Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ সোশ্যাল মিডিয়া ও স্মার্টফোনের যুগে মানুষের মিথ্যাচার কেন বাড়ছে?

সোশ্যাল মিডিয়া ও স্মার্টফোনের যুগে মানুষের মিথ্যাচার কেন বাড়ছে?

।। জান্নাতুল নাঈম পিয়াল ।।

ধরুন আপনার গন্তব্য ঢাকার শাহবাগ, এই মুহূর্তে আছেন কাজিপাড়ায়। কিন্তু কেউ ফোন দিয়ে আপনার অবস্থান জানতে চাইলে আপনি অবলীলায় বলে দিলেন, ‘এই তো, ফার্মগেট পর্যন্ত এসেছি।’

খুব চেনা-পরিচিত মনে হচ্ছে না ঘটনাটিকে? হওয়ারই কথা। কারণ দেশে মোবাইল ফোন সহজলভ্য হওয়ার দরুণ আরও অন্তত এক দশক আগে থেকেই এ ধরনের ‘মোবাইল মিথ্যাচার’-এর সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা।

এবং এখন যেহেতু মোবাইল ফোনের মতো ইন্টারনেটও দেশের সিংহভাগেরই হাতের নাগালে, তাই জনগণের মিথ্যা বলার প্রবণতা, সুযোগ ও সম্ভাবনাও যেন এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে।

শুধু বাংলাদেশই নয়, গোটা বিশ্বব্যাপীই প্রযুক্তির অভিশাপে মিথ্যাচার এক মহামারি রূপ ধারণ করেছে। কোভিড-১৯ এর মতো, একেও একটি বৈশ্বিক মহামারি বা অতিমারি হিসেবেও অভিহিত করলেও অত্যুক্তি হবে না।

কে বা কারা সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলে, এ প্রশ্ন তো আমাদের সকলেরই। পাশাপাশি সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরেই আরও জানার চেষ্টা করে আসছেন, কোন পরিসরে মানুষের মিথ্যা বলার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি – অর্থাৎ, কোন মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষ সবচেয়ে বেশি মিথ্যা বলে।

এই বিষয়ে একদম প্রথম দিককার একটি গবেষণা করা হয় ২০০৪ সালে। সেখানে জানার চেষ্টা করা হয়, মিথ্যাচার বা ছলনার সঙ্গে প্রযুক্তির সম্পর্ক ঠিক কতটা। সেখানে মূলত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মিথ্যাচারটিই প্রধান হিসেবে উঠে এসেছিল, যার উদাহরণ আমরা এই লেখার শুরুতেই দিয়েছি।

কিন্তু তারপর থেকে গত ১৭ বছরে প্রযুক্তি, কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে, এক বিপ্লব ঘটে গেছে। এখন আর আমাদেরকে যোগাযোগের জন্য কাউকে কল দিতে হয় না। মেসেজিং বা চ্যাটের মাধ্যমে লিখিত আকারে মুহূর্তের মধ্যেই আমরা আদান-প্রদান করে ফেলতে পারি মনের ভাব। আর সেই আদান-প্রদানের বেশ বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে মিথ্যাচারও।

২০০৪ সালে যোগাযোগ গবেষক জেফ হ্যানকক ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে ২৮ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জানতে চান, তারা সাত দিন সময়কালের মধ্যে সামনাসামনি, ফোন, ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং এবং ইমেইলের মাধ্যমে কতটুকু পরিমাণ যোগাযোগ করেছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হয় যে তারা প্রতিটি সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় কতবার মিথ্যা কথা বলেছে।

জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলেছে ফোনে কথা বলতে গিয়ে। আর তারা সবচেয়ে কম মিথ্যা বলেছে ইমেইলে।

হ্যানকক তাঁর গবেষণার মাধ্যমে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছান তা হলো : ফোনের বিভিন্ন ফিচারের মাধ্যমে যেসব সামাজিক মিথস্ক্রিয়া হয়ে থাকে, সেগুলোতে মানুষ সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলে থাকে। কিন্তু একই সঙ্গে দুজন মানুষই কথা বলছে না, বরং মেসেজ রেকর্ড হয়ে থাকছে, এমন ফিচারের কারণে মানুষ ইমেইলে সবচেয়ে কম মিথ্যা কথা বলে থাকে।

তবে এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, হ্যানকক যখন প্রথম তাঁর এই গবেষণাটি করেছিলেন, তা সীমাবদ্ধ ছিল মাত্র অল্প কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ফেসবুক তখনও বিশ্বকে দখল করে নেয়নি, এবং আইফোনও ছিল তার বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে।

১৭ বছর বাদে বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর মিথ্যাচারের প্রকৃত চিত্র কেমন?

