Home লাইফ স্টাইল বিরিয়ানির ইতিবৃত্ত: কীভাবে জন্ম হল আজকের বিরিয়ানির?

বিরিয়ানির ইতিবৃত্ত: কীভাবে জন্ম হল আজকের বিরিয়ানির?

বিরিয়ানি, তুমি কার?— বিরিয়ানির ইতিবৃত্ত খুঁজতে বসলে এ দ্বন্দ্ব চিরকালীন। সুদূর পারস্য নাকি মুঘল ভারতবর্ষ, কোন দেশী ঘরানায় বিরিয়ানি পেয়েছে তার আধুনিক রূপ, তা নিয়ে রসিকমহলে নানা মতভেদ। এরপর যথানিয়মে স্থান-কাল ভেদে রন্ধনপ্রণালীর বদলের সঙ্গে বিরিয়ানির মশলাতেও এসেছে বদল। ফলে আওয়াধ থেকে শুরু করে হায়দ্রাবাদি, ঢাকাই, কলকাত্তাইয়া ইত্যাদি হরেক কিসিমের বিরিয়ানি এখন জনপ্রিয়। তবে বিরিয়ানি যেমনই হোক, বিরিয়ানির নামে জিভে পানি আসে না, এমন মানুষ কমই আছেন। কিন্তু কীভাবে উৎপত্তি হল বিরিয়ানির? কবে থেকেই বা শাহি হেঁশেলে বিরিয়ানি রান্না শুরু হল? আজ আমরা বিরিয়ানির ইতিবৃত্ত নিয়ে কথা বলব। সঙ্গে রইল মাটন লাখনৌয়ি বিরিয়ানির দুর্দান্ত রেসিপি।

বিরিয়ানির ইতিবৃত্ত: পারস্যই কি জন্মস্থান?

কেউ বলেন বিরিয়ানির আদি উৎস পারস্যে। ফার্সি শব্দ ‘বিরিয়ান’ ও ‘বিরিঞ্জ’ থেকেই বিরিয়ানির উৎপত্তি। ‘বিরিয়ান’-এর অর্থ হল রান্নার আগে ভেজে নেওয়া এবং ‘বিরিঞ্জ’-এর অর্থ চাল। এই ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’ বা ভাজা চালই কালক্রমে বিরিয়ানিতে রূপ পায়। প্রাচীন পারস্যে ডেগ (বড় পাত্র)-এর মধ্যে মশলায় ম্যারিনেট করে রাখা মাংস দমে বসানো হত এবং ভাজা চাল নানা সুগন্ধী সহযোগে স্তরে-স্তরে সাজিয়ে দেওয়া হত, যাতে মাংসের রসে ‘স্লো কুকিং’ পদ্ধতিতে ভাত, মাংস উভয়েই সুসিদ্ধ হয়ে যায়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, পারস্য থেকে হিন্দুকুশ পেরিয়ে মুঘলদের হাত ধরেই বিরিয়ানি পা রাখে ভারতীয় উপমহাদেশে।

আরও পড়তে পারেন-

আবার কারওর মতে, দিগ্বিজয়ী বীর তৈমুরের হাত ধরে ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিরিয়ানির আগমন ঘটে এদেশে। তারপর শাহি বাবুর্চিখানায় বাদশাহের হুকুমে তরিবত করে চাল আর মাংস, মশলা সহযোগে বিরিয়ানি রান্না শুরু হয়। মুঘল রাজত্বের শেষে যখন আওয়াধ, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি এলাকায় স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন মুঘল বাবুর্চিরা পাড়ি জমাতে শুরু করেন এইসমস্ত রাজ্যে। সেখানে নবাবদের আনুকূল্যে ও স্থানীয় মশলা সহযোগে বিরিয়ানি নবরূপ পায়। এরপর, আওয়াধের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় নির্বাসিত হলে তাঁর অনুগ্রহে কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানির চল শুরু হয়। মজার ব্যাপার, কলকাতার বিরিয়ানিতে আলু না থাকলে কিন্তু সেটি একপ্রকার ‘অপরাধ’ বলে ধরে নেওয়া হয়!

বিরিয়ানির ইতিবৃত্ত: মুমতাজ মহলই কি বিরিয়ানির রূপকার?

