Home ইতিহাস ও জীবনী স্মৃতির আরশিতে চিরভাস্বর ফকীহুল আসর মুফতিয়ে আযম আল্লামা চাটগামী (রহ.)

স্মৃতির আরশিতে চিরভাস্বর ফকীহুল আসর মুফতিয়ে আযম আল্লামা চাটগামী (রহ.)

।। মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত রাফি ।।

২৯ মুহাররম ১৪৪৩ হি., ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈ. রোজ বুধবার বেলা ১১ টা ৩০ মিনিটের দিকে অগণিত ছাত্র, ভক্ত ও অনুসারীদের শোকসমুদ্রে ভাসিয়ে প্রিয় মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান বিশ্ববরেণ্য আলেমে দীন, মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের স্পন্দন, জগদ্বিখ্যাত ফকীহ, মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ, মুফতী মুহাম্মদ আব্দুস সালাম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ)। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।

মুফতিয়ে আযম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ) ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানাধীন নলদিয়া গ্রামের এক অভিজাত দীনদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর সম্মানিত পিতার নাম শেখ খলীলুর রহমান। স্থানীয় মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার জামিয়া আজিজিয়া বাবুনগর মাদরাসায় ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।

অতঃপর চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন দীনী শিক্ষা নিকেতন জিরি জামিয়া আরবিয়া ইসলামিয়ায় ভর্তি হন এবং সুদীর্ঘ ৭ বছর অত্যন্ত কৃতিত্বের সহিত পড়াশোনা করে ১৯৬৭ সালে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। এরপর হাদীস ও ফিক্হ শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য আসাতিযায়ে কেরামের পরামর্শে পাকিস্তানের জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানূরী টাউন করাচীর উদ্দেশ্যে সফর করেন। সেখানে গিয়ে পুনরায় দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হন। দাওরায়ে হাদীসের পাকিস্তান-কেন্দ্রীয় বোর্ড পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। জীবনের সব পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।

অতঃপর আল্লামা ইউসূফ বানূরী (রহ.) ও মুফতী ওলী হাসান টুংকী (রহ.)এর তত্ত্বাবধানে উচ্চতর ইসলামী আইন গবেষণা বিভাগে দুই বছর গবেষণা করে তাখাস্সুস সনদ অর্জন করেন। এ বিভাগে গবেষণাকালে দুই বছরে ইসলামী আইন বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থের প্রায় ৪৮ হাজার পৃষ্টার অধিক অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর ভাষা দক্ষতা, ইলমী গভীরতা, সৃজনসীল প্রতিভা ও উত্তম আখলাকে মুগ্ধ হয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের, বিশেষত মুফতী ওলী হাসান টুংকী (রহ.)এর পরামর্শে আল্লামা ইউসূফ বানূরী (রহ.) তাঁকে বানূরী টাউন মাদরাসায় সহকারী মুফতী হিসেবে নিয়োগ দেন। মুফতী ওলী হাসান টুংকী (রহ.)এর ইন্তিকালের পর তিনি প্রধান মুফতী হিসেবে মনোনীত হন। ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় সুদীর্ঘ ৩০ বছর বানূরী টাউন মাদরাসায় তিনি ফিক্হ ও ফাতওয়ার খিদমত করেছেন। পাশাপাশি মুসলিম শরীফ ও তিরমিযী শরীফের পাঠদানও করেছেন।

২০০১ সালে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর অনুরোধে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দীনী বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে মুফতী ও মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। মুফতিয়ে আযম মুফতী আহমদুল হক (রহ.)এর ইন্তিকালের পর তিনি মুফতিয়ে আযম মনোনীত হন। আমৃত্যু এই পদে অধিষ্ঠিত থেকে ইলমে ফিক্হের সুমহান খিদমত আঞ্জাম দেন।

আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর ইন্তিকালের পর মাজলিসে ইদারীর প্রধান নির্বাচিত হয়ে প্রায় ১ বছর অত্যন্ত দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও কৃতিত্বের সাথে পরিচালনার গুরু দায়িত্বও পালন করেন। ইন্তিকালের কিছুক্ষণ পূর্বে হাটহাজারী মাদরাসায় অনুষ্ঠিত মাজলিসে শূরায় সর্বসম্মতিক্রমে মহাপরিচালক মনোনীত হন। এ হিসেবে তিনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও দারুল উলূম হাটহাজারীর মহাপরিচালক ছিলেন।

এই কালজয়ী মহাপুরুষ সারা জীবন পঠন-পাঠন, ফাতওয়া লিখন, আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসায় নানা সৃষ্ট মাসায়িলের শরীয়াহ সম্মত সমাধান দিয়ে গেছেন। সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনের দৈনন্দিন নানা প্রশ্ন, সঙ্কট, দাম্পত্য সমস্যা, নারী অধিকার, সুদনির্ভর ও সুদমুক্ত ব্যবসা, ব্যাংক, বিমা, ইসলামী অর্থনীতি ও শেয়ার ব্যবসা প্রভৃতি আধুনিক বিষয়ের কুরআন, হাদীস ও ফিক্হে ইসলামীর আলোকে সমাধান দিতে প্রয়াসী ছিলেন।

তাঁর তিরোধানে মুসলিম উম্মাহর যে ক্ষতি হয়েছে, বিশেষত ফিক্হ ও ফাতওয়া-অঙ্গনে যে শূন্যতা বিরাজ করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন ক্ষণজন্মা মহিরুহ পৃথিবীতে বারবার আসে না; কালের পরিক্রমায় শতাব্দী থেকে শতাব্দী অন্তর ইনকিলাব ও ইসলামী রেঁনেসার জন্য আল্লাহ তায়ালা মানুষের উপর ইহসান স্বরূপ এমন মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটান।

যখনই হযরত মুফতিয়ে আযম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ)-এর নাম শোনেছি; পরিচয় লাভ করেছি, তখন থেকেই তাঁর সান্নিধ্য লাভ ও ইলমী দস্তরখানে শামিল হওয়ার আকাক্সক্ষা বুকে ধারণ করেছি। তাকমীল শেষ করার পর দীর্ঘ দিনের এই লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দারুল উলূম হাটহাজারীর ফাতওয়া ও ইসলামী আইন অনুষদে ভর্তি হই।

গত বছর (১৪৪১-৪২ হি.) ইসলামী আইন অনুষদের প্রথম বর্ষের তালিবুল ইলম থাকাকালীন ইলমী ও আমলী ইস্তিফাদা এবং দৈনন্দিন অধ্যয়নে সৃষ্ট নানা প্রশ্ন, সংশয় ও জঠিলতার সমাধানের জন্য হযরতের নিকট আসা-যাওয়া করতাম। এ বছর (১৪৪২-৪৩ হি.) আল্লাহ তায়ালার অপার করুণায় হযরতের পাশের রুমে, হযরতের ইশরাফ ও খিদমতে থাকার জন্য মনোনীত হই।

এ হিসেবে শাওয়াল থেকে মৃত্যুপূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত প্রায় চার মাস হযরতের সান্নিধ্যে থাকার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার অর্জন হয়েছে। তবে এ সান্নিধ্য দীর্ঘায়িত না হওয়ার তরতাজা ব্যথা আমৃত্যু আমাকে সয়ে যেতে হবে। এ অল্প সময়ে হযরতের যেসব গুণ, বৈশিষ্ট্য, মর্যাদা ও দক্ষতা আমাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করত, তার কয়েকটি অতি সংক্ষেপে তুলে ধরার প্রয়াসী হব ইন শা আল্লাহ।