এ প্রশ্ন মাথায় রেখে একটি নতুন গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওরেগনের যোগাযোগের অধ্যাপক ডেভিড মার্কোউইটজ। তিনি এ কাজের জন্য আরও বেশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, এবং প্রযুক্তির আরও অনেকগুলো মাধ্যমে তাদের সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ধরন যাচাই করে দেখেন। সব মিলিয়ে ২৫০ জন মানুষ সাতদিনব্যাপী সামনাসামনি, সোশ্যাল মিডিয়া, ফোন, টেক্সটিং, ভিডিও চ্যাট ও ইমেইলে তাদের যোগাযোগ রেকর্ড করেন।

হ্যানককের গবেষণার মতোই, নতুন এই গবেষণায়ও দেখা যায় যে মানুষজন সেই ধরনের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলছে, যেখানে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ একই সময়ে ঘটছে না, যোগাযোগের রেকর্ড থাকছে না, এবং যখন বিপরীত দিকের মানুষটি অনেক দূড়ে অবস্থান করছে।

এবারও দেখা গেছে, ইমেইলেই মানুষ সবচেয়ে কম মিথ্যাচার করছে। তবে মজার ব্যাপার হলো, এবার বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যাচারের পার্থক্যটা কমে এসেছে। এবার মাধ্যমগত পার্থক্যের চেয়ে যোগাযোগে অংশগ্রহণকারীদের পার্থক্য, তাদের মিথ্যাচারের প্রবণতা – এসব ব্যাপারই মিথ্যাচারের প্রবণতাকে প্রভাবিত করেছে।

গত প্রায় দুই দশক ধরে মানুষের যোগাযোগের পদ্ধতিতে যতই পরিবর্তন আসুক, এবং কোভিড-১৯ মহামারির কারণে মানুষের সামাজিকতা রক্ষার ধরন যতই পালটে যাক না কেন, মানুষ এখন আরও বেশি করে পদ্ধতিগত মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়।

তবে মার্কোউইটজের এই গবেষণার ফলাফল থেকে আমাদের একটি জরুরি বিষয় দেখার আছে। আপাতদৃষ্টিতে যতই মনে করা হোক না কেন যে মুখোমুখি কথা বলার সঙ্গে ফোনে বা ভিডিও চ্যাটে কথা বলার শতাংশের হার তো খুব বেশি নয়, তারপরও আরেকটু গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যাবে ব্যাপারটি মোটেই অগুরুত্বপূর্ণ বা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

আরও পড়তে পারেন-

প্রযুক্তির যখন এমন রমরমা অবস্থা ছিল না, আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম খুবই সীমিত ছিল, তার তুলনায় বর্তমানে প্রযুক্তির আশীর্বাদে যোগাযোগের মাধ্যম বৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের যোগাযোগের পরিমাণও অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন হয়তো আমরা আগেকার মতো সামনাসামনি যোগাযোগ করি না, তারপরও সব ধরনের মাধ্যম মিলিয়ে আগের চেয়ে যোগাযোগ আমরা বেশিই করি।

এবং এখন আমরা আগের চেয়ে কেবল বেশি যোগাযোগই করি না, বরং এখন আমাদের যোগাযোগ হয় আরও বেশি দ্রুত ও সমসাময়িক। ফলে এ ধরনের যোগাযোগের মিথ্যাচার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আরও বেশি প্রভাব ফেলে, ভবিষ্যতেও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ ধরনের মিথ্যাচারে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে।

