Home রাজনীতি ‘ইসলাম থেকে রাজনীতিকে আলাদা বিষয় ভাবার সুযোগ নেই’

‘ইসলাম থেকে রাজনীতিকে আলাদা বিষয় ভাবার সুযোগ নেই’

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কর্মী সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন দলের অর্থ সম্পাদক মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী।

।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।

আলহামদুলিল্লাহি ওয়াকাফা, ওয়াসালামুন আলা ইবাদিহিল্লাযীনাস্তাফা। আম্মা বাদ-

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ

তরজমা: আর তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা একে অপরের শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালোবাসা সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও। (আলে-ইমরান- ১০৩)।

হযরত মুহাম্মদ ইবনু সিরীন (রাহ.)এর সহীহ মুসলিম শরীফের ভূমিকায় লিখেন- ان هذا العلم دين.فانظروا عمن تأخذون অর্থাৎ- “নিশ্চয়ই (পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত) ইলমই হচ্ছে দ্বীন। সুতরাং তোমরাই নির্ধারণ করো, কার কাছ থেকে দ্বীনি ইলম অর্জন করছো”।

সম্মানিত ‍উলামায়ে কেরাম, মাদ্রাসার ছাত্র এবং ঢাকাস্থ জেলা নেত্রকোনা জেলা ছাত্র জমিয়তের পক্ষ থেকে আয়োজিত আজকের এই আলোচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, বিভিন্ন পর্যায়ের জমিয়তের নেতৃবৃন্দ এবং দূর-দুরান্ত থেকে আগত উপস্থিত প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা! আমি শুধু আপনাদেরকে একটা বিষয়ে অবগত করাতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেব। সেটা হল, জমিয়ত কী এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম কোন পর্যায়ের রাজনৈতিক দল? এক কথায় এর উত্তর দেব, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম হচ্ছে দারুল উলূম দেওবন্দের রাজনৈতিক প্রোগ্রাম বা কর্মসূচীর নাম। দারুল উলূম দেওবন্দের রাজনৈতিক শাখার নাম।

হযরত মুহাম্মদ ইবনে সিরীন (রাহ.) তিনি যে হাদীস বর্ণনা করেছেন, ইলম আমি কার কাছ থেকে গ্রহণ করব? ان هذا العلم دين فانظروا عمن تأخذون

মুসলিম শরীফের ভূমিকায় আছে, দ্বীনি ইলম এত সহজ কোন জিনিস নয় যে, যার তার কাছ থেকে গ্রহণ করা যাবে। ইলম অনেক দামি জিনিস। যে বিষয়টি যত দামি হয়, সেটা বিশেষ জায়গা থেকে গ্রহণ করতে হয়। যার তার কাছ থেকে যেখান সেখান থেকে সেটা গ্রহণ করা যায় না। আমি বলতে চাই, রাজনীতি যেহেতু দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। যে রাজনীতি সম্পর্কে অনেকে ভুল ব্যখ্যা দিয়ে বলে থাকেন যে, রাজনীতি কি ভাল মানুষ করেন? সমাজের যারা দুষ্টু লোক, দুর্নীতিবাজ, তারাই রাজনীতি করেন। এ রকম একটা উক্তি আমাদের সমাজেও চালু আছে। কার্যতঃ সমাজের মধ্যে যারা সাময়িক সুবিধাভোগী লোক, যারা দুনিয়ার জন্য সাময়িক সুবিধাগ্রহণ করে চলেন, তারাই এই সকল উক্তি করে থাকেন- তাদের পেট পুরা করার জন্য, তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য।

কারণ, রাজনীতি না করলে হাদিয়া-তোহফা বেশী পাওয়া যায়। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমরা এরকম দেখে থাকি। যারা রাজনীতি না করে নানা কায়দায় নিজের বড়ত্ব জাহির করে, তাদের কাছে ধনী, ব্যবসায়ী, শিল্পতি, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন গিয়ে থাকেন। সব দলের লোক যায় তাদের কাছে। আর তারাও বড়াই করে বলে থাকেন যে, আমাদের কাছে সব শ্রেণীর মানুষ এসে থাকেন। আমরা রাজনীতি না করেই কামিয়াব। আমরা সকলের কাছ থেকে সম্মান ও গুরুত্ব পাচ্ছি। সকলেই আমাদের কাছে দোয়া, পরামর্শ নিতে আসছেন। কার্যতঃ তারা দুনিয়াদার। তাদের মনের ভেতরে যশ, খ্যাতি, প্রভাব ও স্বার্থের মোহ লুকিয়ে থাকে। তারা দ্বীন ও উম্মাহর জন্য খালেস খেদমতের নিয়্যাতে কাজ  করেন না। না হয় তাদের দরবারে দুনিয়াদারদের ভীড় করাকে তারা কামিয়াবী বলে আত্মপ্রচার করতেন না।

