Home লাইফ স্টাইল যৌতুক নিষিদ্ধ, উল্টো বরপক্ষকেই বহন করতে হয় বিয়ের সব খরচ

যৌতুক নিষিদ্ধ, উল্টো বরপক্ষকেই বহন করতে হয় বিয়ের সব খরচ

- প্রতিকী ছবি।

ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সিন্ধু নদের তীরবর্তী জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত একেবারেই সাধারণ গ্রাম বাবাওয়াইল। অন্যান্য গ্রামের জনপদের মতো এখানকার লোকজনেরও সকাল শুরু হয় মূলত চাষবাদ দিয়ে; কেউবা আবার ব্যস্ত থাকেন পড়ন্ত রোদে আখরোটের খোসা ছিলে সাজাতে।

গ্রামে বসবাসরত ১৫০টি পরিবারের প্রায় সবাই কৃষিকাজ ও পশমিনা শাল বুনেই জীবিকা নির্বাহ করে।

এই সাধারণ গ্রামই একটি বৈশিষ্ট্যে ছাপিয়ে গেছে অন্য সব গ্রামকে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার বিরল স্থানগুলোর মধ্যে একটি যেখানে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে; এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এই গ্রামে উদযাপন অত্যন্ত সীমিত রাখার নির্দেশ রয়েছে।

এশিয়ার এ অঞ্চলের দেশগুলোতে সাধারণত বিয়ে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজন করা হয়; কোন কোন ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিয়ের অনুষ্ঠানের পেছনেই একটি পরিবার তার সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে ফেলে!

বিয়েতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশি মিলে শত শত অতিথিদের খাবার পরিবেশনের পেছনে বিরাট অংকের অর্থ ব্যয় করা হয়।

এছাড়া যৌতুকের অংশ হিসাবে, কনের পরিবারের পক্ষ থেকে ‘উপহারস্বরূপ’ গৃহস্থালী সামগ্রী, গহনা, নগদ অর্থ এবং কখনও কখনও বরের জন্য গাড়ি পর্যন্ত দিতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে তো, যৌতুকের পরিমাণ ঠিক হওয়ার পরে বিয়ে নির্ধারিত হয়!

ভারতে গত ছয় দশক ধরে যৌতুক প্রথাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু এ প্রথার শিকড় এখনো সেখানকার সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। যৌতুকের কারণে দেশটিতে প্রতিদিন আনুমানিক ২০ জন নারী খুন হয় বা আত্মহত্যা করে। প্রতিবছর যৌতুকের কারণে ৮ হাজারেরও বেশি প্রাণহানি ঘটে।

বাবাওয়াইল গ্রামের মসজিদের ইমাম বশির আহমদ বলেন, “যৌতুক এবং ব্যয়বহুল বিয়ের যেসব কাহিনী আমাদের কাছে পৌঁছে তা অত্যন্ত বিরক্তিকর। আমি সব সময় ভাবতাম কীভাবে এমন একটি ঐতিহ্যকে সাথে নিয়ে আমরা আমাদের সন্তানদের বিয়ে দেব”!

অবশেষে ২০০৪ সালের শীতে গ্রামটির ২০ জন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এই ‘অশুভ রীতি’ কীভাবে বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে বৈঠকে বসেন। ইমাম বশির আহমদ তাদেরই একজন। কয়েকদিনের আলোচনার পর, প্রবীণেরা তাদের ধারণা গ্রামবাসীদের কাছে উপস্থাপন করেন।

তারা প্রস্তাব করলেন যে, কনের পরিবার বিয়েতে কোন খরচ করবে না। বরং বরের পরিবার মোহরানা হিসেবে কনেকে ভারতীয় মুদ্রায় ৯০০ রূপি পরিশোধ করবে। পাশাপাশি কনের পরিবারকে দেবে আরও ১৫ হাজার রূপি।

বর বিবাহের জন্য ৫০ কেজি মাংস এবং ৪০ কেজি চালের ব্যবস্থা করবে; এছাড়াও বরপক্ষের মাত্র ৪০ জনকে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।

