Home ইসলাম উলিল আমর কারা এবং তাদের আনুগত্য কখন ওয়াজিব হবে

উলিল আমর কারা এবং তাদের আনুগত্য কখন ওয়াজিব হবে

।। মুফতিয়ে আযম মুহাম্মদ আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রহ.) ।।

অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, ‘উলিল আমর’ তথা জাতীয় দায়িত্বশীল কারা এবং তাদের আনুগত্য কখন ওয়াজিব?

বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে মনে করেন, হাটহাজারীর মুফতী সাহেবদের ফতোয়া এক্ষেত্রে যথার্থ। কিন্তু এর বিপরীতে কতিপয় আধুনিক মনোভাবাপন্ন আলেম বলেন, শরীয়তে ‘উলিল আমর’-এর আনুগত্য ওয়াজিব বলা হয়েছে। আর হাটহাজারীর মুফতী সাহেবদের ফতোয়া উলিল আমরের নির্দেশনার পরিপন্থি। তাই তাদের ফতোয়া অনুযায়ী আমল করা সম্ভব নয়। কেননা উলিল আমরের আনুগত্য করা জরুরী। সুতরাং তাদের বিধি-নিষেধও মেনে চলা জরুরী। এমনকি এতে কুরআন ও হাদীসের বিরোধিতা করার প্রয়োজন হলে তাও করতে হবে। অতএব, উলিল আমরের আনুগত্য হিসেবে করোনা ভাইরাসের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক আমল করা জরুরী বলে মনে করি। সুতরাং আমরা সে অনুযায়ী আমল করব।

এটা আধুনিক মনোভাবাপন্ন আলেমদের দাবি। বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকেও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মেনে চলার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বহু মাদরাসা কর্তৃপক্ষ লকডাউনের সমস্ত আইন মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। একের পর এক মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকরা পাঠদান না করেই বেতন নিচ্ছেন। ছাত্ররা অনর্থক পথে পথে ঘুরছে।

সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সব বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এতে তাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কেননা সেখানে শিক্ষকদের বেতন আসবে সরকারি তহবিল থেকে। এটা ভিন্ন বিষয় যে, সরকার তাদেরকে কোথা থেকে বেতন-ভাতা প্রদান করবে। সেজন্য আমরা জবাবদিহিতার শিকার হব না।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একমাত্র জনগণের মাধ্যমে যেসব দীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে, যেগুলোর অর্থের উৎস হচ্ছে দীনদার, আন্তরিক এবং উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থিক সহযোগিতা, এসব মাদরাসার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কোথা থেকে আসবে? ধর্মীয় অনুদান সংগ্রহের সুযোগও তারা পাচ্ছেন না।

তাছাড়া যেসব ইলমপিপাসু ছাত্র তাদের জীবনকে দীনের জন্য উৎসর্গ করেছেন, তাদের সময় যে নষ্ট হচ্ছে, তার দায় কে নেবে?

দীনী ইলম শিক্ষা করা ফরয বা ওয়াজিব বা সুন্নাত। কিন্তু লকডাউনের কারণে তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এর গুনাহ কার উপর বর্তাবে?

আশা করি, উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর প্রমাণসহ উত্তর প্রদান করবেন।

প্রাসঙ্গিক আরও কয়েকটি প্রশ্ন-

  • উলিল আমর দ্বারা কারা উদ্দেশ্য? এর দ্বারা কাদের আনুগত্য ওয়াজিব?
  • উলিল আমর যদি শরীয়তবিরোধী কোনো আদেশ করে, তার আনুগত্যও কি ওয়াজিব, না শুধু শরীয়তসম্মত বিষয়ে তাদের আনুগত্য ওয়াজিব? আমরা জানি, উলিল আমর যদি শরীয়তবিরোধী কোনো আদেশ করে, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য জরুরী তো নয়ই, বরং জায়েযই নয়। যদি তা-ই হয়, তাহলে জুমার নামায বর্জন করা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামাত ছেড়ে দেওয়া, কাতারের মাঝখানে এক গজ পরিমাণ ফাঁকা রাখা, ইত্যাদি বিষয় কি শরীয়তসম্মত না শরীয়তপরিপন্থি?
  • করোনা ভাইরাসের কারণে বর্তমান লকডাউন কি শরীয়তসম্মত?
  • উলিল আমরের নির্দেশনা অনুযায়ী পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বিধি-নিষেধ, জুমার নামাযে সংখ্যা নির্ধারণ, এসব কি জায়েয?

আশা করি, কুরআন ও হাদীসের দলিল সহকারে প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদান করবেন, যাতে সংশোধনকামী উম্মাহর চলার পথ পরিষ্কার হয় এবং যারা শুধু বিতর্ক করতে চায়, তাদের জবাবও হয়ে যায়।

ইতি- চট্টগ্রামের কওমী মাদরাসার আলেমদের সাথে সম্পৃক্ত কতিপয় সুহৃদ বন্ধু।

বিসমিহি তাআলা ওয়া আউনিহি

উপর্যুক্ত প্রশ্নসমূহের উত্তর

আপনাদের প্রশ্নের পূর্বে ঢাকার কতিপয় আলেমের পক্ষ থেকেও এই প্রশ্ন এসেছিল। তাদের মতে, আমাদের সরকার উলিল আমরের হুকুমে। আর সরকার যেহেতু আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসংস্থার নির্দেশনা মেনে নিয়েছে, তাই উলিল আমরের আনুগত্য হিসেবে সরকারের সবনির্দেশনা আমাদের মেনে নেওয়া জরুরী।

এখন আমরা উল্লেখ করব যে, কুরআনের আয়াতে ‘উলিল আমর’ দ্বারা কারা উদ্দেশ্য? এর দ্বারা আমাদের সরকারী লোকেরা কি উদ্দেশ্য হতে পারে?

উল্লেখ্য যে, হাটহাজারী মাদরাসার দারুল ইফতার পক্ষ থেকে ‘করোনা ভাইরাস’ সম্পর্কে যে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার আলোচনা ফতোয়ার মধ্যে আছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার আলোচনাও ফতোয়ায় আছে। আমাদের সরকারও এসব নির্দেশনা মেনে চলার জন্য আইন জারি করেছে। এ বিষয়ে আমরা জরুরী ফতোয়া লিখেছি এবং গত শা’বান ও রমযান মাসে তা প্রচার করা হয়েছে। অভিজ্ঞ সিংহভাগ আলেম তা মেনে নিয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী আমল করেছেন।

কিন্তু কতিপয় আলেম ভুল বুঝে, কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে, কিংবা সরকারের চাপে তা মেনে নেননি। ফলে তারা শরয়ী বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। আল্লাহ আমাদের এবং তাদের ক্ষমা করুন।

এখন আপনারা পুনরায় ‘উলিল আমর’ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, কুরআন ও হাদীসের আলোকে এর দ্বারা কারা উদ্দেশ্য? তাদের আনুগত্য কখন ওয়াজিব? নি¤েœ সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে।

‘উলিল আমর’ দ্বারা কারা উদ্দেশ্য? এর দ্বারা কাদের আনুগত্য ওয়াজিব?

এ বিষয়ে প্রথম কথা হল, আমাদের এখানে ইসলামী সরকার নেই; তাই এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত কিছু বলিনি। কেননা উলিল আমর মূলত পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের অংশ, যা লওহে মাহফুজে লিখিত আছে। সুতরাং আমাদের উচিত পূর্ণ আয়াত ও তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা জেনে তারপর ফায়সালা করা। সে মর্মে নি¤েœ কতিপয় মুফাসসিরের অভিমত উল্লেখ করা হল। আশা করি গভীরভাবে পাঠ করবেন এবং বোঝার চেষ্টা করবেন।

আরও পড়তে পারেন-

১. হযরত মুজাহিদ বিন জাবর রহ. একজন শীর্ষস্থানীয় মুফাসসির। তিনি তিনবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদি.-কে পবিত্র কুরআন ও তার অর্থ শুনিয়েছেন এবং তাফসীরবিদ্যাও তিনি তার থেকেই শিখেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, أولى الأمر منكم এর দ্বারা উদ্দেশ্য দীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন এবং যারা সুস্থ বিবেকবান ও দীনদার।’

২. ইমাম আবু জাফর তাবারী রহ. বলেন-

“وأولى الأمر منكم ” قال نافع: عن عبد الله عن النبى صلى الله عليه وسلم قال: على المرأ المسلم الطاعة فيما أحب وفيما كره، إلا أن يؤمر بمعصية، فمن أمر بمعصية فلا طاعة، وفى رواية: اى ذوى الأمر من الأئمة المسلمين دون غيرهم من الناس.

أولى الأمر منكم এর ব্যাখ্যা ইমাম নাফে রহ. হযরত আবদুল্লাহ থেকে এবং তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, নবীজি বলেছেন, মুসলমানদের জন্য আমিরুল মুসলিমীনের আনুগত্য জরুরী। তার ভালো লাগুক বা না লাগুক। তবে যদি সে শরীয়তপরিপন্থি কোনো বিষয়ের আদেশ করে, তাহলে আনুগত্য করা যাবে না। অন্য বর্ণনামতে أولى الأمر منكم দ্বারা উদ্দেশ্য ক্ষমতাসম্পন্ন মুসলমান শাসক, অন্য কেউ নয়।

অন্য বর্ণনায় আছে, উলিল আমর দ্বারা উদ্দেশ্য মুসলমানদের এমন শাসক, যাকে মুসলমানরা নির্বাচন করেছে এবং যে শাসক মুসলমানদের আকীদা লালন করে। শরীয়তপরিপন্থি কোনো আদেশ না করলে এমন শাসকের আনুগত্য মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। সেই সাথে যার মধ্যে শরীয়তের বিধান আহরণের যোগ্যতা ও সক্ষমতাও আছে। কেননা উল্লিখিত আয়াতের শেষে শাসকদের মধ্যে বিধান আহরণের যোগ্যতাকে শর্তরূপে উল্লেখ করা হয়েছে।

৩. তাফসীরে ইবনুল মুনজিরে আছে-

قوله تعالى: “أولى الأمر منكم” اى أولى الأمر من اهل طاعة الله الذين يعلمون الناس معانى دينهم ويأمرونهم بالمعروف وينهون عن المنكر، فأوجب الله عزوجل طاعتهم على العباد.

আয়াতে উল্লিখিত উলিল আমর দ্বারা উদ্দেশ্য ওইসব লোক, যারা আনুগত্য ও ইবাদত করে, কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী আমল করে, মানুষকে দীনী বিধানাবলির শিক্ষা প্রদান করে, দীনী বিধানাবলির অর্থ ও মর্ম বর্ণনা করে এবং মানুষের মধ্যে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করে।

৪. আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. أولى الأمر منكم এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, হযরত ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত আছে, এর দ্বারা তারা উদ্দেশ্য, যারা দীনদার ও দীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী। ইমাম মুজাহিদ বিন জাবর রহ. বলেছেন, আতা ইবনে আবি রাবাহ, হাসান বসরি, আবুল আলিয়া প্রমুখও বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য আলেমগণ। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যদি তোমরা না জানো, তাহলে আলেমদের কাছে জানার জন্য প্রশ্ন করো।

আরও বলেছেন, তোমরা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী চলো এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস অনুযায়ী আমল করো। আর আমিরের আনুগত্য তখন করবে, যখন সে কুরআন ও হাদীস মোতাবেক আদেশ করবে। আর যদি কোনো গুনাহের আদেশ করে, তাহলে তার আনুগত্য করবে না। কেননা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- لا طاعة لمخلوق فى معصية الخالق স্রষ্টার অবাধ্যতায় কোনো সৃষ্টির আনুগত্য হতে পারে না।

৫. তাফসীরে মাজহারীতে আল্লামা সানাউল্লাহ পানিপতী রহ. লিখেছেন, আয়াতে উল্লেখিত উলিল আমরের মধ্যে ইসলামের আমির, হকপন্থি আমির এবং বিভিন্ন দীনী উদ্দেশ্যে প্রেরিত দলের আমির সকলেই অন্তর্ভুক্ত। কেননা হযরত আলী রাদি. থেকে বর্ণিত আছে,-

حق على الامام أن يحكم بما انزل الله، ويؤدى الامانة، فاذا فعل ذلك فحق على الرعية أن يسمعوا وطيعوا…… وكذا يشمل الفقهاء والعلماء والمشائخ اهل الحق، بل اولى، لأنهم ورثة الأنبياء وحازنوا أحكام الله ورسوله.

সুতরাং মুসলমানদের ইমাম তথা শাসকের জন্য আবশ্যক হল, কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী বিধান বাস্তবায়ন করবে। কোনো ধরনের খেয়ানত করবে না। মুসলমানদের শাসক এমন হলে তখন জনগণের জন্য আবশ্যক হবে নিজেদের এই হকপন্থি শাসকের আনুগত্য করা এবং তার কথা শোনা।… আর উলিল আমরের মধ্যে ইসলামের আমির, হকপন্থি আমির, ফকীহ, আলেম, হকপন্থি শায়েখ সকলেই অন্তর্ভুক্ত। বরং আলেম ও ফকীহগণ উলিল আমর হওয়ার অধিক উপযুক্ত। কেননা এরা সকলেই নবীদের ওয়ারিশ এবং তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধানাবলি সংরক্ষণ করেছেন। বরং উলিল আমরের মধ্যে ফকীহ ও হকপন্থি আলেমরাই অধিক উপযুক্ত।’

৬. তাফসীরে রুহুল মাআনীতে আল্লামা আলুসী আল-বাগদাদী রহ. সেভাবেই লিখেছেন, যেমনটি লিখেছেন হযরত পানিপতী রহ.। শেষে ফল হিসেবে লিখেছেন-

“اولى الامر منكم”…….ثم ان وجوب الطاعة لهم ما داموا على الحق، فلا يجب طاعتهم فيما خالف الشرع لما أخرجه ابن ابى شيبة عن على كرم الله وجهه، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: لا طاعة لبشر فى معصية الله تعالى.

উলিল আমর দ্বারা আলেম, ফকীহ এবং আমিরুল মুসলিমীন যে-ই হোক, তাদের আনুগত্য তখন ওয়াজিব, যখন তারা কুরআন ও হাদীস এবং হক অনুযায়ী ফায়সালা করবে। সুতরাং যদি তারা শরীয়তপরিপন্থি কোনো আদেশ দেয়, তাদের আনুগত্য আবশ্যক নয়। কেননা মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাতে হযরত আলী রাদি. থেকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী বর্ণিত আছে, আল্লাহর অবাধ্যতা করে কোনো মানুষের আনুগত্য করা যাবে না।

৭. তাফসীরে বাইযাবীতে প্রায় এরকমই বলা হয়েছে।

৮. তাফসীরে দুররে মানসুরে সকল অভিমত উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে-

“اولى الأمر منكم” قال: هم أهل العلم، ألا ترى أنه يقول: “ولو ردوه إلى الرسول وإلى أولى الأمر منهم لعلمه الذين يستنبطونه منهم” الخ

অগ্রগণ্য অভিমত মোতাবেক উলিল আমর দ্বারা উদ্দেশ্য আলেমগণ। কেননা আল্লাহ তাআলার বাণীতে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আর যদি তারা বিষয়টি রাসূল ও তাদের মধ্যে যারা ফায়সালার অধিকারী, তাদের সমীপে পেশ করত, তবে তাদের গবেষক আলেমগণ অবশ্যই তার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত’ (তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিতর্কিত বিষয়ের সমাধান পেশ করতে পারবেন)।

৯. মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাতে বলা হয়েছে-

قوله {أطيعوا الله وأطيعوا الرسول وأولى الامر منكم} قال : كان مجاهد يقول : أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم، وربما قال : أولو العقل والفقه في دين الله.

আল্লাহর বাণী اولى الأمر منكم সম্পর্কে তাবেয়ীদের ইমাম, মুফাসসিরদের ইমাম হযরত মুজাহিদ রহ. বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য আলেমগণ। কখনো বলতেন, তারা হলেন দীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও পরিপক্ব বিবেকের অধিকারী এবং দীনদার।

১০. হযরত আতা ইবনে আবি রাবাহ রহ. ছিলেন বিশিষ্ট তাবেয়ী এবং ফিকাহ, হাদীস ও তাফসীরের ইমাম। সুনানে দারেমীতে ইমাম দারেমী রহ. লিখেছেন, হযরত আতাকে اولى الأمر منكم সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন-

أولو العلم والفقه وطاعة الرسول اتباع الكتاب والسنة إسناده صحيح

তারা হলেন ফিকহের জ্ঞানের অধিকারী দীনদার শ্রেণি, যারা কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করেন।

কাদীম ও জাদীদ তথা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দশটি বড় তাফসীরের উদ্ধৃতি পেশ করা হল। কেউ দেখতে চাইলে আরো উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

এবার আগ্রহী পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে উল্লেখিত তাফসীরগুলোর সারমর্ম ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে।

ক. সকল তাফসীরে যে বিষয়ে মুফাসসিরদের একমত পাওয়া গেছে, তা হল, ‘উলিল আমর’ দ্বারা উদ্দেশ্য দীনদার ও ফিকহের জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ। যেমন হযরত খোলাফায়ে রাশেদীন ও ফিকহের জ্ঞানের অধিকারী অন্যান্য সাহাবী এবং মুহাদ্দিস ইমামগণ।

খ. অথবা এর দ্বারা উদ্দেশ্য প্রত্যেক যুগের ফিকাহবিশেষজ্ঞ ও দীনদার শ্রেণি। হোক তারা শাসনব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত অথবা এর বাইরে দীন ও শরীয়তের তালীম ও তাবলীগের কাজে ব্যস্ত এবং আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালনে রত।

গ. অথবা এর দ্বারা ওইসব আলেম উদ্দেশ্য, যারা উল্লেখিত স্তরের নয়, বরং তাদের চেয়ে নিম্ন স্তরের। তবে তারা ইসলামী শাসনব্যবস্থার পরিচালনার কাজে নিয়োজিত।

ঘ. অথবা উলিল আমর দ্বারা ঐসব দীনদার মুসলমান উদ্দেশ্য, যারা নিজেরা আলেম বা ফকীহ নয়; কিন্তু রাজনৈতিক ও অন্যান্য জাগতিক বিষয়ে অভিজ্ঞ। ফলে অধিকাংশ মুসলমান তাদের শাসকরূপে নির্বাচন করেছে। আর তারা মুসলমান পরামর্শসভার নির্দেশনা মোতাবেক শাসন পরিচালনা করে এবং শরীয়তের কোনো বিধান লঙ্ঘন করে না।

ঙ. অথবা এর দ্বারা উদ্দেশ্য এমন শাসক, যারা দীনদার মুসলমান বটে; কিন্তু নিজেরা আলেম বা ফকীহ নয়। তবে তারা ইসলামী আইন অনুসারে মুসলমানদের মজলিসে শুরার সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে শাসন পরিচালনা করে।

চ. অথবা এর দ্বারা এমন শাসক উদ্দেশ্য, যারা ইসলামী শাসনের নীতিমালা, কুরআন-হাদীস এবং জাগতিক আইন সামনে রেখে শাসন পরিচালনা করে। তবে সংঘর্ষ হলে কুরআন ও হাদীসের বিধানকে প্রাধান্য দেয়।

কিন্তু যেসব শাসক নামে তো মুসলমান, কিন্তু দেশের মধ্যে ইসলামী শাসনব্যবস্থা অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করে না। বরং ইসলাম পরিপন্থি আইন তৈরি করে অথবা সে অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে, কুরআন ও হাদীসের বিপরীত আইনও প্রণয়ন করে, এ ধরনের শাসকদের ‘উলিল আমর’ বলা সঠিক নয়। কেননা তারা ‘উলিল আমরে’র সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। সুতরাং আমরা তাদেরকে অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থার শাসক বলব, অথবা বলব এরা সেক্যুলারিজম, কিংবা সোশ্যালিজম অথবা ন্যাশনালিজমের শাসক। কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে এদেরকে ‘উলিল আমর’ পদে ভূষিত করা সঠিক নয়। কেননা ‘উলিল আমর’ কুরআনের পরিভাষা। এটি লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত আছে। সুতরাং আল্লাহ এর দ্বারা ইসলামবিরোধী শাসকশ্রেণির আনুগত্যের আদেশ কেন দেবেন?

মোটকথা, শাসক দুই শ্রেণির। যথা- ১. ইসলামী শাসনব্যবস্থার শাসক এবং তাদের অধীনস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ। ২. অনৈসলামিক শাসক।

ইসলামী শাসকের আনুগত্য

ক. শরয়ী বিষয়ে
শরয়ী বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনো ইসলামী শাসক যদি শরীয়ত মোতাবেক সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে সে অনুযায়ী জনগণের জন্য আমল করা জরুরী। এর বিরোধিতা করা গুনাহ এবং শরীয়তপরিপন্থি কাজ। সাথে সাথে এটা আইনের পরিপন্থি হওয়ার কারণে এর জন্য শাস্তি দেওয়া যাবে।

খ. পার্থিব বিষয়ে
পার্থিব বিষয়ে ইসলামী শাসকের আনুগত্য বজায় রাখাও জরুরী। যদিও আনুগত্য অপছন্দনীয় মনে হয়। কেননা হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, فيما أحب وفيما أكره অর্থাৎ ভালো লাগুক বা না লাগুক, সর্বাবস্থায় ইসলামী শাসকের আনুগত্য বজায় রাখা জরুরী। শর্ত শুধু এই যে, শরীয়তপরিপন্থি কোনো বিষয় থাকতে পারবে না। সুতরাং শরীয়তপরিপন্থি, কুরআন ও হাদীসবিরোধী, ইজমা ও শরয়ী কিয়াসপরিপন্থি কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য সঠিক নয়। কেননা হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

لا طاعة لمخلوق فى معصية الخالق

স্রষ্টার অবাধ্যতায় কোনো সৃষ্টির আনুগত্য হতে পারে না।

অনৈসলামিক শাসকের আনুগত্য
পক্ষান্তরে অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থার শাসকদের আনুগত্য ওই সময় আবশ্যক হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে শরীয়তপরিপন্থি কোনো বিষয়ের আদেশ না করবে। সুতরাং শরীয়তপরিপন্থি, কুরআন ও হাদীসপরিপন্থি, কিংবা শরয়ী কিয়াসের পরিপন্থি কোনো আদেশ করলে তার আনুগত্য আবশ্যক নয়ই, এমনকি জায়েযও নয়।

বিশেষত ইসলামের ফরয বিষয়াবলি, যেমন : নামায, যাকাত, রোযা, হজ ইত্যাদি, এমনিভাবে ওয়াজিব বিষয়াবলি, যেমন : দুই ঈদের নামায, কুরবানী এবং সুনানে হুদার বিষয়াবলি, যদি এসব বিধানের পরিপন্থি কোনো আদেশ করে, আর এক্ষেত্রে তার শরয়ী কোনো ওজরও না থাকে, তাহলে সে আইন পালন করা জরুরী নয়। এমন শরীয়তপরিপন্থি আইন বাস্তবায়নের জন্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনতাকে বাধ্য করা যাবে না।

তবে এসব অনৈসলামী বা সেক্যুলার, সোশ্যালিজম বা ন্যাশনালিজমপন্থি শাসকদের যেসব বিধান কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী হবে, তা পালন করা আবশ্যক। কেননা রাজনীতি, উপার্জন ও লেনদেনের ক্ষেত্রে শরীয়তসম্মত রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য আবশ্যক। কেননা সকলেই সাংবিধানিক আইন মেনে নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।

এখান থেকে বুঝে নেওয়া উচিত যে, যেসব দেশে ইসলামী আইন নেই এবং যারা ইসলামী আইন বাস্তবায়ন বা পালন করার ওয়াদাও করেনি, পালন করার ইচ্ছাও ব্যক্ত করেনি, বরং সে দেশে সেক্যুলারিজম বা সোশ্যালিজমের আইন চলে, এমন শাসনব্যবস্থার শাসকরা যখন শরীয়তপরিপন্থি কোনো বিষয়ের আদেশ করবে, তখন জনগণের জন্য কখনোই তাদের আনুগত্য করা জায়েয হবে না।

এটা তো ইসলামী শাসনব্যবস্থার শাসকদের ক্ষেত্রেও সত্য। তারা যদি শরীয়তপরিপন্থি কোনো বিষয়ের আদেশ দেয়, তাহলে জনগণের জন্য তাদের আনুগত্য জায়েয নেই। তাহলে অনৈসলামী শাসক ইসলামপরিপন্থি কোনো বিষয়ের আদেশ দিলে তা পালন করা কী করে জায়েয হতে পারে? ইসলামী রাষ্ট্রের কোনো জনগণের জন্য তাদের আনুগত্যে শরীয়তপরিপন্থি কোনো কাজ করা জায়েয হবে না। বরং করলে জঘন্য গুনাহ হবে, কবীরা গুনাহ হবে। সুতরাং আল্লাহর কাছে তাওবা করা জরুরী।

অতএব, শরীয়তপরিপন্থি বিষয়ে ইসলামী শাসনব্যবস্থার শাসকদের আনুগত্য যখন জায়েয নয়, তখন অনৈসলামী শাসকের এমন আদেশের আনুগত্য কী করে জায়েয হতে পারে? তাহলে ভেবে দেখা উচিত যে, বর্তমান করোনা ভাইরাস রোগের আশঙ্কায় জুমা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামাত বর্জন করা কখন এবং কী করে জায়েয হতে পারে? কেননা এসব আইন তো শরীয়তপরিপন্থি এবং কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্যের পরিপন্থি।

পবিত্র কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, কোনো শরয়ী ওজর ছাড়া জুমাও ছেড়ে দেওয়া জায়েয নয় এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামাতও বর্জন করা জায়েয নয়। আমার অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়ায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। কেউ চাইলে সেখানে দেখে নিতে পারেন।

আমেরিকার স্বাস্থ্যসংস্থার সকল সদস্য অমুসলিম ও মুশরিক। তাদের নির্দেশনা ও বিধান গবেষণামূলক। যতই গবেষণা করা হোক, তা একটি নিছক ধারণা ও সন্দেহের চেয়ে বেশি কিছু নয়। এমন ধারণাপ্রসূত সিদ্ধান্তের কারণে শরীয়তের অকাট্য বিধান ছেড়ে দেওয়া কী করে জায়েয হতে পারে? এবং কোন দলিলের ভিত্তিতে? অথচ উসুলে ফিকহের নিয়ম আছে- اليقين لا يزول بالشك সন্দেহের দ্বারা নিশ্চিত বিষয় কখনো দূর হয় না।

তাই আমার ফতোয়ায় আমি কঠোরভাবে উল্লেখ করেছি যে, এ বিধান যেমনই হোক, শরীয়তের অকাট্য বিধানের মোকাবিলায় অবশ্যই বর্জিত এবং ভুল সাব্যস্ত হবে।

– মুফতি মুহাম্মদ আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রহ.), সাবেক মুফতীয়ে আযম বাংলাদেশ এবং মজলিসে এদারির প্রধান- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।