Home ইতিহাস ও জীবনী তিনি আমাদের চিন্তায় ও কাজে হাজির থাকবেন

তিনি আমাদের চিন্তায় ও কাজে হাজির থাকবেন

।। ফরহাদ মজহার ।।

আমরা কেউই চিরদিনের জন্য দুনিয়ায় আসি নি। মানুষের ভালবাসার লোকগুলিকেও আল্লাহ চিরদিনের জন্য পাঠান না। কিন্তু তাঁরা একটি জনগোষ্ঠির মনোগঠনে যেমন, তেমনি তাদের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ছাপ রেখে যান। জুনায়েদ বাবুনগরী (১৯৫৩-২০২১) অর্ধশতাধিক মামলার আসামি। ফ্যাসিস্ট সরকারের অকথ্য নির্যাতন ও মামলা মাথায় নিয়ে তিনি দ্বীন ও দুনিয়া যাঁর অধীন তাঁর আহ্বানে তাঁর কাছেই চলে গিয়েছেন। সাধারণ মানুষের ভালবাসায় সিক্ত এই মানুষটির জানাজায় বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। যারা ঘনিষ্ঠ ভাবে এই অবিশ্বাস্য বিদায় লক্ষ্য করেছেন, তারা এদেশের সাধারণ মানুষদের হৃদয়, বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সম্বন্ধ বোধের আকুতি এবং ধর্মপ্রাণতার মর্ম হাড়ে হাড়ে বুঝবেন।

আমি সবসময়ই ধর্মবেত্তাদের বাস্তব জীবন খুবই ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যবেক্ষণ করি। প্রথম কারণ, বাস্তবতার পর্যালোচনা ধর্ম সম্পর্কে আমার নিজের অনুমান ও বদ্ধমূল চিন্তাকে প্রশ্ন করে দ্বীন ও দুনিয়ার সম্বন্ধ বোঝার ক্ষমতা বাড়ায়। যার দ্বারা আমার নিজের চিন্তার অভাব এবং বিকাশের মাত্রা আমি আন্দাজ করতে পারি। কিম্বা আন্দাজ করবার চেষ্টা করি। ধর্ম সম্পর্কে কোন আজগবি ধারণা না, আমি বুঝতে চাই ইসলাম কিম্বা অন্য যে কোন ধর্ম বাস্তবে ঠিক কিভাবে আমাদের সমাজে হাজির রয়েছে। সেই দিক থেকে অন্যান্য ইসলামি ধারা তো বটেই, বিশেষ ভাবে হেফাজতে ইসলামকে মনোযোগের সঙ্গে নিরীক্ষণ ও পর্যালোচনা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণকে বোঝার গত্যন্তর নাই।

বই পড়ে সমাজ চেনা যায় না। সমাজে বাস করেই আমরা সমাজ বুঝি, যা কোন গবেষণা আমাদের বোঝাতে পারে না। একই কথা অন্য সকল ধর্মপন্থা, আন্দোলন ও রাজনৈতিক দল সম্পর্কেও প্রযোজ্য।

পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের তোড়ে পুরানা সমাজ ভেঙে নতুন সমাজের আবির্ভাব ঘটছে। তার অর্থ শুধু আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের রূপান্তর নয়, ব্যক্তিরও আবির্ভাব। ব্যাক্তির বিকাশের রাজনীতি মার্কস-লেনিনের ভাষায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিকাশ। এই ক্ষেত্রে ধ্রুপদী বিপ্লবী রণনীতি হচ্ছে এই বিকাশ যেন ত্বরান্বিত হয় তার জন্য রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শর্তগুলো তৈরি করে দেওয়া। একে বলা হয়, ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ কাজ হচ্ছে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা– অর্থাৎ বাক, ব্যক্তি মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ সভা-সমাবেশ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানাবার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

এটা আমরা ভুলে যাই বা সহজে ধরতে পারি না যে, সভাসমাবেশ ক্ষোভবিক্ষোভ জানাবার স্বাধীনতা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্গত। বাংলাদেশের এলিট, ধনী, ও অভিজাত শ্রেণীর ধারণা, এই স্বাধীনতা শুধু শিক্ষিত শ্রেণীর দরকার। তাই তারা একে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা কিম্বা লেখালিখির স্বাধীনতায় পর্যবসিত করে।

কিন্তু যারা সাংবাদিক না, পত্রপত্রিকায় লেখালিখি করে না, বই ছাপায় না সেই সকল লিখতে না পারা সাধারন মানুষ আর নিরক্ষরদের কি মত প্রকাশের কোন অধিকার নাই? অবশ্যই আছে। তাহলে তারা কীভাবে তাদের মত প্রকাশ করে? তার ব্যবস্থা কি হবে? উত্তর: তারা মত প্রকাশ করে মিছিলে, সমাবেশে, বিক্ষোভে — রাজপথে আরও আন্যান্য ক্ষোভ-বিক্ষোভ লড়াই-সংংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তাই সারা বাংলাদেশ থেকে পায়ে হেঁটে হেফাজতের ডাকে সাধারণ মানুষ যখন চিড়াগুঁড়ের পুঁটলি হাতে নিয়ে ঢাকা শহরে ২০১৩ সালে রসুলে করিম (সা)-এর অবমাননার প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানাতে এসেছিল, আমি তাকে নিঃশর্তে সমর্থন দিয়েছি। কারণ এই প্রতিবাদ গণমানুষের অধিকার।

