Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন পবিত্র কুরআনের মাসহাফে উসমানিয়া এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা

পবিত্র কুরআনের মাসহাফে উসমানিয়া এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা

।। আল্লামা মুহাম্মদ ওমর কাসেমী ।।

পবিত্র কুরআন মজীদ আল্লাহর নিকটে লাওহে মাহফুজে এক নির্দিষ্ট নিয়মে সাজানো রয়েছে। সেখান থেকে সুদীর্ঘ তেইশ বৎসরে আবশ্যক ও প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। যখনই যে আয়াত বা আয়াতসমূহ নাযিল হয়েছে। তখনই হযরত জিব্রাইল (আ.) তা লাওহে মাহফুজের তারতীব (ক্রমে) অনুসারে কোন সুরায় কোন আয়াতের পরে বা আগে স্থান পাবে তা স্পষ্টভাবে বলে দিতেন এবং তদনুসারে হযরত (সা.) সাথে সাথে মুখস্থ করে নিতেন এবং কাতেবে ওহীকে লেখার নির্দেশ দিতেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং ছাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) এদের কাছে কুরআন সংরক্ষণের বিষয়টা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। একে সংরক্ষণের ব্যাপারে সর্বক্ষণিক সক্রিয় ও সজাগ থাকতেন। ত্রুটি বিচ্যুতি না হওয়ার জন্যে সর্বাত্মক আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাতেন এবং এর জন্যে সম্ভাব্য সর্বপ্রকার কৌশল ও পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। কাতেবীনে ওহী অর্থাৎ, ওহীর লেখকগণই শুধু কুরআন লিখে রাখতেন এমন নয়; বরং অন্যান্য সাহাবাগণও সম্ভব আর স্বামর্থ অনুযায়ী হাড়, পাথর, চামড়া ও খেজুরডালা ইত্যাদির উপর লিখে রাখতেন। এতদ্ব্যতীত হযরত জিবরাইল (আঃ) যখন কোন আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হতেন তখন তা পাঠ করার সময় রাসুল (সা.) দ্বি-বিধ চিন্তায় জড়িত হয়ে পড়তেন-

(এক) কোথাও এর শ্রবণ ও তদনুযায়ী পাঠে কোন পার্থক্য না হয়ে যায় ।
(দুই) কোথাও এর কোন অংশ, কোন বাক্য স্মৃতি থেকে উধাও না হয়ে যায়। এই চিন্তার কারণে জিবরাইল (আ.) যখন কোন আয়াত শুনাতেন তখন রাসুল (সা.) সাথে সাথে পাঠ করে নিতেন এবং জিহবা নেড়ে নেড়ে এত দ্রুত আবৃত্তি করতেন যা হুজুরের জন্যে কষ্টকর হয়ে যেত।

আল্লাহ তাআলা নবী (সা.)কে এত পরিশ্রম না করার জন্যে শেষপর্যন্ত আয়াত নাজিল করেন। “তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্যে আপনি দ্রুত ওহী আবৃত্তি করবেন না। এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমারই দায়িত্ব।” (সূরা কিয়ামাহ)।

তেমনি নবী (সা.) একে সর্বদা নামাজে পড়তেন এবং প্রত্যেক রমযানের পূর্বে অবতীর্ণ সম্যক কুরআন হযরত জিবরাইল (আঃ) কে শুনাতেন। বর্ণিত আছে, হুজুরের বিদায়ী রমযানে জিবরাইল (আঃ) এর কাছে দুই বার দাওর করেছিলেন। অনুরূপ সাহাবাগণ ও সর্বদা নামাজে পড়তেন, সর্বক্ষণ তেলাওয়াত করতেন। বহুসংখ্যক ছাহাবী এমনও ছিলেন যে যখন যেই আয়াত অবতীর্ণ হত তখন তা হিফজ করে নিতেন। তাইতো সাহাবায়ে কেরামদের বড় একটি দল পূর্ণ কুরআনের হাফেজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর যারা পূর্ণ কুরআন হিফজ করতে সক্ষম হননি। তারা আংশিক হলেও হিফজ করতেন।

কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর জীবদ্দশায় পূর্ণ কুরআন একত্রিতভাবে মাসহাফ বা গ্রন্থ আকারে ছিল না। যেহেতু হুজুরের অন্তর্ধানপূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত কুরআন অবতীর্ণ হচ্ছিল। তাই এ ধরণের গ্রন্থ আকারে রূপ দেওয়া বা একত্র করা সম্ভবপর হয়নি। তবে ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে অনেকে ঐ সময় পর্যন্ত নাজিলকৃত আয়াতসমূহ একস্থানে লিখে নিয়েছিলেন তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে।

আজ আমাদের দেশসহ সারাবিশ্বে যে প্রকারের গ্রন্থ আকারে কুরআন শরীফ বিদ্যমান তাকে মাসহাফে উসমানিয়া বলা হয়। এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হচ্ছে। আপনারা পূর্বে অবগত হয়েছেন যে, হুজুরের জীবদ্দশায় মাসহায় আকারে কুরআনের একত্রকরণ সম্ভব হয়নি।

এই মাসহাফের রূপ হুজুরের ওফাতের পরে হয়েছিল। নবী (সা.) এর অন্তর্ধানের পরে হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক (রাযি.) ইসলামের প্রথম খলীফা হিসেবে খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হন। তার খেলাফতের সূচনালগ্নেই অভিশপ্ত মিথ্যা নবী দাবীদার মুসাইলামাতুল জবের শায়েস্তার উদ্দেশ্যে এক বিরাট মুসলিম বাহিনী প্রেরণ করা হয় এবং শেষপর্যন্ত উভয়পক্ষই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয় এবং ইয়ামামা নামক স্থানে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাই এ যুদ্ধকে ‘ইয়ামামা যুদ্ধ’ নামে অবহিত করা হয়।

এ যুদ্ধে মুসলিমবাহিনী জয়া এবং মিথুাকবাহিনী নিহত এবং পরাজয় হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম বাহিনীর প্রচুর সংখ্যক মুসলিম সৈন্য যারা সবাই সাহাবী ছিলেন শহীদ হয়ে যান। এর মধ্যে সত্তর জন হাফেজে কুরআন সাহাবীও ছিলেন। এই সত্তর জন হাফেজের শহীদ হওয়ার ঘটনায় হযরত উমর (রাযি.) মারত্মক ভাবে মর্মাহত হন। তার হৃদয়ে প্রচন্ডভাবে আঘাত হানে। আগামী দিনে কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে চিন্তিত এবং শংকিত হয়ে পড়েন। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন কুরআন সংরক্ষণের বিষয়টি। কেননা এভাবে একের পর এক হাফেজে কুরআন দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলে ‘কুরআন সংরক্ষণ’ অসম্ভব হবে। তাই তিনি কালবিলম্ব না করে খলীফার সংগে হেফাজতে কুরআনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের বিষয়ে আলোচনা করলেন। খলীফাও এর গুরুত্ব অনুধাবন করলেন।

উক্ত বৈঠকেই পূর্ণ কুরআন মাস্হাফ বা গ্রন্থ আকারে একত্রিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই গৃহীত সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে নবী (সা.) এর প্রধান কাতেবে ওহী সাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রাযি.) কে দরবারে ডেকে পাঠান। হযরত আবু বকর এবং উমর (রাযি.) যায়েদকে এই বিষয়ে জ্ঞাত করান। অতঃপর পূর্ণ কুরআন একত্রকরণের উদ্দেশ্যে হযরত যায়েদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। যারা যেখানে যার কাছে যে আয়াত রয়েছে তা তারতীব অনুসারে একত্রিত করবে এবং এ কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে হযরত উমর (রাযি.) থাকেন।

