Home ওপিনিয়ন মাংস, না গোশত: বিভ্রান্তির অবসান

মাংস, না গোশত: বিভ্রান্তির অবসান

।। এইচ. এম. ময়নুল হক ।।

কেউ বলেন, মাংস বললে গুনাহ হবে। কেউ বলেন, মাংস বললে মাকরুহ হবে। কেউ বলেন, মুসলমানের জন্য মাংস বলা ঠিক নয়। কেউ বলেন, আকাবীরগণ গোশত বলেছেন তাই আমরাও গোশত বলবো। কেউ বলেন, অমুক পীর/বুজুর্গ সাহেব মাংস বলতে নিষেধ করেছেন তাই মাংস বলা যাবে না। সত্যিই কি মাংস বলা ঠিক নয়? আসুন একটু পর্যালোচনা করে দেখি ফলাফল কি দাঁড়ায়।
প্রথমে বাংলা ভাষায় মাংস শব্দের ব্যবহার নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলো উৎপত্তিগতভাবে ৫ প্রকার। ১. তদ্ভব, ২. তৎসম, ৩. অর্ধ তৎসম, ৪. দেশি এবং ৫. বিদেশী। ‘মাংস’ শব্দটি উপরোল্লিখিত কোন প্রকার থেকে এসেছে তা জানা এক্ষেত্রে জরুরি।
বাংলা অভিধানগুলো ঘেঁটে যতটুকু জেনেছি, তা হলো ‘মাংস’ শব্দটির উৎস হচ্ছে, সংস্কৃত (মন + স) থেকে। ‘মাংস’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে আসলেও এটি কোন কালেই ‘মাংশ’ বানানে ছিলো না। সকল বাংলা অভিধানেই শব্দটির বানান ‘মাংস’ লেখা হয়েছে। (দেখুন- ঢাকার বাংলা একাডেমী (জানুয়ারী, ২০১১) প্রকাশিত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এর ৯৬৮ পৃ.; কলকাতার সাহিত্য সংসদ (অক্টোবর, ২০০৭) প্রকাশিত ‘সংসদ বাংলা অভিধান’-এর ৬৯৩ পৃ.; কলকাতার এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লি. (ত্রয়োদশ সংস্করণ, ১৩৮৯) প্রকাশিত আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধান ‘চলন্তিকা’ -এর ৫৮২ পৃ.।)
বাংলা একাডেমি ‘মাংস’ শব্দের অর্থ লিখেছে, ‘প্রাণীর দেহের হাড় ও চামড়ার মধ্যবর্তী শরীরের অংশবিশেষ’। (৯৬৮ পৃ.)।
শৈলেন্দ্র বিশ্বাস ‘মাংস’ শব্দের অর্থ লিখেছেন, ১. ‘জীবদেহের হাড় ও চামড়ার মধ্যবর্তী কোমল অংশবিশেষ’; ২. ‘মানুষের ভোজ্য মনুষ্যেতর প্রাণীর আমিষ বা পলল’। (৬৯৩ পৃ.)। রাজশেখর বসু ‘মাংস’ শব্দের অর্থ লিখেছেন, ‘পশু মনুষ্যইঃর দেহের চর্ম ও অস্থির মধ্যবর্তী কোমল অংশ পিশিত’। (৫৮২ পৃ.)। উপরোল্লিখিত অর্থসমূহ ছাড়া অন্য কোন অর্থ এসব অভিধানে লেখা হয়নি।
একটি ভুল ধারণাঃ
কেউ কেউ বলে থাকেন, মাংস মানে মায়ের অংশ। যেমন- মাংস’ বাংলা মুরাক্কাব বা সন্ধিবদ্ধ শব্দ। স্বরসন্ধি। মা+অংশ=মাংস। ‘মা’ মানে গো-মাতা। ‘অংস’ মানে ‘অংশ’। ‘মাংস’ মানে গো-মাতার অংশ। অর্থাৎ মাংস বললে গরুকে মা হিসাবে স্বীকার করা হচ্ছে। এজন্য মাংস বলা যাবে না।
ভালো করে লক্ষ্য করুনঃ
মাংস’ লিখছেন ‘দন্ত্য-স’ দিয়ে। আর ‘অংশ’ লিখছেন ‘তালব্য-শ’ দিয়ে। সন্ধি হলে শব্দের শেষের অক্ষর পরিবর্তন হয় কখনো? আসলে ‘অংস’ মানে ‘অংশ’ নয়, একথা মনে রাখবেন।
