Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ইসলামে পিতা-মাতার হক বা অধিকার

ইসলামে পিতা-মাতার হক বা অধিকার

।। মাওলানা মুহাম্মদ ওমর কাসেমী ।।

মহান রাব্বুল আলামীন আকাশ ও জমিন এবং এতদোভয়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে মানব জাতিকে আশ্রাফুল মাখলুক্বাত তথা সৃষ্টির সেরা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সৌভাগ্যবান করেছেন। তাকে বিবেক-বুদ্ধি-মেধা ও প্রজ্ঞা দান করেছেন। তাই তো তাকে তার খালিক ও মালিক পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে বলে দিচ্ছেন, তোমাদের নিজেদের মধ্যেও তোমরা কি অনুধাবন করো না? (সূরা জারিয়াত- ২১)।

হে বনী আদম! তুমি কি দেখ না যে, বিশ্বব্রহ্মান্ডের মহান সৃষ্টিকর্তা তোমাকে কীভাবে অস্তিত্ব দান করেছেন? “ওয়ালাম তাকু শাইআ” অথচ এর পূর্বে তুমি কিছুই ছিলে না।

প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন, কীভাবে এক ফোঁটা বীর্য গর্ভাশয়ে স্থিতিশীল হয়। অতঃপর কীভাবে বীর্য থেকে একটি জমাট রক্ত তৈরী হয় এবং জমাট রক্ত থেকে মাংস পিন্ড প্রস্তুত হয়, এরপর কীভাবে তাতে অস্থি তৈরী হয় এবং অস্থিকে মাংস পরানো হয়। অতঃপর কীভাবে এই নিস্প্রাণ পুতুলের মধ্যে রূহ সঞ্চার করা হয় এবং পূর্ণাঙ্গরূপে সৃষ্টি করে তাকে দুনিয়ার আলো-বাতাসে আনয়ন করা হয়। এরপর কীভাবে ক্রমোন্নতির মাধ্যমে এই চেতনাহীন-জ্ঞানহীন শিশুকে একজন জ্ঞানী ও কর্মঠ মানুষে পরিণত করা হয়। কীভাবে মানুষের আকৃতিতে বিভিন্নতা দান করা হয় যে, কোটি কোটি মানুষের মধ্যে একজনের চেহারা অন্যজনের চেহারা থেকে কত ভিন্ন ও স্বতন্ত্র্য দৃষ্টিগোচর হয়। কার সাধ্য আছে যে, এই সামান্য চেহারার মধ্যে এত স্বাতন্ত্র ও ব্যবধান বজায় রাখবে? কাজেই এ কথা বলতে বাধ্য যে, “ফাতাবা-রাকাল্লাহু আহ্সানুল খালিক্বীন” এই পবিত্র সত্তা সব কারিগরের চেয়ে সুন্দর কারিগর। সুতরাং বান্দার কৃতজ্ঞতা সেই সত্তার জন্য হওয়া উচিত, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন।

ইরশাদ হচ্ছে, আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর এবং তোমার পিতা-মাতার। অর্থাৎ মহান আল্লাহ বলছেন- হে আমার বান্দা! তুমি আমার সৃষ্টি দেখে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে অথচ তোমার এ ক্ষুদ্র অস্তিত্বে আমার কুদরতের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তা তোমার জন্মদাতা সম্মানিত পিতা-মাতার মাধ্যমে ঘটেছে। কাজেই তোমার পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় করাও তোমার কর্তব্য। কিন্তু এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আজ আমাদের মুসলিম সমাজে সম্মানিত পিতা-মাতাগণ উপেক্ষিত, অবহেলিত, বরং অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের হাতে নির্যাতিত ও নিগৃহীতও। (নাঊযুবিল্লাহ্)।

মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, হে বিশ্ব মানব! ইবাদত কর একমাত্র আমারই, কারণ আমি তোমাদের সৃষ্টিকর্তা। যেহেতু তোমার এ ক্ষুদ্র অস্তিত্বটুকু আমার অনুগ্রহে সৃষ্টি সেহেতু অবনত মস্তকে আমারই সামনে দন্ডায়মান হওয়া চাই। হে মানব সকল! ইবাদত কর ঐ রবের যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। (সূরা বাক্বারাহ্- ২১ আয়াত)।

অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। আর তোমার পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর। (সূরা নিসা- ৩৬)।

এখানে লক্ষ্যণীয়, উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য দু’টি আদেশ করেছেন- (এক) ইবাদত কর আল্লাহর (দুই) তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। অতঃপর আদেশ দু’টির সাথে তৃতীয় আরেকটি আদেশ জুড়ে দিয়েছেন- তোমার জন্মদাতা পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর। আল্লাহর ইবাদতের সাথে সাথে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়ে এদিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে সব নিয়ামত ও অনুগ্রহ একান্তই আল্লাহর পক্ষ থেকে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

কিন্তু বাহ্যিক উপায়-উপকরণের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহর পরে মানুষের এ ক্ষুদ্র অস্তিত্বের প্রতি সর্বাধিক ইহ্সান ও অনুগ্রহ রয়েছে পিতা-মাতার। পিতা-মাতার মাধ্যমেই মানুষের এ ক্ষুদ্র অস্তিত্ব জন্ম লাভ করেছে। শুধু তা-ই নয়, গর্ভাশয়ে বীর্য সঞ্চারের পর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত মায়ের এবং জন্ম থেকে যৌবন প্রাপ্তি পর্যন্ত পিতা-মাতা উভয়েরই সন্তানের জন্য একটি কঠিন-বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়। তা সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার একান্ত অনুগ্রহ বৈ কিছু নয়।

ইরশাদ হচ্ছে, আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি, তার জননী তাকে কষ্টসহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়াতে লেগেছে ত্রিশ মাস। অবশেষে সে যখন শক্তি সামর্থের বয়সে ও চল্লিশ বছরে পৌঁছেছে, তখন বলতে লাগল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে এরূপ ভাগ্য দান কর, যাতে আমি তোমার নিয়ামতের শোকর করি…..। (সূরা আহ্ক্বাফ- ১৫ আয়াত)।

অর্থাৎ পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার, তাদের সেবা-যত্ন ও তাদের প্রতি আনুগত্য জরুরী তথা ফরয এ জন্য যে, তারা তোমার জন্য অসহনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন। বিশেষতঃ সন্তানের প্রতি মায়ের কষ্ট তুলনামূলক বেশী হয়ে থাকে। তাই উক্ত আয়াতে মাতার কষ্টের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে যে, তোমার মাতা তোমাকে দীর্ঘ নয়টি মাস পর্যন্ত গর্ভে ধারণ করেছেন, প্রসব বেদনার অসহ্য কষ্টসহ অনেক যন্ত্রণা শুধু মা-কেই সহ্য করতে হয়েছে। শুধু তাতেই শেষ নয়, সন্তান জন্মের পরও মা রেহাই পান না। যেহেতু সন্তানের উত্তম খাদ্য আল্লাহ তাআলা মায়ের স্তনে রেখে দিয়েছেন, তাই মা তাঁর আদরের দুলালকে দুই বছর কাল পর্যন্ত স্তন্য দান করেন।

আরও পড়তে পারেন-

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু’বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। (সূরা লুকমান- ১৪ আয়াত)।

উক্ত আয়াতেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে তার জন্মদাত্রী মায়ের কষ্টের বিবরণ শুনিয়েছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকারের সাথে সাথে তোমার পিতা-মাতারও কৃতজ্ঞ হও। অন্যথায় আমার নিকট যখন ক্বিয়ামতের দিন ফিরে আসবে, তখন তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইব্নে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জিহাদের অনুমতি চেয়ে উপস্থিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পিতা-মাতা জীবিত আছেন কি? সে বলল, জ্বী হাঁ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তাহলে তুমি পিতা-মাতার সেবায় আÍনিয়োগ করেই জিহাদ কর। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)। অর্থাৎ তাদের সেবা-যত্নের মাধ্যমেই তুমি জিহাদের ফযীলত লাভ করবে, সাওয়াব পেয়ে যাবে।

