Home মহিলাঙ্গন বিচারপ্রার্থী কি ঘণ্টা মেপে বিচার চাইবে?

বিচারপ্রার্থী কি ঘণ্টা মেপে বিচার চাইবে?

- ফরিদা আখতার।

।। ফরিদা আখতার ।।

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় পাঁচ আসামিকে খালাস দিয়েছেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। প্রায় চার বছর আগে, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা এবং মামলা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আলোচনার শীর্ষে থাকা এই মামলায় ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি বেশ ধনী এবং প্রভাবশালী। আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেনের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচজন। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, জন্মদিনের পার্টির কথা বলে ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে উক্ত দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেন সাফাত ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফ। তারা আদালতের কাছে খালাস পেয়েছেন বটে, কিন্তু ধর্ষক হিসেবে তাদের নাম কি মুছে যাবে? কখনোই না।

প্রধান দুই আসামির খালাসের রায় শোনার পর, বলা বাহুল্য, এই দুই ভুক্তভোগী তরুণী চরমভাবে হতাশ হয়েছেন। তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের পক্ষের আইনজীবী এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করবেন। কারণ এই রায় মেনে নেওয়া যায় না। এবং আমরা আশা করব উচ্চ আদালত বিষয়টি গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করবেন। ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাবেন।

শুধু ভুক্তভোগী দুজন তরুণী নয়, হতাশ হয়েছেন সারাদেশের নারীসমাজও। হতাশ হয়েছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সারাদেশের বিবেকবান মানুষ; তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন আরও বেশি এই কারণে যে, রায়ে একইসঙ্গে ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুলিশ যেন মামলা গ্রহণ না করে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এই নির্দেশনাটি রায়ের পর্যবেক্ষণের অংশে রয়েছে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভিকটিমদের ডাক্তারি রিপোর্টে কোনো সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের বিবরণ নেই। ভিকটিমের পরিধেয়তে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মিলল না। আটত্রিশ দিন পর এসে তারা বলল “রেপড হয়েছি”, বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল। তা না করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের “পাবলিক টাইম নষ্ট” করেছেন।’ এরপর পর্যবেক্ষণ দিয়ে বিচারক বলেন, ‘পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে কোনো ধর্ষণের মামলা না নেয়।’

আরও পড়তে পারেন-

এই নির্দেশনাটি অমানবিক এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে, এবং ন্যায্যভাবেই প্রতিবাদ হচ্ছে। আরও প্রতিবাদের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে আগামী কয়েক দিনে।

ধর্ষণ এমন এক নির্যাতন, যাকে স্রেফ শারীরিক নির্যাতন হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। এর সঙ্গে নারীর নিজের চোখে নিজের মানবিক সত্তার উপস্থিতি এবং অপরদিকে সেই সত্তার সামাজিক স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির প্রশ্ন জড়িত। নিজের কাছে তার আপন সত্তার অবমাননা তীব্র হয়ে হাজির হয়। ধর্ষণের শিকার নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একটি বিশেষ খোপে পুরে দেয় এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে আরও কঠোরভাবে বুঝিয়ে দেয় সে কতটা অধঃপতিত হয়েছে। এইসব সহ্য করা সব নারীর পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই অনেক নারী আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি যেভাবে বোঝায়, এই সত্তাহানি মোটেও নারীর ইজ্জত বা আত্মসম্মানহানির ব্যাপার নয়। আমাদেরকে এই মনোভাব থেকে বের হতে হবে এবং একইসাথে ধর্ষকের বিচার চাইতে হবে।

নারী আন্দোলনের কাছে ধর্ষণ তাই সবসময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদের বিষয় হিসেবে হাজির হয়েছে। এক নারীকে ধর্ষণ করলে তার বিরুদ্ধে কোটি নারী সোচ্চার হচ্ছেন। কারণ, এর মধ্য দিয়ে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেও লড়তে হচ্ছে। ধর্ষণের বিচার চাওয়া এবং ন্যায়বিচার পাওয়া নারী আন্দোলনের কাছে তার মানবিক সত্তার ওজন ও গুরুত্ব সমাজকে বুঝিয়ে দেবার লড়াই।