দীনের মুখলিস সেবক

হযরত মুফতিয়ে আযম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ)-এর ৭৮ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন ছিল দীনের জন্য উৎসর্গ। তাঁর খিদমতের পরিধি শুধু দীনী শিক্ষা-দীক্ষা বিতরণ এবং মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং ওয়ায-নসীহত, দাওয়াত ও তাবলীগ, কিতাবাদি রচনা, সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও ফাতওয়া লিখন, পরোপকার, গরিব-অসহায় মেধাবী ও আগ্রহী ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা, এতিম পরিবারের অভিভাবক ও তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হওয়া থেকে নিয়ে দীনের প্রায় প্রতিটি শাখায় তিনি খিদমত করেছেন।

তিনি কোনো কাজ নিজস্বার্থ বা দুনিয়া লাভের জন্য করতেন না। যা করতেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও আখেরাতের জন্য করতেন। তিনি ছিলেন দীনের একজন মুখলিস সেবক। তাঁর প্রতিটি কর্মই ছিল ইখলাসের মহিমায় উজ্জীবিত।

ইসলামী আইন অনুষদের আমার এক ঘনিষ্ঠ সহপাটি একদিন আমরা কয়েকজনকে লক্ষ্য করে বলেন, হাটহাজারী মাদরাসায় ইখলাসের সহিত কাজ করছেন শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি। আর তিনি হলেন মুফতিয়ে আযম মুফতী আব্দুস সালাম সাহেব। তিনি আরও বলেন, আমি এ কথা এ মাদরাসার অনেক উস্তাদকেও বলেছি। এ কথাটি বলার সময় তাঁর অবয়বে আবেগ ও দরদের চাপ ভাসমান ছিল। এ কথা শোনে আমি তাঁকে রসিকতা করে বললাম, যা হোক, আপনি আমার শায়খকে যথাস্থানে রেখেছেন, এজন্য আপনাকে জাযাকাল্লাহ।

অমুখাপেক্ষিতার অনন্য দৃষ্টান্ত

মুখাপেক্ষিতা মানুষের উন্নতি, অগ্রগতি এবং হক প্রতিষ্ঠার মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পরন্তু অমুখাপেক্ষিতা এমন এক গুণ, যা মানুষকে সফলতার অন্তিম চূড়ায় পৌঁছিয়ে দেয়। মুফতিয়ে আযম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ)-এর অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য ছিল অমুখাপেক্ষিতা। তিনি একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া দুনিয়ার আর কারো মুখাপেক্ষী ছিলেন না। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, পদ, মর্যাদা, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের মোহ তাঁকে কোনো সময় গ্রাস করতে পারে নি।

তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিরহঙ্কার ও প্রচারবিমুখ একজন আলেমে রব্বানী। অনেকবার দেখেছি, তাঁর নীতি ও রুচিবিরুদ্ধ হওয়ায় অনেক মেহমানের হাদিয়া আপ্রাণ জোর করা সত্ত্বেও গ্রহণ করেন নি। তিনি ছিলেন অমুখাপেক্ষিতার অনন্য দৃষ্টান্ত। আমি তাঁর এ গুণ তাঁর জীবদ্দশাতেও আমার অনেক প্রিয়জন ও বন্ধুদেরকে বলেছিলাম।

ইলমী নিমগ্নতা

হযরত মুফতিয়ে আযম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ)-এর আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ইলমী ব্যস্ততা ও নিমগ্নতা। শারিরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে ব্যয়িত সময় ছাড়া অন্য সময়গুলো তিনি কিতাব অধ্যয়ন, পুস্তকাদি রচনা এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও ফাতওয়া লিখনে ব্যয় করতেন।

সময়কে তিনি খুবই মূল্যায়ন ও হেফাজত করতেন। সময় অপচয় করা তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না। কেউ কোনো মাসআলা জানার জন্য বা অন্য কোনো প্রয়োজনে তাঁর কাছে আসলে প্রয়োজন শেষে তিনি বলে দিতেন, প্রয়োজন তো শেষ, এখন যান। কেউ সাক্ষাতের জন্য আসলে সালাম-মুসাফাহার পর বলে দিতেন, মুলাকাত তো হয়ে গেছে, ঠিক আছে, এখন যান। অপ্রয়োজনে তাঁর কাছে বসে সময় নষ্ট করা তিনি পছন্দ করতেন না।

তিনি এমন গভীর মনোযোগ সহকারে কিতাব অধ্যয়ন করতেন যে, আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে, কে আসছে কে যাচ্ছে- কিছুই খবর থাকত না। অনেক সময় নামাযের নির্দিষ্ট সময় যে চলে যাচ্ছে এ কথাও স্মরণ থাকত না। খাদেমরা বলে দিলে ‘হুজুর নামাযের সময় চলে যাচ্ছে’ তখন স্মরণ পড়ত। বার্ধক্য ও অসুস্থাবস্থায়ও এই ইলমী নিমগ্নতা দেখে সত্যিই আমি বিস্মিত ও অনুপ্রাণিত হতাম।

ইস্তিফাদার খোলা দরজা

মুফতিয়ে আযম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ) ছিলেন ইস্তিফাদার খোলা দরজা। যে কেউ কোনো ধরনের বাধা-প্রতিকূলতা ছাড়া হযরতের কাছ থেকে সরাসরি ইস্তিফাদা করতে পারতেন। প্রতিদিন ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, ধনী, গরিব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, সাধারণ, অসাধারণ অসংখ্য মানুষ হযরতের কাছে ইস্তিফাদা, বিভিন্ন মাসআলার সমাধান, বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা নেওয়ার জন্য উপস্থিত হতেন।

হযরত খোলা মনে, প্রফুল্লচিত্তে তাদের প্রয়োজনাদি পুরা করতেন। অনেক সময় নিচের জামাতের ছোট ছোট ছাত্রদেরকেও বিভিন্ন মাসআলার সমাধানের জন্য হযরতের কাছে আসতে দেখতাম। হযরত কোনো ধরনের বিরক্তিবোধ করতেন না। অনেকেই কিতাব নিয়ে এসেও বিভিন্ন ইবারত বুঝে নিতেন। দারুল উলূম হাটহাজারীতে ছাত্রদের মাঝে এ কথা প্রসিদ্ধ ছিল যে, কোনো বাধা-প্রতিকূলতা ছাড়া অনায়াসে সরাসরি সাক্ষাত করে ইস্তিফাদা করা যায় এমন উস্তাদদের মধ্যে অন্যতম হলেন মুফতিয়ে আযম মুফতী আব্দুস সালাম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ)।

গোনাহমুক্ত মহাপুরুষ

একমাত্র আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সলাতু ওয়াস সালাম-ই হলেন গোনাহমুক্ত। অন্যরা গোনাহমুক্ত হতে পারে না; এটাই স্বতঃসিদ্ধ ফয়সালা। তবে আমি মুফতিয়ে আযম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ) থেকে কোনো দিন কোনো গোনাহ হতে দেখি নি। সাধারণত মাদরাসায় অবস্থানরতদের যে সমস্ত গোনাহ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তা হল পরনিন্দা, প্রতিহিংসা ও শত্রুতা।

হযরতকে কোনোদিন কারো পরনিন্দা করতে দেখি নি এবং হযরতের সামনে কেউ কারো পরনিন্দা করবে- এটা হযরত মোটেও পছন্দ করতেন না। কারো প্রতি হিংসা বা শত্রুতার বশবর্তী হয়ে কোনো কথা বলেছে বা কোনো কাজ করেছে বলেও আমার জানা নেই। বর্তমান যে আরেকটি গোনাহ মহামারির আকার ধারণ করেছে, তা হল নযরের গোনাহ। যারা এন্ড্রয়েড সেলফোন এবং ফেসবুক বা ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে, তাদের নযরের গোনাহ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। হযরত এন্ড্রয়েড সেলফোন ব্যবহার করতেন না বিধায় এ গোনাহ থেকেও হযরত মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন ছিলেন। এজন্যই বললাম, গোনাহমুক্ত মহাপুরুষ। এ ছাড়াও তিনি যে কোনো ধরনের সন্দেহ ও সংশয়যুক্ত বিষয় এড়িয়ে চলতেন। তিনি ছিলেন তাকওয়া-পরহেজগারীর অনন্য উচ্চতায় সমাসীন।