আমি ব্যক্তির সার্বিক বিকাশ এবং মানুষের কথা বলার অধিকার মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা শুধু শিক্ষিতদের জন্য — মানুষের চিন্তা ও বিবেকের ওপর শুধু আধুনিক, শিক্ষি্‌ত পাশ্চাত্যপন্থি অধিপতি শ্রেণীর খবরদারি বহাল থাকবে এটা হতে পারে না। এই অধিপতি শ্রেণীর আধিপত্যের উৎখাত আমি চাই, চেয়েছি এবং চাইতে থাকব। যেন আমরা বাংলাদেশের জনগণ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার পরিসর, অর্থাৎ ‘রাজনৈতিক পরিসর” গড়ে তুলতে পারে। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে এটাই আমাদের এখনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। এই সাফল্যের মাত্রা আমাদের আগামি ভবিষ্যতের অভিমুখ নির্ধারণ করে দেবে।

আরও পড়তে পারেন-

আশির দশক থেকে আমার প্রধান দাবি ছিল ধর্মের সঙ্গে মোকাবিলা ছাড়া আমরা ব্যক্তির বিকাশ নিশ্চিত করতে পারব না। ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্যের নির্বিচার অনুকরণ — অর্থাৎ ধর্ম বিবর্জিত সেকুলারিজমের নামে গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তা কিম্বা পাশ্চত্য চিন্তার দাস হওয়া আমাদের পথ হতে পারে না। এই শিক্ষিত পাশ্চাত্যপন্থি শ্রেণী কার্যত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর স্থানীয় বরকন্দাজের ভূমিকা পালন করে। এই শ্রেণীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ জনগণের লড়াই ন্যায়সঙ্গত। এই লড়াই জারি থাকবে।

তাই পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন-বৃত্তের অন্তর্গত বাংলাদেশে দুই হাজার তেরো সাল বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বছর। এই সময় আহমদ শফির সঙ্গে যিনি বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছিলেন তিনি শ্রদ্ধাভাজন জুনায়েদ বাবুনগরী। তিনি বাংলাদেশের ধর্মচর্চার ইতিহাসে যেমন, তেমনি গণমানুষের চিন্তা ও বিবেকের প্রতিনিধি হিশাবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। এই দেশের মানুষ তাঁকে কখনই ভুলবে না। তাঁর জানাজায় লক্ষাধিক মানুষের অংশগ্রহণ সেটাই শুধু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

স্বাধীন চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা বাংলাদেশে শুধু ইসলাম বিদ্বেষী, ইসলাম নির্মূলবাদী ও পাশ্চাত্যপন্থী সেকুলাররা ভোগ করবে, ইসলামপন্থি হলে তাদের বাক, ব্যক্তি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না — এটা হতে পারে না। — এই বৈষম্য মানা যায় না। একই যুক্তিতে যারা আমার চিন্তার সমালোচনা করেন, আমি তাদের কথা বলার অধিকারও স্বীকার করি। আমাকে ইতিহাস বোধ ও বুদ্ধি দিয়ে পরাস্ত করুন — এটাই সুস্থ মানুষের পথ। অন্যদিকে ইসলামপন্থিদেরও বুদ্ধি, চিন্তা ও প্রজ্ঞার হেকমত দিয়ে অজ্ঞানতাকে মোকাবেলা করতে হবে। ইসলামে জাহেলির কোন স্থান নাই।

১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাবুনগরে জুনায়েদ বাবুনগরীর জন্ম। পাঁচ বছর বয়সে তিনি জমিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে ভর্তি হয়ে মক্তব, হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ১৯৭৬ সালে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশে তিনি ১৯৭৬ সালে করাচিতে জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে দুই বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা করেন। সেখান থেকে তিনি হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে তিনি বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন।

বাংলাদেশের মাদরাসা সমূহে সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদরাসায় তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন। ২০০৩ সালে তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি হাট হাজারির মাদরাসার শায়খুল হাদিস এবং শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
জুনায়েদ বাবুনগরী ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিবের দায়িত্ব পান। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ((১৯১৬–১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০) ইন্তেকালের পর দুইহাজার চৌদ্দ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর হেফাজত আমির পদে মনোনীত হন। এই পদে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।

আল্লাহ সদাসর্বদা তাঁর বান্দার প্রতি সদয়, উপযুক্ত পুরষ্কারে ভূষিত করার জন্য সদাসর্বদাই রাজী, জুনায়েদ বাবুনগরীও ব্যতিক্রম হবেন না। তবে তাঁর স্মৃতি ও প্রভাব বাংলাদেশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলনে দীর্ঘকাল বহাল থাকবে। তিনি আমাদের চিন্তায় ও কাজে হাজির থাকবেন। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই।

– ফরহাদ মজহার, কবি ও বুদ্ধিজীবী।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।