Home ইসলাম আর্থিক লেনদেন ও ব্যবসায় নৈতিকতা

আর্থিক লেনদেন ও ব্যবসায় নৈতিকতা

মানবজীবনের অপরিহার্য বিষয় হলো জীবিকা উপার্জন। আর এ জন্য মানুষ মাত্রই নানা পেশার সাথে জড়িত। ঈমানদাররা হালাল জীবিকা উপার্জনের জন্য কৃষিকাজ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যে নিয়োজিত থাকেন।

তবে ব্যবসায়-বাণিজ্যে ইসলাম কতগুলো সুনির্দিষ্ট নীতি ও নৈতিক বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্য বা আর্থিক লেনদেনে সততা, স্বচ্ছতা, অঙ্গীকার পূরণ করা, জাকাত দেয়ার ওপর ইসলাম গুরুত্বারোপ করেছে। ব্যবসায় ধোঁকা, প্রতারণা, মজুদদারি, ভেজাল, মাপে কম দেয়া, মিথ্যা শপথ করা, সুদ, জুয়া ইত্যাদি বিষয়কে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। আর্থিক লেনদেন ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব নীতি অনুসরণের নির্দেশ দেয় তার ক’টি নিচে উল্লেøখ করা হলো।

ক. লেনদেনে উদার ও কোমল হওয়া: ইসলাম জীবনের সব ক্ষেত্রে সরলতা, কোমলতা ও উদারতা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। সব প্রকার জটিলতা ও সঙ্কীর্ণতা পরিহার করতে উৎসাহিত করে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও একই নীতি বাতলে দিয়েছে ইসলাম। যেমনÑ লেনদেনে উদারতা ও কোমলতা প্রদর্শন করা, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে পারস্পরিক ভালো ও উত্তম আচরণ করা, অযথা কারো ওপর কষ্ট বা সঙ্কট চাপিয়ে না দেয়া ইত্যাদি। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর অনুগ্রহের ফলেই আপনি তাদের প্রতি নম্র হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের অধিকারী হতেন, তা হলে তারা আপনার চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। সুতরাং আপনি তাদের মার্জনা করুন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন’ (সূরা আলে-ইমরান : ১৫৯)।

রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তির ওপর রহমত করেন যে কেনাবেচার সময় এবং নিজের অধিকার আদায়ের সময় কোমল আচরণ করে’ (বুখারি-২০৭৬)।

কেনাবেচায় সরলতা ও সততা প্রদর্শনকারীর জন্য মহানবী সা: সুসংবাদ প্রদান করে আরো বলেছেন, ‘কেনাবেচায় যে লোক সহজ-সরল নীতি অবলম্বন করে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’ (ইবনে মাজাহ-২২০২)। নবীজী আরো বলেন, ‘ক্রয়-বিক্রয় ও পাওনা চাওয়ার সময় নম্রতা অবলম্বন করো’ (বুখারি)।

আরও পড়তে পারেন-

খ. অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জন হারাম: মিথ্যা শপথ, প্রতারণা, ছলচাতুরি, কথার মারপ্যাঁচ, সুদ, ঘুষ, জুয়া, দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি অনৈতিক উপায়ে সম্পদ অর্জন করাকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। ধোঁকাবাজি, মিথ্যার আশ্রয়, প্রতারণা ইত্যাদি অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন ও ভোগের কারণে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের একে অপরের মাল-সম্পদ খেয়ো না বাতিল (অন্যায়-অবৈধ) প্রক্রিয়ায় এবং জেনে-বুঝে মানুষের মাল-সম্পদের কিছু অংশ অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশে শাসকের সামনে উত্থাপন করো না’ (সূরা বাকারা : ১৮৮)।

মহানবী সা: বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের ময়দানে সালাত, সাওম, জাকাতসহ অনেক নেক আমল নিয়ে হাজির হবে; কিন্তু সে হয়তো কাউকে গালি দিয়েছে বা কারো ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে বা কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে বা কাউকে খুন করেছে অথবা কাউকে আঘাত করেছে। ফলে প্রত্যেককে তার হক অনুযায়ী এই ব্যক্তির নেক আমল থেকে দিয়ে দেয়া হবে।