এর আগে কাশ্মীরি বিয়ের জন্য আয়োজিত বিশেষ ভোজ ‘ওয়াজওয়ানে’ শত শত অতিথি অংশ নিত; যৌতুকের অংক ছাড়িয়ে যেত কয়েক লক্ষ টাকা।

ফলে নতুন এই নিয়ম গ্রহণ করে নিতে গ্রামবাসীরা সময় নেয়নি। তারপর থেকেই বাবাওয়াইলে কোন ব্যয়বহুল বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি এবং আর কোন যৌতুকও দেওয়া হয়নি।

তবে মুদ্রাস্ফীতির জন্য গত বছর গ্রামবাসীরা নিয়মে কিছু সংশোধন এনেছেন- বরের পরিবারের পক্ষ থেকে এখন কনেপক্ষকে ৫০ হাজার রূপি দিতে হয়, যার মধ্যে দেনমোহর ধরা হয় ২০ হাজার রূপি।

বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য কোন ভোজের আয়োজন করা হয় না- শুধুমাত্র খেজুর এবং চা পরিবেশন করা যায়। বরের সঙ্গে বিয়ের আসরে যাবার অনুমতি পান মাত্র ৩ জন।

“আমি গর্বিত যে গ্রামের সবাই এই আইন মেনে চলছে”, বলেন আহমদ; গত কয়েক বছরের মধ্যে যার নিজের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, নতুন এসব নিয়ম চালু হওয়ার পর থেকে কোনও নারীর ওপর সহিংসতা বা নির্যাতনের একটিও ঘটনা শোনা যায়নি। এমনকি কোন বিবাহবিচ্ছেদও হয়নি।

তাছাড়া এসব নিয়ম মেনে চলার ক্ষেত্রে সহকর্মী এবং প্রতিবেশীদের একপ্রকার চাপ রয়েছে। আহমদ বলেন, যারা এসব নিয়মসমূহ মেনে চলে না তাদের সমাজচ্যুত করা হয়।

সম্প্রতি বিয়ে করেছেন ইকরা আলতাফ (২৫)। স্নাতকোত্তরের এই শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের ধর্ম থেকে আমরা এই অনুপ্রেরণা পেয়েছি”।

তিনি বলেন, “যৌতুক এবং আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ের মতো সামাজিক আচারগুলো কেবল নারীদের জীবন কঠিন করে তুলছে। এটি নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য তৈরি করছে, এমনকি এসবের জন্যই অনেক মা-বাবা কন্যাসন্তান নিতে চান না। আমাদের যেকোন উপায়ে এই অনিষ্ট বন্ধ করতে হবে”।

ইকরা আরও জানান যে, তিনি তার স্বামীকে তাদের বিয়ের জন্য অনুমোদিত নিয়মের চেয়েও কম ব্যয় করতে বলেছেন, যেন তা অন্যদের কাছে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।

বাবাওয়াইল গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, সমাজের উন্নতির জন্য এই পরিবর্তনে তারা আনন্দিত।

গ্রামের একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা গোলাম নবী শাহ (৬৫) বলেন, “আমাদের মেয়েরা এখন কোনো হয়রানির সম্মুখীন হয় না। যারা বিয়েতে ব্যয়ের জন্য অর্থ সঞ্চয় করে রেখেছিল তারা এখন সন্তানদের উচ্চশিক্ষার মতো ফলপ্রসূ জিনিসে সেসব অর্থকড়ি ব্যয় করছে। আমরা সকলেই তাই সন্তুষ্ট”।

“আমি অন্যান্য গ্রামে থাকা আমার আত্মীয়-স্বজনদেরও বোঝানোর চেষ্টা করছি যেন বিয়েগুলো সহজ, অনাড়ম্বর রাখার ব্যবস্থা করা হয়… পৃথিবী ছাড়ার আগে আমি কাশ্মীরের পরিবর্তন দেখে যেতে চাই”।

সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।