প্রিয় ভাইয়েরা আমার, এই জন্য রাজনীতি সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম, আমাদের যারা আকাবির, যারা আমাদের পূর্বসূরী, তারা কী বলেছেন, সেখান থেকে আমি শুধু এক দুইটা উক্তি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। রাজনীতি যে দ্বীনের একটি বড় ধরণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এটা আমাদেরকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। হযরত ইমাম গাযালী (রাহ.) বলেছেন, “মানুষের যত উন্নত কাজ আছে, যত ভাল কাজ আছে, যত গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি ইবাদাত হল রাজনীতি”।

ইবনুল কাইয়্যাম (রাহ.) একজন প্রসিদ্ধ ইসলামী মহা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘সিয়াসাত শরীয়াত কা এক হেচ্ছা হায়’। অর্থাৎ- শরীয়তের যত অংশ আছে, তার মধ্যে একটি অংশ হল সিয়াসত তথা রাজনীতি।

শায়খ মাহমুদ আল-মিসরী (রাহ.) বলেছেন, ‘সিয়াসতে আদেলাহ শরীয়ত হী কা এক হেচ্ছা হায়’। অর্থাৎ- রাজনীতি যদি কোন ব্যক্তি ন্যায়-নীতির সাথে করেন, ইনসাফের সাথে করেন, দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য করেন, দ্বীনের জন্য করেন, তখন রাজনীতি একটা ইবাদত।

আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) বলেছেন, ‘সিয়াসাত আওর দিয়ানাত মেঁ সিয়াসাত উছিলা হায়’। মুফতী কিফায়াতুল্লাহ (রাহ.) বলেছেন, ‘সিয়াসাত ইসলাম কি ইবতেদায়ী মঞ্জিল হায়’। তাহলে ইসলামের সূচনাই হল সিয়াসাত বা রাজনীতির মাধ্যমে।

হুসাইন আহমদ (রাহ.) বলেছেন, ‘সিয়াসাত মেহরাব আওর মিম্বার কা হেচ্ছা হায়’। যারা জুমার নামায পড়ান, যারা খতীব, যারা মিম্বার থেকে বক্তব্য দিয়ে থাকেন, এটা যেমন একটা দ্বীন, এটা যেমন একটা শরীয়তের কাজ, এটা যেমন ইসলামের অংশ, রাজনীতিও এমনই একটা অংশ।

আমাদের এই উপমহাদেশের অন্যতম ব্যক্তিত্ব মুফতী তাক্বী উসমানী (দা.বা.) বলেছেন, “সিয়াসাত কো দ্বীন সে আলাগ সমঝনা জায়েয নেহী হায়”। অর্থাৎ- কোন ব্যক্তি যদি ইসলাম থেকে, দ্বীন থেকে রাজনীতিকে আলাদা বিষয় মনে করে, এটা জায়েয হবে না।

আমাদের বর্তমান উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা ফজলুর রহমান (দা.বা.) বলেছেন, ‘সিয়াসাত আম্বিয়ায়ে কেরাম কা ওযীফা হায়’। অর্থাৎ- সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম পৃথিবীর বুকে দ্বীনের ক্ষেত্রে যত ওযীফা নিয়ে এসেছেন, তার অন্যতম ওযীফা হল রাজনীতি।

কাজেই আমার যে সকল ভায়েরা এমন সব মন্তব্য করে থাকেন যে, রাজনীতি কোন দ্বীনি কাজ নয়। রাজনীতি একটা ফালতু কাজ। ভাল মানুষ রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকেন না। আমরা স্পষ্ট করে বলতে পারি, মূলতঃ তারা ইসলামের সাথে শরীয়তের সাথে নিরেট ধোঁকাবাজি করে যাচ্ছেন। এতে কোন ধরণের সন্দেহ নাই।

