Home ইতিহাস ও জীবনী মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা শামসুদ্দীন ক্বাসেমী (রাহ): দ্বীনের এক অতন্দ্র প্রহরীর নাম

মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা শামসুদ্দীন ক্বাসেমী (রাহ): দ্বীনের এক অতন্দ্র প্রহরীর নাম

মাওলানা শামছুদ্দীন কাছেমী (রাহ.)।

।। মুফতী খন্দকার হারুনুর রশীদ ।।

হক্ব-বাতিলের যুদ্ধক্ষেত্র এ পৃথিবী। আবহমান কাল থেকে চলে আসছে উভয়ের সংঘাত। চলতে থাকবে কিয়ামত অবধি। তবে হক্ব সতত অপরাজেয়, চিরবিজয়ী। সংঘাতে সংঘাতে নবউদ্দীপনায় জেগে ওঠা হক্বের স্বভাব। বাতিল যখনই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছে, হক্বপন্থী মহাপুরুষদের পদাঘাত খেয়ে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- হক্ব সমাগত, বাতিল তাগুতি শক্তি বিতাড়িত। বাতিল অপশক্তির পতন অবশ্যম্ভাবী।

হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন- আল্লাহ পাক প্রতি শতাব্দির অগ্রভাগে তার উম্মতের মাঝে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের উদ্ভব ঘটাবেন যারা তার দ্বীনের তাজদীদ বা সংস্কার করবেন। এ ধারাবাহিকতায় সময় সময় গজিয়ে ওঠা নানা বাতিল অপশক্তির বিরুদ্ধে যে ক’জন বাঙালি অকুতোভয় মুজাহিদ জীবনের শেষ সময়টুকু পর্যন্ত লেখনি, বক্তৃতা, বিবৃতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল-সমাবেশসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে লড়ে গেছেন, আল্লামা শামসুদ্দীন কাসেমী (রাহ.) তাদের অন্যতম।

জন্ম ও বংশপরিচিতি: আল্লামা কাসেমী (রাহ.)চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বিপ থানাধীন নেয়ামস্তি এলাকায় একটি শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে ১৯৩৫ খৃষ্টাব্দের ৫ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওঃ মুহাম্মদ মুদ্দাস্সের, পিতামহের নাম আহমদ সারেং। তিনি মরহুম আলী মুন্সি সাহেবের বংশধর। জনাব আলী মুন্সি তদানীন্তন সময়ে সুপ্রচলিত ফার্সি ভাষায় সুদক্ষ ও একজন বিশিষ্ট আইনবিদ ছিলেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে বেজে ওঠা আন্দোলনে তার পূর্বপুরুষদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ও সোনালি অবদান ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

শিক্ষাজীবন: স্বীয় পরিবারই ছিলো আল্লামা কাসেমী (রাহ.)এর প্রাথমিক পাঠশালা। এ থেকেই তার শিক্ষা জীবনের শুরু। সাথে সাথে গ্রামের মক্তবেও ছিলো তার নিয়মিত যাতায়াত। অতঃপর তিনি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

তিনি ছিলেন প্রখর ধীশক্তির অধিকারী। তার প্রতি ছিলো বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকদের সতর্ক দৃষ্টি। বিজ্ঞ শিক্ষকবৃন্দ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, একদিন আজকের কিশোর ছেলে শাসসুদ্দীনই জাতির মুখে হাঁসি ফোটাতে সক্ষম হবে। তাই তারা চাইতেন তিনি যেনো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেন। কিন্তু তার বুদ্ধিমান পিতার মনোভাব ছিলো সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি চাইতেন তার ছেলে প্রচলিত ও ইসলামী শিক্ষার সমম্বয়ে জ্ঞানার্জন করতঃ নিজেকে একজন সচেতন দেশপ্রেমিক এবং একজন পূর্ণাঙ্গ ও দুঃসাহসী দ্বীনের খাদেমরূপে গড়ে তুলুক। এ জন্য তিনি পুত্রকে ভর্তি করেন স্থানীয় রিয়াজুল উলূম মাদ্রাসায়।

