময় আন্তরিকতা ও সহযোগিতার মানসিকতা লালন করতে হবে। যথাসাধ্য অন্যদের ভাল-মন্দের খোঁজ-খবর রাখতে হবে। যে কারো প্রয়োজনে সাড়া দিতে হবে। নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা যথাসম্ভব বলাবলি থেকে এড়িয়ে চলতে হবে।

১১. আমানতদার হওয়া। হিসাব-নিকাশ ও যে কোন লেনাদেনা এবং কাজকারবারে স্বচ্ছ্বতা বজায় রেখে চলতে হবে। খেয়ানতের প্রবণতা যার থাকবে, সে কখনো নেতা হতে পারবে না। ক্রমান্বয়ে দলের ভিতরে ও বাহিরে সে সমালোচিত হতে থাকবে এবং এটা তার আগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।

মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী উপস্থিত ছাত্র জমিয়তের নেতাকর্মীদেরকে এই ১১টি বিষয়কে আত্মস্থ করে সেই মতে চলার উপদেশ দেন।

তরবিয়য়াতী ইজতেমা পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সকাল ৯টায় শুরু হয়ে জুমা ও দুপুরের খাবারের বিরতির পর বিকেল ৫টায় আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়। মুনাজাত পরিচালনা করেন জমিয়ত মহাসচিব শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী।