Home ওপিনিয়ন কম্যুনালিজম বনাম সাম্প্রদায়িকতা

কম্যুনালিজম বনাম সাম্প্রদায়িকতা

।। মুনির আহমদ ।।

‘সাম্প্রদায়িকতা’ কথাটি বাংলাদেশে ভুল অর্থেই ব্যবহৃত হয় বলে মনে করি। “সাম্প্রদায়িকতা” শব্দটি এই উপমহাদেশের নিজস্ব আবিষ্কার। এ আবিষ্কার আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছে। কারণ এই শব্দ ব্যবহার করে আমরা যা বলতে চাই, তা বলা যায় না। এটা দিয়ে বলতে গেলে বিতর্কের সৃষ্টি করে; কোন ইতিবাচক ধারণা বাব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে না। কেন এমনটা হয়, এর ব্যাখ্যা দিচ্ছি।

‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি ইংরেজি ‘কম্যুনাল’ শব্দ থেকে এসেছে। কিন্তু ইংরেজী ভাষায় কমুন্যাল শব্দটা ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি ভাষায় ‘কম্যুনাল’ শব্দটি এসেছে ফরাসী শব্দ ‘কমিউন’ থেকে। এই ‘কমিউন’ থেকেই এসেছে ‘প্যারিকমিউন’। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, প্যারিকমিউন ছিলো ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত স্থায়ী পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্র। স্বাভাবিক ভাবেই, ‘কমিউন’ শব্দের মধ্যে একটা প্রগতিশীল উপাদান আছে।

অক্সফোর্ডডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল’ শব্দের প্রথম অর্থ হচ্ছে-‘shared by all members of a community; for common use’ অর্থাৎ- ‘কমিউনিটির বা সম্প্রদায়ের সকল সদস্যের অংশীদারিত্বে, সাধারণ ব্যবহারের জন্য’। সেই কারণেই ইউরোপে ‘কম্যুনাল’ একটি ইতিবাচক ধারণা। এমন কি, নানা দেশে ‘কম্যুনাল চাইল্ড রীয়ারিং’ (শিশুপালন), ‘কম্যুনালএডুকেশন’ (শিক্ষা), ‘কম্যুনাল হাউজিং (আবাসান)’ ‘কম্যুনাল লিভিং’ (বসবাস), ‘কম্যুনাল কুকিং (রান্না)’ ‘কম্যুনাল ইটিং’ (ভোজন) ‘কম্যুনাল স্লীপিং’ (নিদ্রা), ‘কম্যুনাল পার্কিং’ (গাড়ী রাখা), ‘কম্যুনাল সেফটি’ (নিরাপত্তা) ইত্যাদির চর্চাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়।

আমরা ইসলামেও কমুন্যাল শব্দটা ইউরোপীয় অর্থে ব্যবহার করি। সম্প্রদায় বা কমিউনিটি গড়া ইসলামের কাজ। ইসলামে ‘উম্মাহ’ শব্দের অর্থ কমিউনিটি। এই কমিউনিটি শুধু মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়ে নয়, বরং সমাজে বসবাসকারী অন্য সকলের সম্মিলিত কমিউনিটি। আমরা মদীনা সনদে এই উম্মাহ-এর পরিচিতি কীভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেটা দেখতে পাই।

এ কারণেই উম্মাহ বা সম্প্রদায়ের অধীন থাকা ইসলামে খুবই গুরুত্বপুর্ণ। কিন্তু যখন আমরা ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটাকে নেতিবাচক ভাবে ব্যবহার করি, তখন তা একজন সাধারণ মুসলমানের লালিত হাজার বছরের চর্চা আর বিশ্বাসকে নেতিবাচকভাবে নাড়া দেয়। সে মনে করে, তাহলে কি আমার সমাজ আর সম্প্রদায়ের অধীন থাকাটা অন্যায়?

পশ্চিমের সাথে ইসলামের মূল পার্থক্য হচ্ছে, পশ্চিমে ব্যক্তি আগে, আর ইসলামে সমাজ আগে, সম্প্রদায় আগে; আর ব্যক্তি সমাজের অধীন। তাই উম্মাহ; তথা সম্প্রদায় বা কমিউনিটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আরও পড়তে পারেন-

এবার দেখুন, কেন সাম্প্রদায়িক শব্দটা নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে? অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ‘কম্যুনাল’ শব্দের দ্বিতীয় আরেকটি অর্থ আছে, যেটির ব্যবহার ইউরোপে হয় না বললেই চলে। ‘কম্যুনাল’ শব্দের দ্বিতীয় অর্থটির উদ্ভব হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক ভাষ্য থেকে; যা নেতিবাচক। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ‘কম্যুনাল’ শব্দের দ্বিতীয় অর্থ বলা হয়েছে- ‘(of conflict) between different communities, especially those having different religions or ethnic origins’ অর্থাৎ- বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্য সংঘাত বিষয়ক- বিশেষ করে যাদের মূলে রয়েছে ধর্মীয় ও জনজাতিক ভিন্নতা। যখন বৃটিশ আমলে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সাথে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হল, তখন সেটাকে সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করা হল। এই ঐতিহাসিক কারণেই ভারতীয় উপমহাদেশে ‘কম্যুনাল’ একটি নেতিবাচক শব্দ।