এই রায় এমন হলো কেন, এই প্রশ্ন আজ আমাদের সবার। বাদীপক্ষ বা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর চেয়েও আসামিপক্ষের আইনজীবী বেশি দক্ষ ছিলেন কি না সে বিতর্কে আমি যাব না। একজন নারী আন্দোলন কর্মী হিসেবে আমি বুঝি এই দুই ভুক্তভোগী সুবিচার পাননি। এবং আগামীতে আরও অনেক নারীর সুবিচার পাওয়ার পথও রুদ্ধ হতে চলেছে যদি বিচারকের নির্দেশনা কাজে লাগানো শুরু হয়। ধর্ষকরা অবশ্যই সেই সুযোগ কাজে লাগাবে এবং কোনোমতেই ধর্ষণের শিকার কোনো নারী যেন ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিনের মধ্যে মামলা না করতে পারে তার জন্যে আরও নির্যাতন চলবে। আফসোস, বিচারক একজন নারী হয়েও ঘটনাটি অনুধাবন করার চেষ্টা করলেন না। তিনি অবশ্য বিজ্ঞ একজন বিচারক। বিষয়টি তিনি বুঝবেন না এমন হতে পারে না।

এত দিন অনেক আন্দোলনের ফলে একটি আইন জুটেছিল, যার অনেক দুর্বলতা ও ফাঁকফোকর থাকলেও নারী ধর্ষণের মতো নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে বিচার চাইতে পারে, তার একটা সামাজিক ও আইনি স্বীকৃতি ছিল। একটা হলেও উপায় ছিল। আলামতের ফরেন্সিক টেস্টের সুবিধার জন্য ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা করার পরামর্শ আইনজীবীরাও দিয়ে থাকেন। ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে দ্রুত মামলা করা ভালো, সেই অর্থে যদি বিচারক কথাটি বলতেন তাহলে নিশ্চয়ই কারও আপত্তি থাকত না। কিন্তু পুলিশকে ৭২ ঘণ্টার পরে কোনো মামলা না নেওয়ার কথা বলা হলে সেটা তার এখতিয়ারে পড়ে কি না সেই প্রশ্ন তুলেছেন নারী আন্দোলন ও মানবাধিকারকর্মীরা। প্রশ্ন উঠেছে, ৭২ ঘণ্টা পার হলে কি ধর্ষণ ন্যায্যতা পেয়ে যাবে? ধর্ষক বেকসুর হয়ে যাবে?

এত দিন ধর্ষণের বিরুদ্ধে মামলার একটি বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল ধর্ষককে চিহ্নিত করে নাম ধরে মামলা করতে পারার। ধর্ষক গরিব বা সাধারণ কেউ হলে তাকে সাজা দিয়ে আইনের প্রয়োগ এত দিন দেখানো গেছে। কিন্তু যখন থেকে প্রভাবশালী এবং ধনী ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা হতে শুরু হয়েছে, তখন থেকে ধনীদের অর্থ ও প্রভাবের দাপটে আইন প্রয়োগের প্রতিবন্ধকতা এবং সুবিচারের পথও রুদ্ধ করার সব ধরনের চেষ্টা হচ্ছে। খুব সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবারকে হুমকি-ধমকি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া। মামলা তুলে নিতে বাধ্য করা। এখন তাদের হাত আরও বেশি লম্বা হয়ে গেছে। ধনী ও দাপুটে শ্রেণী সাময়িকভাবে ‘সফল’ও হচ্ছে। নারীকে ধর্ষণ করে দিব্যি সমাজে ঘুরে বেড়াতে পারছে। খালাস পেয়ে যাচ্ছে।

আমাদের দেশ এখন ধনী-গরিব দুভাগে ভাগ হয়েছে। মাত্র ৫ শতাংশ ধনী ২৫ শতাংশ সম্পদের মালিক হয়ে ৯৫ শতাংশ মানুষের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছে না গরিব ও নিম্নবিত্ত নারীরা। তাই তারা ধর্ষণ করলেও খালাস পেয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতেও তাদের রক্ষার জন্যে বিশেষ নির্দেশনা আসছে। সমাজের অন্যায়-অবিচার এখন নগ্নভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিচার চাওয়ার জন্যে পথ বন্ধ করার এখতিয়ার কি কারও থাকতে পারে? বিচারপ্রার্থী কি ঘণ্টা মেপে বিচার চাইবে? আজ নারী-পুরুষ সবাই-ই রাস্তায় নেমেছে এই রায় এবং নির্দেশনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। কারণ এই নির্দেশনা কোনোভাবেই থাকতে পারে না। নারীর বিরুদ্ধে অন্যায় ও অপরাধের বিচার হতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।