আরও পড়তে পারেন-

এজন্য আমি শুরুতেই বলেছি, ইবনে সিরীন (রাহ.) বলেছেন- ان هذا العلم دين فانظروا عمن تأخذون। অর্থাৎ- দ্বীন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কার কাছ থেকে এই দ্বীন অর্জন করবে, সেটা তুমি নির্ধারণ কর। আমি এর সাথে ছোট্ট একটা কথা মিলিয়ে বলতে চাই, দ্বীন যেমন যার তার কাছ থেকে গ্রহণ করা যাবে না, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও যার তার কাছ থেকে রাজনীতি গ্রহণ করা যাবে না। যাঁরা আমাদের আকাবীর, যাঁরা উলামায়ে দেওবন্দের উত্তরসুরী, তাঁরা রাজনীতির যে প্লাট ফরম তৈরি করে গেছেন, সে রাজনীতির নাম জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম যুগ যুগ ধরে ইসলামের ক্ষতি সাধনে যারা কাজ করতে চেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, তাদের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করেছিলেন। যত আন্দোলন হয়েছে এই ভারতীয় উপমহাদেশে, একমাত্র জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করে গেছে।

কাজেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম যেহেতু উলামায়ে দেওবন্দের একটি রাজনৈতিক প্লাট ফরমের নাম, সুতরাং আপনি রাজনীতি না করলে সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। রাজনীতি না করলে একটা স্বাভাবিক গুনাহ করলেন, অন্যায় করলেন, সেটা ভিন্ন বিষয়। তবে যদি আপনি রাজনীতি করেন, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে সমাজে পরিচয় দিতে চান। দেশ ও জাতির খেদমত করতে চান। তাহলে একটাই পরিচয় হওয়া উচিত যে, আপনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একজন কর্মী। কারণ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম যেনতেন সাধারণ কোন রাজনৈতিক দল নয়। জমিয়ত হচ্ছে আকাবিরদের প্রতিষ্ঠিত, আকাবিরদের হাতে গড়া গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী একটি রাজনৈতিক দল। যে দলের সাথে আজকের বাংলাদেশে যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে আপনি হিসাব করেন, বাংলাদেশে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে যে পরিমাণ উলামায়ে কেরাম সম্পৃক্ত আছেন, অন্য সকল দল মিলেও এ পরিমাণ উলামায়ে কেরামের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাবেন না।

আসুন, পূর্বের ইতিহাস, দেওবন্দের ইতিহাস, পরবর্তী ইতিহাস, সর্বত্রই জমিয়তের গৌরবময় পদচারণার ইতিহাস খুঁজে পাবেন।

এখানে আরো অনেক নেতৃবৃন্দ আছেন, তারা এই নিয়ে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন। আমি শুধু একটি কথাই বার বার বলতে চাই, হযরত ইবনে সিরীন (রাহ.) বলেছেন, “ان هذا العلم دين فانظروا عمن تأخذون دينكم”। অর্থাৎ- যার তার কাছ থেকে দ্বীন গ্রহণ করা যাবে না, তেমনি যার তার রাজনৈতিক অনুসরণও করা যাবে না।

প্রিয় ভাইয়েরা আমার, অনেক দূর দুরান্ত থেকে আপনারা এসেছেন। দ্বীনি রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ পথে কাজ করার জন্য আপনাদের সকল ত্যাগ, পরিশ্রমের প্রতি আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই, মোবারকবাদ জানাই। এখানে শেষ পর্যন্ত আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দিকনির্দেশনামূলক মূল্যবান বক্তব্য দিবেন। আপনারা গভীর মনোযোগের সাথে তা শুনে এখান থেকে দিক-নির্দেশনা নিয়ে যাবেন। আমাদের আকাবিরগণের এই দ্বীনি কাজকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, সারা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে কীভাবে ইসলামী রাজনীতির সুফল পৌঁছানো যায়, সে বিষয়ে আপনারাও চিন্তা ফিকির করে কাজ করে যাবেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সে তাওফীক দান করুন। ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।