বিরিয়ানির ইতিবৃত্ত-এর নেপথ্যে আর একটি কাহিনিও বহুল প্রচলিত। ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যুদ্ধ করার জন্য মুঘল বাদশাহদের অধীনে ছিল শক্তিশালী ফৌজ। একবার বাদশাহ শাহজাহানের স্ত্রী মুমতাজ মহল সেনা ছাউনিতে গিয়ে দেখেন, সৈন্যরা পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে ধুঁকছে। তখনই নাকি মুমতাজ সৈন্যদের জন্য মাংস, চাল ও মশলা সহযোগে পুষ্টিকর একটি পদ বানানোর হুকুম দেন। চটজলদি রান্না হওয়ার জন্য ঘি, মাংস, চাল, মশলা, জাফরান একসঙ্গে মিশিয়ে কাঠের চুলায় রান্না করা হয়। সুস্বাদু মশলাদার এই পদটিই নাকি বিরিয়ানির আদিরূপ। বিরিয়ানির জনপ্রিয়তার নেপথ্যে

মুঘল বাদশাহদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশ, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে।

দেশীয় মশলা আর ‘পিলাফ’-এর মিলমিশ!

ঐতিহাসিক লিজি কলিংহ্যাম বিরিয়ানির ইতিবৃত্ত খুঁজতে গিয়ে বলেন, আধুনিক বিরিয়ানি রূপ পেয়েছিল মুঘল শাহি হেঁশেলেই। দেশীয় মশলা এবং পারস্যের ‘পিলাফ’-এর মিলমিশে বিরিয়ানির উদ্ভব। অনেকে বলেন, মুঘল বাদশাহ বাবরের ভারত আক্রমণের পূর্বেই এদেশে বিরিয়ানি বা ওই গোত্রের কিছু পদের চল ছিল। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় অব্দ নাগাদ এক তামিল গ্রন্থে ‘উন সোরু’ নামক একধরনের পদের কথা জানা যায়, যেটি চাল, ঘি, মাংস, হলুদ, ধনে, গোলমরিচ ও তেজপাতা সহযোগে রান্না করা হত। তামিল যোদ্ধামহলে এই উন সোরুর যথেষ্ট কদর ছিল।

ঐতিহাসিক আল বিরুনির জবানবন্দিতেও সুলতানি আমলের দস্তরখোয়ানে পরিবেশিত বিরিয়ানির মতো কিছু পদের সন্ধান মেলে। খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতকের ‘আইন-ই-আকবরি’-তে আবার বিরিয়ানি এবং ‘পিলাফ’-কে সমগোত্রীয় বলে ধরা হয়েছে। তবে ‘পিলাফ’ বা পোলাওয়ের সঙ্গে বিরিয়ানি রান্নার ক্ষেত্রে মূলগত কিছু তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। পোলাওয়ের ক্ষেত্রে মাংস, সবজি ইত্যাদি ভাতের সঙ্গে ভেজে পরিমাপমতো জল দিয়ে ঢিমে আঁচে বসিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে বিরিয়ানির ক্ষেত্রে চাল এবং মাংস অর্ধেক রান্না করে একসঙ্গে সাজিয়ে বড় ‘হান্ডি’-তে দমে বসিয়ে দেওয়া হয়।

কীভাবে বানাবেন মাটন লাখনৌয়ি বিরিয়ানি?

সাধারণত পারস্যের দম পুখত স্টাইলেই বর্তমানে বিরিয়ানি রান্না করা হয়। মাংস, চাল অর্ধেক রান্না করে একসঙ্গে মশলা ও গোলাপ, কেওড়ার পানি, জাফরান দিয়ে বড় ডেকচিতে করে বসিয়ে দেওয়া হয় দমে। সেখানেই ঢিমে আঁচে আস্তে-আস্তে সুসিদ্ধ হয়ে ওঠে মাংস। নীচে রইল মাটন লাখনৌয়ি বিরিয়ানির রেসিপি।

প্রস্তুতির সময় ৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট

রান্নার সময় ৪৫ মিনিট

(ছ’জনের মতো)