উক্ত হাদীসের আলোকে উলামায়ে কিরাম বলেন, যে পর্যন্ত জিহাদ ফরযে আইন না হয়ে যায়, ফরযে কিফায়ার স্তরে থাকে, সে পর্যন্ত পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতিরেকে সন্তানের জন্য জিহাদে যোগদান করা জায়েয নয়। যদি কেউ এতটুকু জ্ঞান হাসিল করে যদ্বারা সে হারাম-হালাল, ফরয-ওয়াজিব নির্ণয় করতে পারে, তার জন্য পিতা-মাতার অনুমতি ছাড়া বড় আলেম হওয়া বা পান্ডিত্য অর্জনের জন্য সফর করাও জায়েয নয়। দুনিয়ার ইল্ম অর্জন করার বেলায়ও সেই একই বিধান। এমনকি দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগে পর্যন্ত পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতিরেকে সফর করা জায়েয নয়।

বাইহাক্বী শরীফের এক রিওয়ায়াতে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, সব গুনাহ আল্লাহ তাআলা মাফ করে দেন কিন্তু যে ব্যক্তি পিতা-মাতার সাথে নাফরমানী করে, তাদের মনে কষ্টদায়ক হয় এমন কাজ করে, তাকে পরকালের পূর্বে দুনিয়াতেই বিভিন্ন বিপদাপদে লিপ্ত করে দেওয়া হয়। (ইমাম হাকেম মুস্তাদরাক গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন, হাদীসের সনদ বিশুদ্ধ-৪/১৫৬)।

আমাদের বর্তমান সমাজে পিতা-মাতার সাথে অসদাচরণের শাস্তির অসংখ্য দৃষ্টান্ত দৃষ্টিগোচর হয়। এমনই একটি বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করছি। জনৈক ব্যক্তি তার বৃদ্ধ পিতাকে তার পা বেধে টেনে-হেঁচড়ে ঘর থেকে বের করে বাড়ীর আঙ্গিনা পেরিয়ে রাস্তায় ফেলে আসছে, এমন সময় বৃদ্ধ পিতা কেঁদে কেঁদে সন্তানকে লক্ষ্য করে বলছেন, আমি যখন তোর মত যুবক ছিলাম, তখন তো আমি আমার বৃদ্ধ পিতাকে টেনে-হেঁচড়ে ঘরের আঙ্গিনা পর্যন্তই এনেছিলাম কিন্তু তুই তো আমাকে সদর রাস্তায় ফেলে দিলি? সন্তান জবাবে বলে, অতিরিক্ত শাস্তিটুকু আমার পক্ষ থেকে তোমাকে আসলের সঙ্গে সুদ হিসেবে দেওয়া হল। (নাঊযুবিল্লাহ্)।

হযরত আবু হুরাইরাহ (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, লাঞ্ছিত হয়েছে! লাঞ্ছিত হয়েছে! লাঞ্ছিত হয়েছে! যে ব্যক্তি পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে বার্ধক্যাবস্থায় পেয়েও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। (মুসলিম শরীফ)।

হযরত মুয়াজ ইব্নে জাবাল (রাযি.) বলেন,  রাসূলুল্লাহ (সা.) দশটি অসীয়ত করেছিলেন। তন্মধ্যে একটি হল, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, যদি তোমাদেরকে সেই জন্য হত্যা কিংবা অগ্নিদগ্ধও করা হয়। দ্বিতীয়টি হল, আপন পিতা-মাতার নাফরমানী কিংবা তাদের মনে কষ্ট দিবে না। যদি তারা এমন নির্দেশও দিয়ে দেন যে, তোমরা তোমাদের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ ত্যাগ কর। (মুসনাদে আহমদ)।

কিন্তু অতি আফসোসের সাথে বলতে হয়, বর্তমান মুসলিম সমাজে এমন অনেক মুসলমানকেই পাওয়া যাবে, যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছেন, রমযানের রোযা রাখছেন, হজ্ব করছেন, নিয়মিত দান-খয়রাত করছেন- অথচ তারা পিতা-মাতার সাথে সুন্দর-সদ্ব্যবহার করছেন না। অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তাদের সাথে কথাবার্তা বলেন। এমন কি অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য এ মহান ব্যক্তিদ্বয়ের সাথে ঝগড়ায় পর্যন্ত মেতে উঠেন। [চলবে]

  • মাওলানা মুহাম্মদ ওমর কাসেমী, উস্তাদুল হাদীস ও ওয়াল ফিক্বহ- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।