Home ওপিনিয়ন গভীর দুঃশ্চিন্তার কারণ ঘটায় এমন সব লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি

গভীর দুঃশ্চিন্তার কারণ ঘটায় এমন সব লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি

- ফরিদা আখতার।

।। ফরিদা আখতার ।।

তাপ বেড়েছে, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে। জলবায়ু পরিবর্তনের যেসব লক্ষণ খুব দুঃশ্চিন্তার কারণ ঘটায় তার প্রায় সব লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনুভবও করছি। অসহ্য গরমে কাতর হচ্ছি। এই অনুভুতি ভুল কিছু নয়। সর্বশেষ আগস্ট মাসে প্রকাশিত Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) প্রতিবেদন বিশ্ব-উষ্ণতার (global warming) এর নতুন হিসাব দিচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে আগামী বিশ বছরে বা ২০৪০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পার হয়ে যাবে। যদি যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে আগেও হয়ে যেতে পারে। এই পর্যায়ে তাপ বেড়ে গেলে দাবদাহ বাড়বে, গরমকাল দীর্ঘ হবে এবং শীতকাল সংক্ষিপ্ত হবে। শুধু তাই নয়, নানা ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ অস্বাভাবিক আবহাওয়া আরও বাড়বে, তার সঙ্গে বাড়বে নানা রোগ। যার লক্ষণ এখন থেকেই দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা শহরে যারা আছেন তাঁরা দেখেছেন এবছর গ্রীষ্মকাল থেকে শুরু করে শরৎকাল এলেও গরম ভাবটা আগাগোড়া খুব অনুভুত হয়েছে। ঢাকার বাইরেও যতক্ষণ আকাশে মেঘ থাকে বা বৃষ্টি হয়, ততক্ষণ একটু ঠান্ডা হলেও আবারও গরম অনুভুত হয়। ভ্যাপসা গরম, যা খুব স্বস্তিদায়ক নয়। বিশ্বের আবহাওয়ার তথ্য এবং দেশের পত্র-পত্রিকার খবরে দেখা যাচ্ছে ১৪২ বছরে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস ছিল জুলাই।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, এই জুলাইয়ে স্থলভাগ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের সমন্বিত তাপমাত্রা ২০ শতকের গড় তাপমাত্রা ১৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে শূন্য দশমিক ৯৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে এর কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব। এর আগে ২০১৬ সালে এবং ২০১৯ সালেও ওই একই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৪ আগস্ট, ২০২১)। তাও মানুষের হুঁশ নাই। গত কয়েক বছরে ঘন ঘন এমন তাপমাত্রার রেকর্ড ভঙ্গ হচ্ছে, সামনে এমন আরও হতে পারে। 

এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতি অনেক বেড়ে গেছে। দুই হাজার বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরে, এতো দ্রুত তাপমাত্রা বাড়তে আগে কখনো দেখা যায়নি। বিশেষ করে গত ৫ বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১৮৫০ সালের পর সবচেয়ে বেশি ছিল। এই গতিতে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে তাপবৃদ্ধি কেন্দ্রিক দুর্যোগ যেমন দাবদাহ, সমুদ্রের স্তর বেড়ে যাওয়াসহ নানা রকম দুর্যোগ দেখা দেবে যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিশ্বের সকল দেশ ‘তৎপর’। আমরা জানি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির দায় সব দেশের এক সমান নয়। ধনী দেশগুলোর জীবন ব্যবস্থা, শিল্পায়ন, জীবাশ্ম-জ্বালানি ও যন্ত্র-নির্ভর কৃষি বাতাসে কার্বন নির্গমনের বড় একটি অংশের জন্যে দায়ী। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপান মিলে ৬৩% কার্বন নির্গমনের জন্যে দায়ী। জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভর জীবনযাপন ও উৎপাদন ব্যবস্থা বেশি মাত্রায় কার্বন নির্গমনে সহায়তা করছে। এমন কি খাদ্যের মধ্যে মাংসের আধিক্য গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। মাত্র ২০টি লাইভস্টক কোম্পানি (মাংস ও দুগ্ধ জাতীয় খাদ্য ) যে পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন করে তা ফ্রান্স, কিংবা জার্মানীর নির্গমনের সমান। বাণিজ্যিক মাংস ও দুধের গবাদি পশু পালনের পদ্ধতির কারণে ব্যাপক গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয়, তা মোট বৈশ্বিক নির্গমনের প্রায় ১৪.৫%। আইপিসিসি প্রতিবেদনে তাই যথার্থই জানাচ্ছে যে গত দুই দশকে প্রাকৃতিক কারণের তুলনায় মানুষ সৃষ্ট কারণেই তাপমাত্রা বেশি বাড়ছে। বলাই বাহুল্য এগুলো হচ্ছে ধনী মানুষের সৃষ্ট সমস্যা। গরিব মানুষ তার ভুক্তভোগী মাত্র।