উপকরণ

  • হাড়সহ মাটন ৫০০ গ্রাম
  • বাসমতি চাল ৫০০ গ্রাম
  • ঘি ৫ টেবিল চামচ
  • মিহি করে স্লাইস করা পেঁয়াজ ৩০০ গ্রাম
  • বড় এলাচ ২টি
  • গোলমরিচ ৫টি
  • ছোট এলাচ ৪টি
  • দারচিনি ২ ইঞ্চি
  • লবঙ্গ ৪টি
  • মৌরি ১/২ চা চামচ
  • দুধ এবং ক্রিম একসঙ্গে মেশানো ১/২ কাপ
  • জায়ফলগুঁড়ো সামান্য
  • জাফরান ৫-৬টি
  • গোলাপ/ কেওড়ার পানি (উপরে ছড়ানোর জন্য)
  • লবণ স্বাদমতো
  • ম্যারিনেশনের জন্য
  • লাল পেঁয়াজ, স্লাইস করে ভেজে রাখা ২টি
  • আদা-রসুনবাটা ৩ টেবিল চামচ
  • ধনেগুঁড়ো ১ চা চামচ
  • ইয়েলো চিলি পাওডার ১ চা চামচ
  • পোটলি/ গরম মশলাগুঁড়ো ১ চা চামচ
  • পাতিলেবুর রস ১ টেবিল চামচ
  • টকদই দেড় কাপ
  • টাটকা ধনেপাতা ১ চা চামচ
  • লবণ স্বাদমতো

কীভাবে বানাবেন?

১. ম্যারিনেড করার সমস্ত উপকরণ একসঙ্গে একটি পাত্রে মিশিয়ে নিন। তারপর ওর মধ্যে মাটনের টুকরোগুলি দিয়ে ভাল করে মেশান। ম্যারিনেট করার পর ছ’ঘণ্টা এটিকে ফ্রিজে রেখে দিন।

২. একটি কানাউঁচু গভীর পাত্রে ঘি দিয়ে মাঝারি আঁচে বসান। এরপর ওতে পেঁয়াজের স্লাইস দিয়ে হালকা বাদামি রং না হওয়া পর্যন্ত ভাজুন। ওর মধ্যে ম্যারিনেট করে রাখা মাটন দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিন। যতক্ষণ না মাংস নরম হয়ে আসে, ততক্ষণ ঢিমে আঁচে বসিয়ে রাখুন।

৩. চাল ভাল করে ধুয়ে আধঘণ্টা মতো পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। এরপর পানি ঝরিয়ে নিন।

৪. হাঁড়িতে এক লিটার পানি গরমে বসান। ওর মধ্যে গোটা গরম মশলা এবং ১ চামচ সাদা তেল দিয়ে ফুটতে বসান। মিনিট ২০ পর হাতা দিয়ে গোটা গরম মশলাগুলি পানি থেকে তুলে ফেলে দিন। এরপর পানি ঝরিয়ে রাখা চাল দিয়ে ফোটাতে দিন। এই পর্যায়ে চালের দিকে খেয়াল রাখবেন। কারণ পানিতে ভেজানো বাসমতি চাল দ্রুত রান্না হয়ে যায়। ৫-৬ মিনিট পরে একবার চাল সিদ্ধ হয়েছে কিনা দেখে নিন। মোটামুটি ৬০-৭০% রান্না হয়ে গেলে নামিয়ে নিন।

৫. এবার ভাতের মধ্যে কেওড়ার পানির এবং সামান্য জাফরান মেশান।

বিরিয়ানির স্তর সাজানো 

৬. এরপর একটি গভীর ডেকচির মধ্যে ভাতের একটি স্তর সাজান। এরপরের স্তরে মাটনের টুকরোগুলি দিন। এইভাবে আবার একবার ভাত ও মাটন সাজান। এর উপরে ভাতের শেষ একটি স্তর দিন।

৭. এরপর দুধ এবং ক্রিমের মিশ্রণটির মধ্যে এলাচ এবং জায়ফলগুঁড়ো দিয়ে গরম করুন। ওর মধ্যে বাকি জাফরান ও কেওড়ার পানি মিশিয়ে বিরিয়ানির ভাতের উপর থেকে ছড়িয়ে দিন।

৮. পাত্রের উপরে ঢাকনা দিয়ে আটা বা ময়দা মেখে সেটির চারধার দিয়ে সিল করে দিন যাতে কোনওভাবে হাওয়া না ঢুকতে পারে।

৯. ১৫ মিনিট দমে বসিয়ে রাখুন। এতেই আপনার বিরিয়ানির চাল পুরো সিদ্ধ হয়ে যাবে।

১০. এবার ঢাকনা খুলে রায়তা এবং বেগুন লঙ্কার সালান দিয়ে পরিবেশন করুন গরম-গরম সুস্বাদু মাটন লাখনৌয়ি বিরিয়ানি।

তাহলে আজকের বিরিয়ানির নেপথ্যে বিরিয়ানির ইতিবৃত্ত ও তার উৎপত্তির কাহিনি আপনারা শুনলেন। এবার আর বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য রেস্তোরাঁয় যেতে হবে না। ঘরেই বানিয়ে নিন সুস্বাদু বিরিয়ানি এবং সকলকে চমকে দিন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।