গোশত শব্দ দিয়ে আমিও একটা সন্ধি করতে পারি। যেমন- গো+আস্ত=গোস্ত। ‘গো’ মানে গরু-দেবতা। ‘আস্ত’ মানে আছে, বিদ্যমান, অস্তিত্ব। ‘গোস্ত’ মানে গরু-দেবতা বা গো-দেবতার অস্তিত্ব। (গোস্ত, গোসত, গোশত বিভিন্ন মতের বানানবিভেদ)।
কি? এবার বুঝলেন তো সন্ধির অবস্থা। আসলে এই সন্ধির কোনটিই সঠিক নয়। মাংস কোন অবস্থার মায়ের অংশ নয়। বাংলা ভাষার কোনো বিশেষজ্ঞ (হিন্দু কিংবা মুসলিম) ‘মাংস’কে তথাকথিত ‘মাংশ’ শব্দের অপভ্রংশ বা পরিবর্তিত রূপ বলে আখ্যায়িত করে তাকে হিন্দুদের বিশ্বাসজাত কোন শব্দ বলে উল্লেখ করেননি। যেমনটা করেছেন কীর্তন বেদী, স্নাতক, আচার্য, বিশ্বভ্রম্মাণ্ড ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রে। তাহলে কেন মাংসকে মাংশ ভেবে ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে?
অন্যান্য ভাষায় মাংসকে কি বলেঃ
বাংলা মাংস শব্দকে ইংরেজিতে Meat (মিট) বলে। আরবীতে لحم (লাহম) বলে। উর্দু ও ফারসিতে گوشت (গোশত) বলে। হিন্দী ভাষায় मांस (মান্স) বলে। আফ্রিকান ভাষায় vleis (ভ্লেইস) বলে। মাংস আর গোশত এটা শুধু ভাষাগত পার্থক্য। এখানে ধর্মের কোন ছিটাফোঁটাও নেই। গোশত শব্দের প্রতি ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের আকর্ষণের কারণঃ ভারত উপমহাদেশে (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ) আগেকার সময়ে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো আরবী ভাষা থেকে অনুবাদ করা হতো উর্দু/ফারসী ভাষায়। আর সে কারণেই আরবী لحم (লাহম) এর অনুবাদ করা হয়েছে گوشت (গোশত) শব্দ দিয়ে। যেহেতু আলেমগণ উর্দু এবং ফারসিতে ধর্মীয় গ্রন্থ পড়েছেন। তাই তাঁরা لحم (লাহম) কে گوشت গোশত বলতেন। আর এভাবেই আমাদের উপমহাদেশে গোশত শব্দের প্রচলন শুরু।
তাছাড়া এ উপমহাদেশের মুসলিম জনগণ ধর্মীয় দিক দিয়ে অত্যন্ত আলেম ভক্ত। এজন্য আলেমদের মুখে গোশত শব্দ শুনে সাধারণ মুসলমান মনে করে নিয়েছেন যে, এটা (গোশত) ইসলামিক শব্দ। আসলে গোশত শব্দকে ইসলামিক শব্দ মনে করা সম্পূর্ণ ভুল। হয়তো আপনি বলবেন, আকাবীর (আলেমগণ) গোশত বলছেন সুতরাং আমাদেরও গোশত বলতে হবে। তাহলে আমি বলি, রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম لحم (লাহম) বলছেন। আর আকাবীর (আলেমগণ) گوشت (গোশত) বলছেন। তো এখন আপনি রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের কথা মানবেন, না আকাবীর (আলেমগণের) কথা মানবেন?
নিশ্চয় আপনি চিন্তায় পড়ে গেছেন? চিন্তার কোন কারণ নেই। রাসূল (সা.) ও সাহাবীদের ভাষা ছিলো আরবী, তাই তাঁরা لحم (লাহম) বলেছেন। আকাবীর (আলেমগণ) ধর্মীয় গ্রন্থ পড়েছেন উর্দু ও ফারসী ভাষায়। তাই তাঁরা گوشت (গোশত) বলছেন।
মোটকথা, মাংস বলেন আর গোশত বলেন কোন সমস্যা নেই। কিন্তু মাংস বলা ঠিক নয়, গোশত বলা উত্তম; এমনটা মনে করা কুসংস্কার। এরকম কুসংস্কার থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।