যদি কারো হক বাকি থেকে যায় আর এই ব্যক্তির নেক আমল শেষ হয়ে যায় তাহলে হকদার ব্যক্তির পাপ পাওনা অনুসারে এই ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হবে। ফলে সে এই পাপের বোঝা নিয়ে জাহান্নামে যাবে’ (সহিহ মুসলিম-২৫৮১, জামে তিরমিজি-২৪১৮)।

গ. ব্যবসায় প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি নিষিদ্ধ: ব্যবসায়-বাণিজ্য ও লেনদেনে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পণ্যদ্রব্যে ভেজাল, ভালো পণ্যের সাথে খারাপ পণ্য মেশানো, পণ্যের দোষত্রুটি গোপন করা ইসলামে হারাম করা হয়েছে। নবী করিম সা: কেনাবেচার ক্ষেত্রে পণ্যের বিবরণ, মূল্য, মূল্য পরিশোধের সময় সুস্পষ্ট করতে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে লেনদেনের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা না দেয় এবং ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে মতদ্বৈধতা ও বিরোধ সৃষ্টি না হয়।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং যদি তুমি কোনো সম্প্রদায় থেকে খিয়ানতের (চুক্তি ভঙ্গের) আশঙ্কা করো, তা হলে তুমিও একইভাবে তাদের দিকে (চুক্তি) নিক্ষেপ করো। নিশ্চয় আল্লাহ খিয়ানতকারীদের ভালোবাসেন না’ (সূরা আনফাল : ৫৮)।

আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, পরস্পর ধোঁকাবাজি করো না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না, একে অন্যের পেছনে শত্রুতা করো না, একে অন্যের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করো না’ (সহিহ মুসলিম-২৫৬৪)।

ঘ. ওজনে কম দেয়া অপরাধ: ব্যবসায়-বাণিজ্যের বেলায় ক্রেতাকে ঠকানো হারাম। ক্রেতার অধিকার সঠিক ওজনে পণ্য লাভ করা। কুরআন ও সুন্নাহতে ওজনে কম দেয়াকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, নিন্দনীয় ও পরকালীন দুর্ভোগের কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য দুর্ভোগ। এরা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণমাত্রায় নেয় এবং যখন মানুষকে মেপে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে? সেই মহাদিবসে যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে’ (সূরা মুতাফফিফিন : ১-৬)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘যারা মেপে দেয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং ওজন করবে সঠিক দাঁড়িপাল্লায়, এটাই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্ট’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৫)।

রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখনই কোনো জনগোষ্ঠী মাপ ও ওজনে কম দেয়, তখনই তাদেরকে দুর্ভিক্ষ, খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি ও অত্যাচারী শাসকের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়’ (ইবনে মাজাহ)।
তিনি আরো বলেন, ‘কম মাপা ও কম ওজন করার কারণে পূর্ববর্তী উম্মতসমূহ ধ্বংস হয়েছে।’ (তিরমিজি)

ঙ. ভেজাল মেশানো হারাম: ইসলামের দৃষ্টিতে খাদ্য ও পানীয়তে ভেজাল মেশানো একটি মারাত্মক অপরাধ। খাদ্য ও পানীয় ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই যারা এসবে ভেজাল মেশায় তাদের কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘মানুষকে পরিমাপে কম বা খারাপ দ্রব্য কিংবা ত্রুটিযুক্ত জিনিস দিয়ো না’ (সূরা শোয়ারা : ১৮৩)।

পণ্যের দোষত্রুটি গোপন রাখা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যবসায়ীর জন্য উচিত নয় কোনো জিনিস বিক্রি করা এবং তার ভেতরের দোষত্রুটির কথা বর্ণনা না করা’ (মুসনাদে আহমাদ-১৭, ৪৫১)।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক। সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। বর্তমানে কো-অর্ডিনেটর, স্ট্যান্ডার্ড (ইসলামী) ব্যাংক লিমিটেড।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন