Home ইসলাম ইসলামের সার্বজনীন শান্তি, মুসলমানদের হতাশাজনক পরিস্থিতি এবং উত্তরণের উপায় (২)

ইসলামের সার্বজনীন শান্তি, মুসলমানদের হতাশাজনক পরিস্থিতি এবং উত্তরণের উপায় (২)

।। মুনির আহমদ ।।

[প্রথম কিস্তির পর]

ইসলামের বিধি-বিধান ও নীতিমালাকে পুরাতন ও সেকেলে ধরনের আখ্যায়িত করে মুসলিম সমাজের অন্য একদল একে আধুনিক এবং তাদের মতে যুগোপযোগী করার মানসে বলে থাকেন যে, আমরা ইসলাম নামক বৃক্ষের আগাছা ও জঞ্জাল পরিষ্কার করতঃ এর নিখুঁত ছবি উদ্ধার করবো। এরই তলায় বিশ্রাম নিব, এরই ছায়ায় শান্তি লাভ করবো এবং এরই অমৃত ফল নিজে ভোগ করবো এবং অপরকেও করাবো।

কথিত এহেন আধুনিক মনোভাবাপন্ন ইসলামপন্থীদের জানা উচিত যে, ইসলাম নামী এই পুরাতন বৃক্ষটিকে জঞ্জাল মুক্ত ও মন গড়াভাবে সুন্দর করতে গিয়ে যেন এর শাখা প্রশাখা ও ডাল পালা কেটে না ফেলা হয় কিংবা নতুনত্বের মোহে যেন এক গাছের ডালে অন্য গাছের পাতা জড়িয়ে তরুর মহাত্ম্য নষ্ট না করা হয়; তৎপ্রতি সাবধান ও সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে প্রতি মুহূর্তে ও প্রতিটি পদক্ষেপে। অন্যথায় বৃক্ষের যেমন সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্য বিনষ্ট হবে, তেমনি ব্যর্থ হবে ফলের আশা, পন্ড হবে সকল শ্রম এবং এতে করে ক্রমাম্বয়ে ধ্বংস ও উজাড় হবে সুমিষ্ট ফলের বাগান।

ধর্ম বিমুখ সমাজ ও ইসলাম থেকে উদাসীনতার বাহ্যিক রূপই সমাজে জন্ম দিয়েছে আজ বিশ্বাসঘাতকা, অসাধুতা, চুরি, ডাকাতি, অনাচার-অবিচার, হাইজ্যাক-ব্যভিচার, ধোঁকাবাজী, মিথ্যাচার, বিভেদ, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, রাহাজানী, নৃশংসতা, অস্থিরতা, অত্যাচার, উৎপীড়ন, প্রহসন, সীমালংঘন, অপরের অধিকার হরণ, অন্যায়ের প্রশ্রয় ও সমর্থন, অপ্রীতিকর ঘটনা, মাতাল রূপে উন্মাদনা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, জালিয়াতী, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, অপহরণ, লুটপাট, মাস্তানী, চোরাচালানী, জাতীয় সম্পদের অপচয়, পাচার ও কালোবাজারী, উৎকোচ, ছিনতাই, কপটতা, কূটিলতা, নৈরাজ্য বিস্তার, অরাজকতা, নগ্নতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অসাম্য-বৈষম্য, যোগসাজস, দলাদলী, অনৈক্য-অসমতা। এ ধরনের অন্যায়, অনৈতিকতা ও ইনসাফহীনতা এবং মানবতার অপমৃত্যুতে আজ মানব সমাজ দিশেহারা।

এমতাবস্থায়ও কি কেউ প্রকৃত সত্যের মশাল তথা ইসলামের আলোক বর্তিকা নিয়ে পথহারা জাতিকে আলোর পথ দেখাবে না? মানব সমাজ কি এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে? না-না কষ্মীন কালেও হতে পারে না। সূক্ষ দৃষ্টিতে দেখা যায় যে, মানব সমাজে প্রকৃত জ্ঞানীদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণাই মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার, উন্নতি ও অগ্রগতি কিভাবে হতে পারে। তাই তারা এই আত্মভোলা জাতিকে একান্ত তাকীদ সহকারে জোরালো আহ্বানের মাধ্যমে বলেছেন- হে পতন্মুখ জাতি! তোমার অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের দর্পণে দেখো বর্তমান চেহারা, মুছে নাও সকল কলংক কালিমার গ্লানি ও কুৎসিত দাগ। এঁকে নাও জাতীয় জীবনের নিখুঁত ছবি; পেশ করো দুনিয়ার সামনে আপন পূত পবিত্র চরিত্র ও সুমহান মানবতার আদর্শ। জেনে নাও জাতি গঠনে ও জাতীয় উন্নতির সাধনার পথে এবং জাতীয় জীবনের কল্যাণময়ী বিপ্লবের পথে ইতিহাসের মান অসাধারণ ও অসামান্য।

“ইসলামের সার্বজনীন শান্তি, মুসলমানদের হতাশাজনক পরিস্থিতি এবং উত্তরণের উপায়” -প্রথম কিস্তি পড়তে এই লেখার উপর ক্লিক করুন

হে পথভোলা মুসলমান! স্মরণ কর, তুমি তোমার পূর্ব পুরুষদেরকে, তারা কোন্ নীতি বিধান গ্রহণ ও বরণ করেছিল- যা শতধা বিভক্ত জাতির শতাব্দী সঞ্চিত হিংসা বিদ্বেষকে শুধু দূরই করেনি বরং প্রকৃত মানবতার দ্বারা পরস্পরের মধ্যে প্রীতি-ভালোবাসা, অকৃত্রিম দয়া-দরদ এবং একাত্মবোধ প্রতিষ্ঠিত করেছিল সকল মানুষের অন্তরে-বাহিরে। দুর্বল নিরীহ ও পতিত জনের উদ্ধার, অসহায়ের সহায় এবং পরকে আপন করে যেমনি ভাবে দুনিয়ার বুকে শ্রদ্ধার আসন প্রতিষ্ঠিত করেছিল। যার প্রভাবে সকল কুফরী ও ধর্মহীন শক্তি কাঁপছিল ভয়ে থর থর করে, তুমি কি তা ভুলে গেলে?

অতএব, সঠিক চিন্তা-চেতনায় ব্রতী হও এবং উপলব্ধি কর জাতীয় উন্নতির সাধনার পথে, জাতীয় জীবনে কল্যাণমুখী বিপ্লব আনয়নে, জাতীয় জীবনের গোড়াপত্তনের ইতিহাস আলোচনা করার, অতীতের গৌরবময় ঐতিহ্যময় সোনালী অধ্যায়ের কার্য্য কারণ বিচার করে দেখার এবং সেই নিখুঁত নিষ্কলঙ্ক দর্পণে আজকের সামাজিক চেহারা পর্যবেক্ষণ করার একান্ত প্রয়োজন। বলতে গেলে অতীতের মূলধনই কি ভবিষ্যতের যাত্রাপথে বর্তমান পাথেয় নয়?

তাই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উন্নতির এই ক্রান্তি লগ্নে নেহায়েত আফসুস সহকারে বলতে হচ্ছে, হে বিশ্ব বিজয়ী মুসলমান! আজকের এই উন্নতি প্রগতির যুগে নিখুঁত ও নির্ভেজাল মন-মস্তিষ্ক নিয়ে জাতীয় দুর্যোগের এই জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হই এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার পাশবিক ক্রিয়াকর্ম পরিহার করে, পাশ্চাত্য চিন্তাধারার রঙিন চশমা বর্জন করতঃ আমাদের জাতীয় জীবনের মূল ভিত্তি আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যমন্ডিত মানবতাভিত্তিক আদর্শের প্রতি স্বাধীন সুস্থ্য বিবেকের সন্ধানি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেখি, সমাজের সকল স্তরে আমাদের জাতীয় উন্নতির পট ভূমিকা রচিত হয়েছে যে আদর্শ, যে শিক্ষা এবং যে সভ্যতা অবলম্বন করে; সেই শিক্ষা প্রদীপ্ত, সেই সভ্যতা প্রভাবিত দৃষ্টি ভাঙ্গতে আমাদের বর্তমান পরিপার্শ্বিক হাল তুলনামূলক যাচাই করি। আর এরই আলোকে আমাদেরই নিজস্ব ও স্বতন্ত্র কর্মকান্ডের মাধ্যমে তালাশ করি উন্নতির পরশ মানিক।

পরন্ত এ পথে আমাদেরকে পূর্ণ উদ্যোগে চালিয়ে যেতে হবে সকল প্রচেষ্টা, যাতে লাভ করতে পারি বাস্তব উন্নতি ও পরিপূর্ণ সফলতা। বস্তুতঃ এর পেছনে ধর্মগত ও আত্মিক মূল্যবোধকে যথোচিত স্থান দিলেই মানব সমাজের সকল ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়ার ফলে ফুটে উঠবে ভারসাম্যপূর্ণ উন্নতি ও অগ্রগতি। কেননা যিন্দেগীর সকল স্তরে মানুষের পক্ষে ধর্ম ও ধর্মীয় নীতি বিধান শুধু অত্যাবশ্যাকীয় নয় অপরিহার্যও বটে।

একারণেই সত্য ধর্মের স্পর্শ লাভে সামাজিকভাবে মানুষের মন স্বাভাবিক উদার হয়ে আসে। আর তখনি জাতি-ধর্ম বর্ণ-বৈষম্যের বাধার দেয়াল চূর্ণকরে মানুষের মধ্যে এই অনুভূতি জাগে যে, স্র্রষ্টার সৃষ্টি সকল মানুষই মানবতার দৃষ্টিতে সমান। বিশেষতঃ এই অনুভূতির নামই আধ্যাত্মিক দৃষ্টি। আর এই মহৎ দৃষ্টির সঙ্গেই মানুষের প্রকৃত সুখ ও শান্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ এর অর্থ এই নয় যে, ইসলামে বৈষয়িক উন্নতিকে বর্জন করার নির্দেশ রয়েছে। বরং মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, কৃষ্টি সভ্যতামূলক জীবন, রাজনৈতিক জীবন এবং আন্তর্জাতিক জীবন-এর বাস্তবরূপরেখা দুনিয়াবাসীকে একমাত্র ইসলামই দিয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

এরই স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ইংরেজ ঐতিহাসিক জর্জ স্যাটন স্বীয় রচিত গ্রন্থ nteroduction to the history of science নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন- মানুষের সামাজিক উন্নতি প্রগতি এবং বিশ্ব সভ্যতায় ইসলামের অবদান যে চির স্বীকৃত, এর বাস্তব প্রমাণই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও আদর্শবান চরিত্রবান ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হযরত ওমর ফারুক (রাযি.) ও আমীরে মুয়াবিয়া (রাযি.), সর্বশ্রেষ্ঠ ভূগোল ও শাস্ত্রবিদ আবু মাসুনী, সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক তাবারী, সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ইবনে খালদুন, সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক ইবনে রুশদ, সর্বশ্রেষ্ঠ অঙ্ক শাস্ত্রবিদ আবু কামিল মুহাম্মদ ইব্রাহীম, সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যকরণবিদ হযরত আলী (রাযি.), সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি মহাবীর খালিদ, রসায়ন শাস্ত্রের আদিপিতা হযরত আবু মূসা আশ্য়ারী (রাযি.) এবং বৈষয়িক জ্ঞানে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হযরত উসমান গণি (রাযি.)।

অতএব, দ্বিধাহীন চিত্তে একথা জানতে ও মানতে হবে যে, একমাত্র ইসলামই মানুষের জীবনে মানবতার স্বার্থকরূপ পরিষ্ফুট করে তোলার পাথেয় সংগ্রহ করে। তাই ইসলামের অমর নিয়ম-নীতি সম্বলিত বিষয়বস্তু সত্যিকার আদর্শ ভিত্তিক। যার উৎস মানবতার কল্যাণ ও উৎকর্ষ সাধনের নিমিত্তে করুণাময় আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রেরিত প্রদত্ত বিধি-বিধান ও নিয়ন্ত্রিত গতি পথের নামই ধর্ম তথা ইসলাম। আর এই খোদায়ী বিধান ও কানুনকে মানুষের নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে রূপান্তরিত করে তার নিয়ন্ত্রিত ও নির্দেশিত পথে নিজেকে পরিচালিত করে অপরাপর জনসাধারণকে তা গ্রহণ ও পালন করতে এবং এ পথে চলতে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে এবং এজন্যে যত দুঃখ-কষ্ট ও বাঁধা বিপত্তি আসে, নিতান্ত ধৈর্য্য-সহ্য সহকারে তা বরদাশ্ত করে নেয়া হবে প্রকৃত মুসলমানের কর্তব্য ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ।

তাই মুসলিম সমাজের বর্তমান হাল অবস্থা দৃষ্টে নিরাশ না হয়ে ইসলামের সার্বজনীন উন্নতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সমাজের খোদা ভীরু সকল জ্ঞানী-গুণীদেরকে হিমালয় সদৃশ শক্ত একতার বন্ধনে কর্মমুখর হতে হবে। ইনশাআল্লাহ, এর ফলে মানুষের মধ্যে মানবতার জ্ঞান ফিরে আসবে এবং প্রকৃত ইনসাফ, সুবিচার ও মানুষে মানুষে দয়া-মায়া প্রতিষ্ঠিত হয়ে দুনিয়া এক শান্তি নিকেতনে পরিণত হবে। [সমাপ্ত]

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ইসলামের সার্বজনীন শান্তি, মুসলমানদের হতাশাজনক পরিস্থিতি এবং উত্তরণের উপায় (১)