এই দাবির স্বপক্ষেও রয়েছে জোরালো যুক্তি। গত অক্টোবর মাসের শুরুর দিকেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল অনলাইনে মিথ্যাচার বিষয়ক একটি জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশেও এ প্রতিষ্ঠানটির শাখা রয়েছে। তাদের জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে প্রায় নয় জন বা ৮৭ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী মনে করেন, অনলাইনে ভুল তথ্য ও অসত্য তথ্য তাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

এছাড়া ওই জরিপের মতে, ৬৫% অংশগ্রহণকারী বলেছে, ফেইসবুকে সবচেয়ে বেশি ভুল ও মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। এরপরই আছে টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউব (সবগুলো ২৭%)। অনলাইনে মিথ্যা তথ্যের কারণে প্রতি পাঁচ জনের একজন মেয়ে (২০ শতাংশ) নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে বলেও এ জরিপে উঠে এসেছে।

জরিপে অংশ নেওয়া প্রতি তিনজনের একজন জানায়, মিথ্যা তথ্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাদের চিন্তিত, আতঙ্কিত এবং বিষাদগ্রস্ত করে তোলে।

আর অনলাইনে মিথ্যাচারের সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে জেফ হ্যানকক যে বিষয়টিকে চিহ্নিত করেছেন, তা হলো মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হওয়া।

অনলাইনের বদৌলতে বর্তমানে রাইড শেয়ারিং থেকে শুরু করে এয়ারবিএনবির মতো অ্যাপার্টমেন্ট রেন্টাল কিংবা হরেক রকমের ব্যবসা গড়ে উঠেছে। যেহেতু সামনাসামনি এখানে ক্রেতা-বিক্রেতার দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে না, তাই পারস্পরিক বিশ্বাসটাই এখানে সবচেয়ে বড় পুঁজি।

কিন্তু অনলাইন মিথ্যাচারের প্রবণতা যদি ক্রমশ বাড়তে থাকে, তাহলে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটা ধাক্কা খাবে, ফলে অনলাইনের প্রায় সব ধরনের সুফল বা পরিষেবাই ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

ব্যক্তি পর্যায়ের মিথ্যাচার, বিশ্বাস ভাঙার মতো প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসে যদি আরও বিস্তৃত অর্থে অনলাইনে মিথ্যাচার, ভুল তথ্য ছড়ানো নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তবে এ লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। তবে অনলাইনভিত্তিক ভুল তথ্য ছড়ানো যে ব্যক্তিগত মিথ্যাচারেরই একটি সম্প্রসারিত ও পূর্ণাঙ্গ রূপ, সে কথা বলাই বাহুল্য।

আগে মূলত গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যম মিথ্যাচার করলে তা গণপরিসরে ক্ষতিকর হিসেবে আবির্ভূত হতো। মানুষের ব্যক্তি পর্যায়ের মিথ্যাচার বিপুল মানুষকে প্রভাবিত করতে পারত না। কিন্তু বর্তমানে অনলাইনের কল্যাণে একজন ব্যক্তিবিশেষের একটি সামান্য মিথ্যাচারও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা ইন্টারনেট পরিসরে।

উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে হয়ে যাওয়া বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ব্যাপারে। এক্ষেত্রে একটি পরিচিত চিত্র ঘুরেফিরে আসতে দেখা যায়, তা হলো, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য একটি মিথ্যাচার করছে, যা ভাইরাল হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ার দরুণ দেশব্যাপী ব্যাপক হানাহানির সৃষ্টি হচ্ছে।

প্রযুক্তি আমাদেরকে দিয়েছে বেগ, সহজ করে তুলেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে। তারপরও প্রযুক্তির এ ধরনের অপব্যবহার আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনে অপরিসীম প্রভাব ফেলছে।

তাই অনলাইনের টুকটাক, অতি সাধারণ মিথ্যাচারকেও হালকাভাবে নেওয়ার উপায় নেই। এখনই সময় অনলাইন মিথ্যাচারের ব্যাপারটিকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার, নিজেদের জীবন থেকে যতটা সম্ভব এর অস্তিত্বের বিনাশ ঘটানোর। কেননা একে তো এর মাধ্যমে অনলাইন দুনিয়া থেকে ‘বিশ্বাস’ নামক শব্দটি লোপ পেতে শুরু করেছে, অন্যদিকে কথায় তো আছেই, “ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল…”

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।