আরও পড়তে পারেন-

তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বৃষ্টিপাত ও ফসলের সম্পর্ক ঘনিষ্ট। আমাদের সংবাদ মাধ্যমের কাছে জলবায়ু পরিবর্তনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো খবরের সংজ্ঞায় পড়ে না। বন্যায় বা বড় ধরণের খরায় ব্যাপক ফসলের ক্ষতি হলেই সেটা খবর হয়, কিন্তু তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে কী ধরণের ক্ষতি হচ্ছে তা বিশেষ গুরুত্ব পায় না। উবিনীগের কিছু পর্যবেক্ষণ এখানে তুলে ধরছি। পাবনা জেলার কিছু কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল যে এবারের আষাঢ় মাসে বৃষ্টি ছিল, মাঠে পাট ছিল, সবজিও ছিল। পাটের জন্য বৃষ্টি ভাল হলেও করলা, ঝিংগা, ঢেঁড়সের গোড়ায় পচন ধরে গিয়েছিল। তখন কৃষকরা এই সবজি ক্ষেতে আগাম শিমগাছ লাগাবার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শ্রাবণ (জুলাই) মাসে অনেক বেশি গরম পড়েছিল। এতে শিমের গাছ লাল হয়ে যায়, এমনকি আমনের বীজ তলার পাতাগুলো লালচে হয়ে যায়। গরু-ছাগলও গরমের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কৃষকদের ভাষ্যে, বর্ষার বৃষ্টি স্বাভাবিক থাকলেও গরম অস্বাভাবিক ছিল, এবং এখনো আছে। মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে টাঙ্গাইল এলাকায় যমুনা নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে গিয়ে এর শাখা ধলেশ্বরী, এলেংজান নদীসহ কয়েকটি নদীর পানিতে গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। এই পানি কোথা থেকে আসছে তা তারা বলতে পারে নি, কারণ এটা স্বাভাবিক বন্যার পানির মতো ছিল না। কাজেই বন্যা হলেও পলি আসে নি, বালির স্তর পড়েছে। মাঠের সবজি নষ্ট হয়ে যায়, আমনের বীজতলা ডুবে যায়, এমন কি জাগ দেয়া পাটও ভেসে যায়। আমন ধানের জালা ডুবে যাওয়ায় পরবর্তীতে আমন ধান লাগাতেও দেরি হয়েছে।

মাঠ পর্যায়ের এসব তথ্য দিচ্ছি এটা বোঝাতে যে সময়মতো বৃষ্টি হওয়া না হওয়া, বেশি গরম হওয়া, আবার কোথাও বন্যা –একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে বা জেলায় বৈচিত্র্যপুর্ণ আবহাওয়া ছিল এবং সেই অনুযায়ী কৃষকের ক্ষতি বা লাভ হয়েছে। সারাদেশে একরকম পরিস্থিতি ছিল না, কিন্তু তাপবৃদ্ধির বিষয়টি সবখানেই ছিল। দৈনিক পত্রিকায় এর কোন প্রতিফলন দেখা যায় নাই। পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন ইস্যুতে সাংবাদিক বিট থাকে, কিন্তু এখনো ক্লাইমেট বিট হয়েছে কিনা জানা নেই, বা আমাদের চোখে পড়েনি। নিশ্চয়ই সেটা পরিবেশ সাংবাদিকরা করছেন। এখন পরিবেশ সাংবাদিকতার প্রধান কাজ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা এবং যেখানে যতো দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেয়া যায় সেটাই করতে হবে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত করে দিচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন স্বাস্থ্য পরিস্থিতিও যথেষ্ট নাজুক করে দিচ্ছে। এমন গরম আবহাওয়ায় মশা এবং ফসলের পোকাও বেড়ে যাচ্ছে। তাদের প্রজননের জন্য এই আবহাওয়া খুব অনুকূলে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা গরম আবহাওয়ায় দ্রুত বাড়ে, এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত যে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব গরম আবহাওয়ায় বেশি হয়। সারা বিশ্বে ৩৯ কোটি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। ১৯৭০ সালে অর্থাৎ ৫০ বছর আগে মাত্র ৯টি দেশে ডেঙ্গু ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল, এখন প্রায় ১০০টি দেশে ডেঙ্গু জ্বর ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে যতো বেশি তাপ, মশার বংশবৃদ্ধি তত বেশি হচ্ছে। নেপালের পাহাড়ে কোন দিন ডেঙ্গু দেখা যায় নি। কিন্তু ২০১৯ সালের জুলাই মাসে নেপালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার। সে বছর বাংলাদেশে ৮০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, এবং ৬৭ জন মৃত্যুবরণ করেছিল। এ বছর জুলাই মাসে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল, প্রায় ২,২৮৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৬৫ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।

ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে রোগ-বালাই বাড়ছে, এবং আরও বাড়বে। খরার কারণে খাওয়ার পানির অভাব ঘটবে এবং পোকা-মাকড়ের আক্রমণ বেড়ে গিয়ে ফসল বিপর্যয় হলে খাদ্য ঘাটতি হবে এবং তার কারণে পুষ্টিহীনতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। যতো বেশি তাপ বাড়বে, ততই রোগের বাহকগুলো শক্তিশালীভাবে কার্যকর হবে। আমরা কোভিড-১৯ মহামারীর কাল পর্ব এখনো শেষ করতে পারি নি, তার আগেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির যে লক্ষণ আমরা দেখছি তাতে একাধিক মহামারীর সম্মুখীন হতে হবে, এমন আশংকা করা হচ্ছে।

অথচ মানবসৃষ্ট কারণেই তো এই বৈশ্বিক তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আইপিসিসি’র বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে এখনো যদি সঠিক পদক্ষেপ নেয়া যায় তাহলে ২০৪০ সালের ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়া থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা দ্রুত করতে হবে। দেরি করা যাবে না।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন ” সময় একেবারে নেই, কোন অজুহাতেরও সুযোগ নেই”।

জলবায়ু সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি (২০১৫) প্রায় সব দেশ স্বাক্ষর করেছে। এতে এই শতাব্দীতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে তাপমাত্রা রাখার লক্ষ্য স্থির করেছিল এবং ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে রাখার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টার কথা ছিল। কিন্তু আইপিসিসি’র সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাপকভাবে কার্বন নির্গমন কমাতে না পারলে এই শতাব্দীতে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না।

কোভিডের এই ভয়াবহ মহামারীর পর কি মানুষ আরও বড় দুর্যোগ সহ্য করতে পারবে?

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।