Home ওপিনিয়ন ঈদ-উল-আযহা কেন্দ্রিক অপসংস্কৃতি

ঈদ-উল-আযহা কেন্দ্রিক অপসংস্কৃতি

।। মাওলানা তানভীর সিরাজ ।।

আমরা দিনাতিপাত করছি বড়ই অসহায় হয়ে, প্রতারিত হয়ে। যেমনটা অসহায় হয়ে অপারগতার জীবন অতিবাহিত কারাবরণ করা নীরহ মানুষগুলো। আমরাও আজ কালোদিন-রাত পাড়ি দিচ্ছি। আমাদের প্রতারিত করতে সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিতাড়িত মারদূদ শয়তান। প্রতিনিয়ত নীরবচারীর ভূমিকা পালন করছে উম্মতে মুহাম্মদির ইবাদতে অপসংস্কৃতি ঢুকিয়ে দিয়ে জাহান্নাম বাসী করার জন্য ঘোষিত শত্রু শয়তান।

কুরবান কেন্দ্রিক কিছু অপসংস্কৃতির নমুনা আপনাদের সামনে আলোচনা করবো। যথা-

মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গরু দেয়া

আজকের সময়টি আমাদেরকে বেশ কিছু অপসংস্কৃতি উপহার দিয়েছে। এই যে দেখুন, আপনি মেয়ে বিয়ে দিলেন রমজানের আগে। ঠিক তিন মাস পর কুরবানির ঈদ। আপনি রমজানের ঈদে চিত্তাকর্ষক ঈদের জামাকাপড় বেয়াই বেয়াইনসহ সবার জন্য বেয়াইর বাড়িতে পাঠালেন। মেয়েও অনেক খুশি। মেয়ের শ্বশুরালয়ের সবাই তো খুব খুশি হবেই। আগের খুশিটার ধারাবাহিতা বজায় রাখতে মেয়ের বাবাকে বাধ্য করল সামাজিক অপসংস্কৃতি।

এবার এলো কুরবানির ঈদ। কুরবানিতে যদি মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে কিছু একটা গরু-ছাগল দিতে না পারি তাহলে আমার যেমন মান ইজ্জত যাবে তেমনি মেয়ের মধ্যেও একটা অস্থিরতা কাজ করবে। এমনটাই ভাবেন মেয়ের বাবা।

এ অস্থিরতার জন্য কাকে আমরা দায়ী করতে পারি? সামাজিক উচ্চস্তর, মাধ্যমিক আর না নিম্নস্তর; আমরা কাকে এ বদ রছমের অপরাধটা চাপিয়ে দিতে পারি?

এই অপসংস্কৃতি, বিদআত বা বদরছমের মূলকথা হল ‘মানুষ আমাকে কী বলবে?’ আর এখানেই হয় যত সমস্যা আর পেরেশানির শুরু। সমস্যাটা চিহ্নিত করতে গিয়ে আমরা লোকদেখানো বা লৌকিকতাকেই খুঁজে পাই। যার আরবি রিয়া এবং বাংলায় লোকদেখানো। আর রাসূল সা. যাকে শিরিক বলে ঘোষণা করেছেন। মূলপাঠ-

عن معاذ بن جبل سمعت سول الله صلي الله عليه وسلم يقول ان يسير الرياء شرك. (مشكوة المصابيح অর্থ- হযরত মু’আয বিন জাবাল র. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলের সা. জবানিতে শুনেছি। তিনি বলেন, নিশ্চয় সামান্য রিয়া বা লৌকিকতাও শিরিক (ছোট শিরিক)।(মিশকাত শরীফ, পৃ. ৪৫৫)।

আমরা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখবো, আজকাল বেয়াইর বাড়িতে কুরবানিসহ বিভিন্নসময় যে উপহার দেয়া হয়, তার অধিকাংশই দেয়া হয়, বেয়াই বেয়াইনকে খুশি করার লক্ষ্যে আর মেয়েটাও যেন তাদের আদর সমাদরে থাকে। এটাকেই নবী আ. রিয়া বা শিরিক বলেছেন।

সারকথা, আমরা যদি দ্বীন বুঝে এমন পরিবারের সাথে সম্পর্ক করি তাহলে আমাকে আপনাকে আর এই শিরিকে পড়তে হবে না আর মানসিক পেরেশানিতেও নিমজ্জিত হতে হবে না, ইনশাআল্লাহ।

লজ্জায় পড়ে কুরবানি করা

আমার কাছে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ( ৫২.৫) তোলা রূপা অথবা রূপার সমপরিমাণ সম্পদ না থাকে তাহলে আমার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না। আমি সমাজের মান্যগণ্য মানুষ। সমাজে আমার একটা সামাজিকভাবে অবস্থান আছে, এখন আমি যদি কুরবানি না করি, মানুষ আমাকে কী ভাববে! আমাকে কী বলবে! তাই আমি বাধ্য হয়ে কুরবানি করি, আমাকে কুরবানি করতে হয়।

এখন প্রশ্ন হল, এমন ব্যক্তি যদি শরীকী কুরবানি (কয়েকজন মিলে কুরবানি) করে, তাহলে বাকি শরীকদারের কুরবানির কী হুকুম?