হযরত মুফতিয়ে আযম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ)-এর মাত্র কয়েকটি গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল। আল্লাহ তায়ালা আমাদের মাঝেও যেন এ গুণগুলো দান করেন। আমীন।

সর্বশেষ আলোচিত মাসআলা

৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈ. রোজ মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯ টার দিকে মুফতিয়ে আযম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ)-এর ছেলে মাওলানা মুফতী ইসহাক ভাই আমাকে ফোন করে হুজুর থেকে দু’টি মাসআলা জেনে নেওয়ার জন্য বলেন। মাসআলা দু’টি হল-

১. কেউ যদি ব্যাংক থেকে ইন্টারেস্ট (সুদ) হিসেবে প্রাপ্ত টাকা মাদরাসায় দান করে, তাহলে মাদরাসা কর্তৃৃপক্ষ এ টাকা কোন্ খাতে খরচ করবে?

২. যে হারাম টাকা সদাকা করা ওয়াজিব, তার মাসরফ (ব্যয়খাত) কি? অর্থাৎ, এ টাকার মাসরফ কি হুবহু যাকাতের মাসরফ? না কি এ টাকা তামলীক (গরিবলোককে মালিক বানানো) ছাড়া জনকল্যাণমূলক কাজ যথা : রাস্তা নির্মাণ, মাদরাসা নির্মাণ, টয়লেট নির্মাণ ইত্যাদিতে ব্যয় করা যাবে?

আমি হুজুরের সাথে মাসআলাদু’টি আলোচনা করি। প্রথম মাসআলার সমাধানে হুজুর বলেন, টাকা নেওয়ার সময় জেনেশোনে নেওয়া উচিত। আর এ টাকা সদাকা ফান্ডে খরচ করবে।

দ্বিতীয় মাসআলার সমাধানে হুজুর বলেন, এ ধরনের টাকা তামলীক ছাড়া জনকল্যাণমূলক কাজে খরচ করা যাবে না।

এখানে আমি হুজুরকে প্রশ্ন করে বললাম, আশরফ আলী থানভী (রহ.) তো বলেছেন যে, এ ধরনের টাকা তামলীক ছাড়া জনকল্যাণমূলক কাজে লাগানো জায়েয। তখন হুজুর বললেন, এটা কী করে হয়? ফিক্হের কিতাবে তো আছে, وجب عليه التصدق।

এদিন হুজুর নাজিরহাট মাদরাসার মাজলিসে শুরা থেকে আসার পর থেকেই দুর্বল ও ক্লান্ত ছিলেন বিধায় আমি আলোচনা আর দীর্ঘ করলাম না।

এই মাসআলাদ্বয় ছিল হুজুরের জীবনের আলোচিত সর্বশেষ মাসআলা। এরপর আর কোনো মাসআলা হুজুর আলোচনা করতে পারেন নি।

হুজুর আজীবন যে সুদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন; কলম ধরেছেন, সে ‘সুদ’ বিষয়ক মাসআলাই ছিল হুজুরের জীবনের সর্বশেষ আলোচিত মাসআলা।

আলোকিত প্রস্থান

৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈ. রোজ মঙ্গলবার রাত ১০ টার দিকে মুফতিয়ে আযম চাটগামী (রহিমাহুল্লাহ) খসড়া একটি ইস্তিফানামা লিখেন। অতঃপর হুজুরের ছেলে মাওলানা মুফতী ইসমাঈল ভাইকে ডেকে ইস্তিফানামাটি পরিষ্কার করে ল্যাটার প্যাডে লিখতে বলেন।

মুফতী ইসমাঈল ভাইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী ইস্তিফানামাটি লেখা শেষ হলে তার ১২ টি ফটোকপি আনতে বলেন। নির্দেশমতে তা করা হয় এবং ১২ টিকে ১২ টি খামযুক্ত করা হয়। সম্ভবত মাজলিসে শূরার প্রত্যেক সদস্যকে একটি করে দেওয়ার জন্য ১২ টি ফটোকপি করতে বলেছেন।

