Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ মোসাদের হিট স্কোয়াডের হাত থেকে যেভাবে বেঁচে যান পাক পরমাণুবিজ্ঞানী এ কিউ...

মোসাদের হিট স্কোয়াডের হাত থেকে যেভাবে বেঁচে যান পাক পরমাণুবিজ্ঞানী এ কিউ খান

কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ৮৫ বছর বয়সে মারা গেলেন বিজ্ঞানী আবদুল কাদির খান। পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রধান কারিগর তিনি। পাকিস্তানের মানুষের কাছে তিনি নায়ক, পরম শ্রদ্ধার ব্যক্তি। তাকে বলা হয় ‘পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের জনক।’ তবে তিনি কিন্তু ইরানের পরমাণু কর্মসূচির গডফাদারও হতে পারতেন।

আবদুল কাদিরের জন্ম ১৯৩৬ সালে, ভারতে। দেশভাগের পর ১৯৫২ সালে সপরিবারে চলে যান পাকিস্তানে। বিজ্ঞানের ছাত্র আবদুল কাদির খান ১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। এরপর পাড়ি জমান ইউরোপে। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেন তিনি।

নেদারল্যান্ডসে থাকার সময় অ্যাংলো-ডাচ-জার্মান পারমাণবিক প্রকৌশল কনসোর্টিয়াম ইউরেনকোয় কাজ করেন আবদুল কাদির। সেখান থেকে শিখে নেন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার প্রক্রিয়া।

এরপর, ১৯৭৫ সালে আবদুল কাদির ‘চুরি’ করেন এ প্রক্রিয়ার নকশা। কীভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে অস্ত্র বানানোর পর্যায়ে উন্নীত করা যায়, গোপনে সেটা শিখে ফেলেন। এরপর দ্রুত ফিরে আসেন পাকিস্তানে। ভারতের পরমাণু অস্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে রাজি করান পরমাণু কর্মসূচি চালু করতে।

একেবারেই কাকতালীয়ভাবে সে একই বছর ইজরায়েলি গুপ্তচর আরনন মিলকানও—পরবর্তীতে হলিউড টাইকুন—একইরকম একটা চুরির মিশনে কর্মরত ছিলেন। মিলকান ও ইজরায়েলের ‘সায়েন্টিফিক লিয়াজোঁ ব্যুরো’র গোয়েন্দা বিভাগ এক জার্মান ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে ইউরেনকোর সেন্ট্রিউফিউজের নকশা কিনে নেয়। তারপর ইজরায়েলের পরমাণু অস্ত্রের জন্যও ডিমোনা শহরে একইরকম সেন্ট্রিফিউজ তৈরি করে।

১৯৮৪ সালে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করে পাকিস্তান। এরপরও কিছুটা সময় নেওয়া হয়। চলতে থাকে গবেষণার কাজ। চূড়ান্ত সফলতা আসে ১৯৯৮ সালে।

প্রথম ‘মুসলিম বোমা’ আবিষ্কারক আবদুল কাদির আশির ও নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে তার সেবার প্রস্তাব নিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্য চষে বেড়িয়েছেন। মিশর, সৌদি আরব, আলজেরিয়া ও সিরিয়া তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। ইরান ও লিবিয়া তার প্রস্তাব গ্রহণ করলেও কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। 

মুয়াম্মার গাদ্দাফি আবদুল কাদিরকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি দায়িত্ব দিয়েছিল। অন্যদিকে ইরান কাদিরের কাছ থেকে পাকিস্তানের পি১ ও প২ নামের দুটি সেন্ট্রিফিউজের নকশা ও প্ল্যান কিনে নেয়। সেই নকশা অবলম্বনে ইরান যে সেন্ট্রিফিউজ করে, তা ছিল অনেক দ্রুতগতির ও দক্ষ। 

সে সময় মধ্যপ্রাচ্যে আবদুল কাদিরের এই ঘুরে বেড়ানো নজরে পড়ে মোসাদপ্রধান শাবতাই শাভিতের। তবে তার উদ্দেশ্য মোসাদ ও আমান (ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ) বুঝতে পারেনি।

শাভিত পরে বলেন যে, কাদিরের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলে তাকে হত্যা করার জন্য তখনই মোসাদ এজেন্ট পাঠাতেন। 

আমেরিকা ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করলে গাদ্দাফি ভয় পেয়ে যান। ভাবতে থাকেন, এরপরই তার পালা আসবে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ঝামেলা মেটানোর জন্য ছোটেন তিনি। 

আরও পড়তে পারেন-

গাদ্দাফি সিআইএ ও এমআই৬-এর সঙ্গে দরকষাকষি শুরু করেন। এক পর্যায়ে আবদুল কাদিরকে দিয়ে যে পরমাণু সাইট তৈরি করাচ্ছেন, তা জানিয়ে দেন প্রমাণসহ। আইএইএর সহায়তায় সিআইএ ও এমআই৬ লিবিয়ার পারমাণবিক ও রাসায়নিক কার্যক্রম বন্ধ করতে সক্ষম হয়।

তবে সিআইএ ও এমআই৬ গাদ্দাফির সঙ্গে এই দরকষাকষির কথা কাউকে, এমনকি মোসাদকেও জানায়নি। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে বিবিসির খবর থেকে এ ব্যাপারে জানার পর ইজরায়েল এ বিস্তারিত খোঁজ নিতে আরম্ভ করে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, সিরিয়া মরুভূমিতে একটি পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করছে—যদিও খান ও ইরানের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। সিরিয়ান পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করা হয়েছিল উত্তর কোরিয়ার সাহায্যে। উদ্দেশ্য ছিল প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করা। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইজরায়েলের বিমানবাহিনী চুল্লিটি ধ্বংস করে দেয়।

আবদুল কাদিরের কাছ থেকে তেহরানের পারমাণবিক তথ্যাদি কেনার কথা ফাঁস হওয়ার পর ২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরান অনেকটা বাধ্য হয়ে আলোচনার টেবিলে বসে। ২০১৫ সালে বৃহৎ ছয় পরাশক্তির সঙ্গে জেসিপিওএ পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। ইরান এখন পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। 

খান শুধু মোসাদের হাতে খুন হওয়া থেকেই বেঁচে যাননি—বেঁচে গেছেন সিআইএর খপ্পর থেকেও। পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ ছিল সিআইয়ের। ১৯৭৫ সালে কাদির নেদারল্যান্ডস ছাড়ার পর ডাচ প্রধানমন্ত্রী রুড লুবারস প্রকাশ করেন যে, পরমাণু প্রযুক্তিতে কাদিরের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সিআইএ আগে থেকেই জানত। কিন্তু পাকিস্তানকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়া থেকে থামানোর জন্য আমেরিকা তেমন কিছুই করেনি।

তবে সিআইএ আবদুল কাদিরের পেছনে লেগে থাকে। দুবাইয়ে তার ব্যক্তিগত ব্যবসা সম্পর্কেও জানতে পারে। জানা যায়, কাদিরের এক সুইস কর্মচারী সিআইএর জন্য কাজ করতেন। কাদিরের নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া হয়; কয়েকজন সদস্যকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

২০০৪ সালে লিবিয়ায় আবদুল কাদিরের ভূমিকা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর বিপুল চাপের মুখে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাকে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আবদুল কাদিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আইএইএকে অনুমতি দেয়। এ কারণে কাদিরের কাজকর্ম সম্পর্কে পুরো তথ্য কখনোই জানা যায়নি।

আবদুল কাদির পরমাণুর গোপন তথ্য বিক্রি করার কথা স্বীকার করেন। তবে দৃঢ়ভাবে বলে দেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র তার কাজের সঙ্গে জড়িত নয়, এমনকি তার কাজের বাপারেও পাকিস্তান কিছু জানত না। এরপর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ তাকে ক্ষমা করে দেন।

তবে পাকিস্তানি জনগণ এবং সরকারের চোখে আবদুল কাদির নায়ক হয়েই রইলেন। ইতিহাসের পাতায় কিছু পশ্চিমা দেশের কাছে তিনি ‘খলনায়ক’ হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকলেও পাকিস্তান এবং বহু দেশের কাছে তিনি বীর হিসেবেই অমর হয়ে থাকবেন।

সূত্র: হারেৎজ।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।