উত্তর- সহজ উত্তর হল এমন শরীকদারের সাথে কারোই কুরবানি হবে না।(বাদায়েউস সানায়ে,খ,৪, পৃ:২০৮, কাযীখান, খ. ৩, পৃ : ৩৪৯)।

মন্তব্য: এক মুফতি সাহেবের সাথে আলোচনা করে যা পেলাম, বাকিদের কুরবানি না হওয়ার কারণ হল, একটা গরুতে সাতভাগ হিসেবে সাতজনের নিয়তই থাকতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। তবে একজনের নিয়ত যদি হয়ে থাকে লজ্জায় পড়ে কুরবানিতে ভাগ দেয়া, তাহলে অন্যদেরও কুরবানি হবে না। যেহেতু একটি ভাগ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়নি। যদিওবা বাকি ছয়ভাগ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়।

সুদি টাকা নিয়ে কুরবানি করা

” احل الله البيع و حرم الربا ” আল্লাহ্‌ বলেন- আমি ব্যবসায়কে হালাল করেছি এবং সুদকে হারাম ঘোষণা করেছি।’ [সূরা-বাক্বারাহঃ ২৭৫]

সুদের অনেক হাদীস থেকে একটি হাদীস পেশ করা হল। আর রাসূল (সা.) বলেছেন, “এক দিরহাম পরিমাণ সুদ খাওয়া আল্লাহর নিকট ৩৬ বার ব্যভিচার করার চাইতে অধিক গুনাহের কাজ।” [মুসনাদে আহমাদ, ৫/২২৫, হা/২১৯৫৭; দারাকুতনী, হা/২৮৪৩; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১০৩৩; মিশকাত, হা/২৮২৫]

আর ইসলামের নীতি হল হারামকে তখন গ্রহণ করা যায় যখন নিজের জান যাবার উপক্রম হয়। তাও আবার ঐটুকু যেটুকু হলে জীবন বাঁচে, জীবন নাশের আশংকা দূরিভূত হয়। মোটকথা, কুরবানি এমন একটি ইবাদত, যা না করলে আমার জীবন ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এমন নয়। তাই সুদি টাকা নিয়ে কুরবানি করা বৈধ নয়, ছাওয়াবের স্থানে গুনাহ হবে। লাভের চে’ ক্ষতি বেশি হবে। জান্নাত না পেয়ে জাহান্নাম পাবে।

মুরগী যবাই

কুরবানির দিনগুলোতে কুরবানির নিয়তে মুরগী জবেহ করাকে ইসলামী সংস্কৃতি অপসংস্কৃতি বলে ঘোষণা করেছে।

মন্তব্য: কুরবানিতে ছয় প্রকারের গৃহপালিত পশু ছাড়া কুরবানি শুদ্ধ হবে না। তা হল উট, গরু, মহিষ, ছাগল, দুম্বা আর ভেড়া। ( কুরবানির ইতিহাস ও জরুরী মাসায়েল,মুফতি শফী র., পৃ :২৮)।

কুরবানির পশুকে সাজসজ্জা

কুরবানির পশুকে ক্রয় করার পর লালসালু, গলারমালা আর বিভিন্নজাতের ফুল দিয়ে সাজসজ্জা করা আর অলিগলিতে ঘোরানো আর লোকমুখে বাহ বাহ আর মারহাবা গ্রহণ করা, যাকে আল্লাহর নবী সা. শিরিক বলেছেন। হাদীসটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এখানে শুধু তার অর্থটি প্রদান করা হল। হযরত মু’আয বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলের সা.) জবানিতে শুনেছি। তিনি বলেন, নিশ্চয় সামান্য রিয়া বা লৌকিকতাও শিরিক (ছোট শিরিক)। (মিশকাত শরীফ, পৃ. ৪৫৫, কুরবানির ইতিহাস ও জরুরী মাসায়েল, মুফতি শফী র., পৃ:২৮)।

তাই আসুন,আমরা শুধু আল্লাহর জন্য কুরবানি করি এবং শয়তানের হলুদ নকশা থেকে বাঁচার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের ইসলামের সঠিক বুঝ দান করেন। আমীন।।