এখানে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে পড়া লেখা করে আরবী গ্রামার ও নাহু সরফের ওপর গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। অতঃপর তিনি সন্দ্বিপ হরিশপুর সিনিয়র মাদ্রাসা হতে দাখিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী সময়ে ঐ মাদ্রাসা হতে প্রথম বিভাগে আলেম ও ফাজেল পাশ করেন। ১৯৫৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী মহাবিদ্যাপীঠ ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ চলে যান। সেখানে ভর্তি হয়ে ১৯৫৫-৫৭ এ দু’বছর পর্যন্ত ফেক্বাহ, মানতেক, প্রভৃতি শাস্ত্রের ওপর ভূৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৭ সালে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সুস্থ হবার পর নানা প্রতিকুলতার কারণে পুনর্বার দেওবন্দে যাওয়া সম্ভবপর না হওয়ায় চট্টগ্রাম জিরি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে মনোযোগসহকারে অধ্যয়ন শুরু করেন।

অতঃপর উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯৫৮ সালে তিনি লাহোর গমন করেন। তদানীন্তন সময়ে লাহোরের অন্যতম ইসলামী শিক্ষাগার জামেয়া আশরাফিয়ায় ভর্তি হন। এখানে হাদীস, তাফসীর প্রভৃতি শাস্ত্রে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করেন। এছাড়া তিনি শাইখুত্ তাফসীর আল্লামা আহমদ আলী লাহোরী (রহ.)এর দারসে তাফসীরে অংশগ্রহণ করে ১৯৬০-৬১ পর্যন্ত বিশেষ প্রশিক্ষণ অর্জন করেন।

অধ্যাপনা ও মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা: ১৯৬১ সালে মোমেনশাহী জেলার ঐতিহ্যবাহী সোহাগি মাদ্রাসা হতে আল্লামা কাসেমী (রাহ.)এর অধ্যাপনা জীবনের শুরু। এখানে তিনি এক বছর যাবৎ অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষকতা করেন। অতঃপর চলে আসেন জামেয়া আশরাফুল উলূম বড়কাটরা মাদ্রাসায়। এখানে তিনি শীর্ষতম মুহাদ্দিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

দু’বছর এখানে হাদীস, তাফসীর ইত্যাদি দারস দানের পর ফরিদাবাদ ইমদাদুল উলূম মাদ্রাসায় চলে যান। এখানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে দীর্ঘ সাত বছর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ঢাকার রাজফুলবাড়িয়ায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সাথে সাথে মাদ্রাসার মুহতামিম হিসেবেও দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে থাকেন। কিছুদিন দায়িত্ব পালন করার পর তিনি অব্যাহতি গ্রহণ করেন।

এদিকে ১৯৬৮ সালে যাত্রাবাড়ী জামেয়া মাদানিয়া প্রতিষ্ঠিত হলে পরবর্তীতে তিনি এখানে মুহাদ্দিস হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে এক বছর যাবৎ অত্যন্ত সুচারুরূপে অবৈনতিক দায়িত্ব পালন করেন।

অতঃপর ১৯৭০ সালে আল্লামা কাসেমী (রহ.)এর পৃষ্ঠপোষকতায় “জামেয়া হুসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদ্রাসা” প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনী মাদ্রাসাটিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভষ্মিভূত করে দিলে হযরত কাসেমী (রাহ.) গ্রামের বাড়ি সন্দ্বিপে চলে যান। সেখানে শোকলবহর এলাকায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

এখানে তিনি কয়েক বছর যাবত এ মাদ্রাসার মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। এ সময় তিনি দামপাড়া বাইতুল আজিজ জামে মসজিদ-এর ইমাম ও খতীব হিসেবেও দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।

১৯৭৫ সালে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের পরামর্শে তিনি পুনরায় ঢাকা চলে আসেন এবং জামেয়া হুসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ এর প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালে তিনি মুহতামিমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন থেকে আল্লামা কাসেমী (রহ.) নিভৃত পল্লীর জীর্ণ-শীর্ণ এ মাদ্রাসাটিকে স্বপ্নীল স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনা চালিয়ে যান। তাঁরই সীমাহীন ত্যাগ, তিতিক্ষা ও দিন-রাতের মেহনতে হাটি হাটি পা পা করে আজ সেদিনকার কচি মাদ্রাসাটি কৃতিত্বের সাথে একটি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান দখল নিয়েছে।

এ মহান ব্যক্তিত্ব ১৯ অক্টোবর ১৯৯৬ ইংরেজিতে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহপাক মাওলানা শামছুদ্দীন কাছেমী (রাহ.)কে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করুন। আমীন।