তাই উপনিবেশের উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা বলতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে সংখ্যাগুরুদের জুলুমকে বুঝি। এটা নিশ্চয় একটা সমস্যা, গুরুতর সমস্যা তো বটেই। তবে ধ্রুপদি অর্থে এটাকে সাম্প্রদায়িক সমস্যা বলে একাডেমিক মহলে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আমার ধারণা, বর্তমানে মিডিয়ায় ও নানা আলোচনায় এই ২য় অর্থেই ‘সাম্প্রদায়িকতাকে সমস্যা হিসেবে চিত্রিত করা হয়।

এই প্রসঙ্গে বলতে গেলে আরো বলতে হয়, আমরা সম্ভবতঃ দুনিয়ার সব থেকে অসহায় নাগরিক, যারা তার সরকারের কোনো রকম সমালোচনা করার অধিকার রাখি না। পাকিস্তান আমলে সরকারকে সমালোচনা করলে আমরা হয়ে যেতাম ভারতীয় দালাল! আর এখন সমালোচনা করলে হয়ে যাই পাকিস্তানের দালাল অথবা রাজাকার! বিএনপি সরকার আমলে হয়ে যেতাম আওয়ামীলীগের লেজুড়! আসলে আমরা সাধারণ নাগরিকরা কখনো স্বাধীন মানুষ হতে পারিনি। পাকিস্তান অথবা পরবর্তীতে বাংলাদেশের এরশাদ/বিএনপি আমলে সরকারকে সমালোচনা করলে জেল-জুলুম হতো। কিন্তু এখন জীবন চলে যায়, ‘নাই’ হয়ে যেতে হয়!

আমাদের এই ভূখন্ডটি এখনো ‘রাষ্ট্র’ হতে পারেনি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য বলা যায়! এর প্রধান কারণ, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাদের কোনো রকম শিষ্টাচার বহির্ভুত লাগাতার হস্তক্ষেপের কারণে আমরা আজও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তো দূরের কথা ‘রাষ্ট্র’ই বানাতে পারিনি। একই সাথে পরা শক্তিসমূহের আধিপত্য তো আছেই। আমরা আমাদের নিজের মতো করে চিন্তা করতে পারি না। আমাদের উপর চিন্তা চাপিয়ে দেয়া হয়।

অন্যদিকে রাষ্ট্র ঠিক মতো তৈরি না হওয়ার কারণে আমাদের জনগণও নাগরিক না হয়ে, তারা হয়েছে দলীয় কর্মী! তাদের বিচার বিশ্লষণের ক্ষমতা এমন কি বিবেকটাও তারা বন্ধক রেখেছে রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের কাছে। আর আমাদের সংখ্যালঘু শ্রেণী: নাগরিক, রাজনৈতিক সচেতনতা তো দূরের কথা, তারা হয়েছে একটি বিশেষ দলের অন্ধ সমর্থক! দলটি ঐ অন্ধত্বেরই সুযোগ নেয়। অনেকেই এইসব ঘটনার জন্য ইঙ্গিত করেন আমার দেশের সরলপ্রাণ খেটে খাওয়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিকে! আর সংখ্যালঘুদের সাথে সংঘটিত যে কোন নেতিবাচক ঘটনাকে বলা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতা! কিন্তু এটা মোটেও ‘সাম্প্রদায়িকতা’ না। এটা হলো দূর্বলের সম্পত্তিতে ধনিক ক্ষমতাবানের দখলদারিত্ব। ইসলামের ভাষায় জালিমের জুলুম।

আমরা, আমাদের নাগরিকরা রাষ্ট্র গঠনের কাজটা সম্পন্ন করতে পারলে, সেই রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সুরক্ষা পাবে। মুক্তি যুদ্ধের ঘোষণা ছিল, সাম্য, মানবসত্তার মর্যাদা, আর ইনসাফের ভিত্তিতে রাষ্ট্র তৈরির। আমরা সেই কাজটা করতে পারিনি। আমরা বাঙালি হয়েছি, পাহাড়ি হয়েছি, হিন্দু হয়েছি, মুসলমান হয়েছি, কিন্তু নাগরিক হতে পারিনি। সকলকে নিয়ে সকলের কল্যাণের রাষ্ট্র তৈরি করতে পারিনি; যা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল।

এটা সকলকে বুঝতে হবে যে, সকল মানুষ চিন্তা করতে সক্ষম। আমরাও দেশ নিয়ে ভাবি, সমাজ নিয়ে ভাবি। অথচ, আমাদের মিসরিপ্রেসেন্ট করা হয়, আমরা যা নই তা আমাদের ভাবতে হয়। আর আমরা যা ভাবি বা চিন্তা করি, সেটা শোনা হয় না। আমাদের বলবার স্পেস থাকলে, আমরা সংলাপ করতে পারলে, আমরা একসাথে সমাজের সকলকে নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো। বর্তমানে যেটাকে ‘সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা’ বলা হচ্ছে, সেটা আসলে রাষ্ট্র গঠনের সমস্যা। এ সমস্যার কারণেই আমরা নাগরিক হয়ে পরস্পরের অভিন্ন স্বার্থ নিয়ে নাগরিক সুরক্ষার জন্য কথা বলতে পারি না।

ই-মেইল: munirmmi09@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।