Home ইসলাম পবিত্র ঈদুল আযহাঃ একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

পবিত্র ঈদুল আযহাঃ একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

।। শায়খুল হাদীস আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক ।।

ইসলামের দু’টি বৃহৎ আনন্দ উৎসবের একটি হলো ঈদুল আযহা। ‘ঈদ’ অর্থ খুশী, আনন্দ, ঐক্য, আর আযহা অর্থ কুরবানীর দিন। একত্রে ‘ঈদুল আযহা’-এর অর্থ দাঁড়ায় কুরবানী দিনের আনন্দ। ৯ই যিলহজ্ব পবিত্র হজ্ব অনুষ্ঠানের দিন। এর পরদিন সারা বিশ্বে মুসলমানদের ঈদুল আযহার নামায ও কুরবানী অনুষ্ঠিত হয়।

ইসলামের আনন্দ উৎসবের বৈশিষ্ট হলো এগুলো নিছক আনন্দ উৎসবই নয় বরং এর আনন্দ হচ্ছে উৎসর্গের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের আনন্দ।

ঈদুল ফিতরের সাথে সাদকাতুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার সাথে কুরবানী সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আর এর মধ্যে এমন কিছু শরয়ী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন সমাজ জীবনে অন্ততঃ উৎসবের দিনে ধনী-দরিদ্র সকলের মাঝে এক আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়।

উভয় উৎসবেই ধনীদেরকে গরীবদের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাদ্কাতুল ফিত্র, কুরবানীর গোশ্ত, কুরবানীর চামড়া ইত্যাদি দরিদ্রের মধ্যে বন্টনের মাধ্যমে তাদেরকেও আনন্দ উৎসবে শরীক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর অনুকূলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার পাক কালামে ঘোষণা করেছেন- “আমি প্রত্যেক উম্মতের উপর কুরবানী এই উদ্দেশ্যে নির্ধারিত করেছি যেন তোমরা ঐ নির্দিষ্ট পশুগুলোর উপর (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। অনšত্মর তার কতক অংশ নিজে ভক্ষণ কর এবং ফকীর-মিসকীনকে ভোজন করাও।” (সূরা হজ্ব, ৩৬ আয়াত)।

‘কুরবানী’ আরবী শব্দ। এর অর্থ হলো নৈকট্য, উৎসর্গ, বিসর্জন, ত্যাগ ইত্যাদি। পরিভাষাগত এর অর্থ হলো নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ত্যাগ বা উৎসর্গ করা। বিশেষ কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করাই হলো কুরবানী।

শরীয়তের ভাষায় কুরবানী হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে যিলহজ্ব মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত পশু জবাই করা। নিসাব পরিমাণ যাদের সম্পদ রয়েছে ইসলামী শরীয়তে তাদের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।

প্রচলিত কুরবানী প্রবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)এর সুমহান স্মৃতি। হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং হযরত ইসমাঈল (আ.) উভয়েই নবী ছিলেন।

স্মর্তব্য, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে যত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছিলেন তাদের প্রত্যেককেই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবে হযরত ইবরাহীম (আ.)এর ক্ষেত্রে তা ছিল সর্বাধিক।

আল্লাহর নেয়া বিশেষ বিশেষ পরীক্ষায় তথা নমরূদের আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া, পরিবার পরিজনকে জনশূন্য প্রান্তরে নিক্ষেপ করা, অনেক আশা আকাংখার পর পাওয়া পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যাত হওয়া ইত্যাদি সকল পরীক্ষায় তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)এর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে প্রতি বছর যিলহজ্ব মাসের নির্দিষ্ট তারিখে উম্মতে মুহাম্মদীকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানীর প্রতীক হিসেবে পশু কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন।

বস্তুতঃ ঈদুল আযহার আনন্দ উৎসবের দিনগুলোতে আত্ম-কুরবানীর প্রতীক হিসেবে পশু কুরবানীর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি তথা মানব দেহের মধ্যস্থিত পশুশক্তি প্রভৃতি নির্মল করে মহান আল্লাহর প্রেমে একজন প্রকৃত মু’মিন আত্ম-কুরবানী করতে পারে কিনা তারই একটি পরীক্ষা।

পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বশর্ত হলো আত্মপরিশুদ্ধি ও আল্লাহর প্রতি পবিত্র প্রেম। কাজেই সেই অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে চাই আত্মার পবিত্রতা, চাই ত্যাগের মন। কেননা, আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় সৃষ্টির প্রতি প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা, সৃষ্টি হয় ত্যাগের মন-মানসিকতা। দূর হয় মনের সকল কালিমা। আর এই সৃষ্টি প্রেমের মাধ্যমেই লাভ করা যায় স্রষ্টার প্রেম। আর তাই আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, “মু’মিনের সর্বাধিক প্রেম হবে আল্লাহরই জন্য।” (সূরা বাক্বারা, ১৬৫ আয়াত)।

আরও পড়তে পারেন-

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষ জাতিকে কেবল তাঁরই ইবাদত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেন নি। কাজেই স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করাই সর্বোত্তম পথ। মানুষ তার জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রতিটি পদক্ষেপে স্রষ্টার উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করবে এটাই মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। আর তাই প্রতিটি মুহূর্তে মু’মিনের অন্তরে আল্লাহ প্রীতি, আল্লাহ ভীতি থাকতে হবে এবং সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে আল্লাহর মহৎ উদ্দেশ্যকে পৃথিবীর বুকে বাস্তবায়িত করার জন্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত ইবরাহীম (আ.) যেমন মানসিকতা নিয়ে প্রাণ প্রতীম পুত্রের মায়া-মমতা-ভালবাসা ত্যাগ করে কুরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন, আমরা কি সেই মন-মানসিকতা নিয়ে তা করতে পারছি? কুরবানীর উদ্দেশ্য তো এই যে, পশু কুরবানীর মাধ্যমে আমাদের মধ্যস্থিত যত পশু শক্তি তথা কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ পরশ্রীকাতরতা, পরনিন্দা প্রভৃতি মন থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলে একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেখানো পথে চলা এবং আল্লাহর রিযামন্দী হাসিল করা। কেননা, আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, “এইসব পশুর রক্ত আর গোশ্ত আল্লাহর নিকট কিছুই পৌঁছে না বরং তোমাদের তাক্বওয়াই তাঁর নিকট পৌঁছে থাকে”। (সূরা হজ্ব, ৩৭ আয়াত)।

এই যে প্রতি বছর আমরা আত্ম-কুরবানীর প্রতীক হিসেবে লাখ লাখ পশু কুরবানী করছি, তা কি শুধু পশু নিধনই হচ্ছে, নাকি কুরবানীর এই শাশ্বত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের কুপ্রবৃত্তিগুলোকে ত্যাগ করতে পারছি? বলা হচ্ছে- “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কোন প্রতিদান বা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমাদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু তাঁরই উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে পার”।

কাজেই শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্ম-কুরবানীর প্রতীক হিসেবে নিছক একটি পশু জবাই করলেই চলবে না বরং হযরত ইবরাহীম (আ.) যেমন মানসিকতা নিয়ে আল্লাহর রিযামন্দী তথা নৈকট্য লাভের জন্য প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন এবং পুত্রও একই উদ্দেশ্যে পিতার ছুরির নিচে নিজের গলা এগিয়ে দিয়ে আত্মত্যাগের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তেমনিভাবে আমাদেরকেও কুরবানীকে স্মরণ করে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। নিজেদেরকে আল্লাহর পথে তথা মানব কল্যাণে উৎসর্গ করতে হবে।

বস্তুতঃ পশু কুরবানীর সাথে সাথে আমাদের কুপ্রবৃত্তি তথা পশুশক্তির কুরবানী করে আল্লাহর হুকুম সঠিকভাবে পালন করতে হবে এবং মানব কল্যাণে নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে হবে। এবং ত্যাগ ও উৎসর্গের মাধ্যমে অসহায় নিরন্ন আশ্রয়হীন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। তবেই ব্যক্তি, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নেমে আসবে অনাবিল সুখ-শান্তি। তা হলেই ঈদুল আযহার আনন্দ সত্যিকারের আনন্দ হবে।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রত্যেককেই ঈদুল আযহা ও কুরবানীর তাৎপর্য বুঝবার এবং আত্মোৎসর্গের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবার তাওফীক ইনায়েত করুন। আমীন॥

লেখকঃ প্রবীণ বিশিষ্ট আলেমে-দ্বীন, গবেষক ও গ্রন্থলেখক, শায়খুল হাদীস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা, সহসভাপতি ও অন্যতম নীতিনির্ধারক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।