ইস্তিফানামাটির সারমর্ম হল- “আপনারা আমাকে ইদারী অর্থাৎ মাদরাসা পরিচালনার যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা আমি যথাযথ পালন করতে পারছি না। আমার বয়সও বেশি হয়েছে এবং আমি অসুস্থও। এ দায়িত্ব পালন করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। আপনারা আমার থেকে এ দায়িত্ব নিয়ে নেন। আর আগামীকালের মাজলিসে শূরায় আমাকে পরিচালনার কোনো দায়িত্ব দিবেন না। দারুল ইফতার যে দায়িত্বটা আছে তা রাখবেন, এটা আমি করে যাব ইন শা আল্লাহ। পরিচালনার কোনো দায়িত্ব যদি চাপিয়ে দেন, তাহলে আমি মাদরাসা ছেড়ে বাড়িতে চলে যাব।”

জানাযাপূর্ব-আলোচনায় মাজলিসে শূরার অন্যতম মেম্বার মাওলানা নূরুল ইসলাম জিহাদী সাহেব হাফিযাহুল্লাহ ইস্তিফানামার এই শেষোক্ত কথাটি উল্লেখ করে বেদনার্ত সুরে বলেছিলেন, “আসলেই আমরা তাঁকে পরিচালনার দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই তিনি তাঁর আসল বাড়িতে চলে গেলেন।”

প্রতিদিনের ন্যায় আজও শেষ রাত্রে উঠে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করেন। তারপর যিকির করেন। আজকের যিকিরের ধ্বনি অন্যদিনের তুলনায় একটু উঁচু ছিল। ফজরের নামাযের সময় হলে জামাতের সহিত নামায আদায় করেন। নামায শেষে পকেট থেকে ইস্তিফানামার একটি খাম বের করে হুজুরের খাদেম মুহাম্মদ হুমায়ূন ভাইকে দিয়ে বলেন, এটি মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেবকে দিয়ে আস। অতঃপর দৈনিক রুটিন অনুযায়ী নিজ-মাখসূস কামরায় দুআ-অযীফায় মশগুল হয়ে যান।

এদিকে নাস্তা তৈরির কাজ শেষ হলে সাড়ে ৭ টায় নাস্তা করেন। নাস্তা শেষ করে ইস্তিফানামাটি ঠিকমতো পৌঁছিয়েছে কি না- তা হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করেন। এটি ছিল হুজুরের জীবনের শেষকথা। তারপর দৈনিক রুটিন অনুযায়ী নিজ-মাখসূস কামরায় ঘুমিয়ে পড়েন। এই ঘুম না ভাঙা ঘুম, না জাগা ঘুম, চিরশান্তির ঘুম, চিরবিদায় ও বেদনার ঘুম। আহ! কী নিদারুণ প্রস্থান! স্বপ্নের মতো প্রস্থান। আলোকিত প্রস্থান।

পরিশেষে মহান আল্লাহর নিকট হৃদয়ের একান্ত মিনতি জানায়, তিনি যেন আমাদের পরমপ্রিয় ও পরমশ্রদ্ধেয় উস্তাদ ও রাহনুমা মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ, মুফতী মুহাম্মদ আব্দুস সালাম (রহিমাহুল্লাহ)-কে পূর্ণ মাগফিরাত করেন, আপন রহমতের চাদরে ঢেকে নেন, তাঁর জীবনের যাবতীয় খিদমত উত্তম কবূলিয়তে ভূষিত করেন, তাঁকে জান্নাতের অতি উচ্চ মাকাম দান করেন এবং আমাদেরকে আমৃত্যু তাঁর দেখানো হকের পথে চলবার তাওফীক দান করেন। আমীন।

– মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত রাফি, তালিবুল ইলম, ইফতা সমাপনী বর্ষ ১৪৪২-৪৩ হিজরী, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।