পরিশেষে হযরত যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাযি.) দীর্ঘ অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নজনের কাছে গিয়ে তা সংগ্রহ করেন এবং সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় জিবরাইল (আ.) কর্তৃক নাযিলকৃত তারতীব অনুসারে জমা করতে সক্ষম হন। অতঃপর চূড়ান্ত করে খলীফার দরবারে পেশ করেন। খলীফা উক্ত মাসহাফ সানন্দে গ্রহণ করেন এবং হযরত যায়েদকে তার এই মহৎ পরিশ্রমের জন্যে অভিনন্দিত করেন। নিঃসন্দেহে মুসলিম জাতি হযরত যায়েদ (রাযি.) এর কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।

খলীফা হযরত আবু বকর (রাযি.) এর ইন্তিকাল পর্যন্ত উক্ত মাসহাফ তার কাছেই রক্ষিত ছিল। অতঃপর হযরত উমর (রাযি.) খেলাফতের মসনদে আসীন হলে উক্ত মাস্হাফ তার নিকটে হস্তান্তরিত হয়। এবং খলীফা উমরের শহীদ হওয়া পর্যন্ত তার কাছেই রক্ষিত থাকে। তিনি ইন্তেকাল মূহুর্তে উক্ত মাহাফকে স্বীয় কন্যা ও নবী (সা.)এর সহধর্মিনী হযরত হাফসা (রাযি.) এর কাছে অর্পন করে যান। পরবর্তী পর্যায়ে উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে হযরত উসমান গনী (রাযি.) ইসলামের তৃতীয় খলীফা হিসেবে মনোনীত হন। খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার কিছু কাল পরে তার সম্মুখে এমন কতিপয় মারত্মক সমস্যা উপস্থিত হয়। যার সমাধান ও প্রয়োজনীয়তার পদক্ষেপ হিসেবে পুনঃ কুরআন একত্রকরণ ও তার বিভিন্ন অনুলিপি তৈরী করতে বাধ্য হন। সেসব সমস্যাগুলো হচ্ছে-

(১) খলীফা লক্ষ্য করলেন যে, ইসলামী হুকুমতের সীমা এখন আর সল্প সীমিত এলাকা ভিত্তিক নয়; বরং ইসলামের সোনালী পতাকা উমরের সাহসিকতাপূর্ণ বীরত্বে পৃথিবীর বহুদূর-দূরান্তে পতপত করে উড়ছে। ইসলামের শাশ্বত শান্তির বাণী বিশ্বের দিকদিগন্তে পৌছে গেছে। সুদুর আফ্রিকা মহাদেশসহ তদানীন্তন বিশ্বে দুই পরাশক্তি রোম, পারস্য তথা অর্ধ পৃথিবী ইসলামী শাসনে শাসিত । ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিতে নিত্য হাজার হাজার অমুসলিম ইসলাম গ্রহণে ধন্য হচ্ছে। সমগ্রবিশ্বে এক ভিন্ন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এক আল্লাহর একত্ববাদের আজ যেন সারা পৃথিবীতে সাজ সাজ রব উঠেছে। সবার মুখে একত্ববাদের কালীমা আর এক আল্লাহর মনোনীত দ্বীনকে বুলন্দ করার এক দীপ্ত শপথ। আবেগে উজ্জীবিত বিশ্বময় মুসলিম। কিন্তু ইসলামী আহকাম, খোদার বিধান এবং পবিত্র কুরআন সম্পর্কে তারা ছিলেন একেবারেই অজ্ঞ। এমন কি কুরআন যে কি জিনিস তাও অনেকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি। অথচ পবিত্র কুরআনই হচ্ছে ইসলামের ও খোদায়ী বিধানের মূলল্লাস্থ। তাই হযরত উসমান (রাযি.) এই পবিত্র কুরআনকে তাদের কাছে পৌঁছানো নিতান্তই প্রয়োজন বোধ করলেন। যেন তারা এ কুরআন শিক্ষা ও নিয়মিত তেলাওয়াত করার সুযোগ পায়।

(২) তিনি আরো একটি মারাত্মক বিষয় লক্ষ্য করলেন, যে মক্কা-মদীনা তথ্য আরবের প্রায় প্রতিটি গোত্রই নিজেদের পড়ার জন্যে হযরত হাফসা (রাযি.) এর নিকট রক্ষিত মাস্হাফ থেকে অনুলিপি তৈরী করা আরম্ভ করতে লাগল। আবার অনুলিপি তৈরীকালে প্রতিটি গোত্রই স্ব-স্ব রীতি অনুসরণ করত। অর্থাৎ, আপন আপন গোত্রীয় শব্দ অনুযায়ী কুরআন পড়ত ও লিখত। যদিও এই গোত্রীয় রীতিতে কুরআন পড়ার। অনুমতি তাদেরকে নবী (সা.) এর যামানায় দেয়া হয়েছিল। যেমন একটি লম্বা হাদীসের অংশ এরূপ “বস্তুত এই কুরআন সাত রীতিতে নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং তোমাদের জন্যে যা সহজ তাই পড়বে”। (মিশকাত)।

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, সকল ভাষায় আঞ্চলিক রীতি অভিন্ন নয় বরং বিভিন্ন। যেমন আমরা বাংলা ভাষী। কিন্তু একই শব্দের আঞ্চলিক রীতি বিভিন্ন। একটি শব্দ অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন রূপে রূপান্তরিত হয়। যেমন আমরা বলি যাইব, যাব, যাইমু, যাইবাম, যাইতাম ইত্যাদি। তেমনি আর একটি শব্দ পুত্র, পুত, পোলা, পোয়া, হোলা ইত্যাদি। এক শব্দের অনেক রূপ ও রীতি। তেমনি আরবী ভাষার আঞ্চলিক রীতিও অঞ্চলভিত্তিক অনেক রীতি চালু ছিল, এখনও আছে। তাই নিরক্ষর অশিক্ষিত এবং বৃদ্ধদের সুবিধার জন্যে নবী (সা.) এর যামানায় কুরআন পাঠে বিভিন্ন রীতি অনুমোদন করা হয়েছিল।

এই কারণে বিভিন্নগোত্রে বিভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠ চালু হয়ে যায় । এই বিভিন্ন রীতি অর্থাৎ- সাত গোত্রীয় রীতিতে কুরআন পাঠ চালু হওয়া কোন সমস্যা বা খারাপের কিছু ছিল না। যেহেতু এর অনুমোদন হযরত জীব্রাইল (আ.) নবী (সা.) কে দিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল যখন সেই সাত রীতিতে কুরআন পাঠ সীমাবদ্ধ না থেকে আরো বিভিন্ন উপরীতি সেই যামানায়ই আবিস্তৃত হল।

অতএব, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এর পরিণাম আগামী দিনে যে কী হবে, আরো যে কত উপরীতির আবির্ভাব ঘটবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর এর ফলাফল হবে বড়ই মর্মান্তিক। কেননা, যার যা খুশী সে সেই রীতি গ্রহণ করবে। ফলে আল্লাহ কর্তৃক নাজিলকৃত রীতির অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় দেখা দিবে। এর অর্থ হেফাজতে কুরআনের ব্যাপারে বিঘ্ন ঘটবে। এসব ভাবী পরিণামের প্রতি লক্ষ্য করে হযরত উসমান (রাযি.) বড়ই চিন্তিত হলেন এবং কুরআনের এক রীতিতে পাঠ নিতান্তই প্রয়োজন বোধ করলেন।

আরও পড়তে পারেন-

(৩) খলীফা হযরত উসমান (রাযি.) এর খেলাফতের শুরু দিকে আর্মেনিয়া ও আজরবাইযানে মুসলমানদের সংগে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সে যুদ্ধে হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাযি.) ও ছিলেন। তিনি সে জিহাদের সফরে হেজায ও শামের বিভিন্ন গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে কুরআনের বিভিন্ন পাঠ দেখতে পান। হুজাইফা (রাযি.) একজন দূরদর্শী বিচক্ষণ, অভিন্ন এবং গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। যার উপাধী ছিল ছিল- ছিররুন নবী বা নবী (সা.) এর গোপন রহস্যজ্ঞানী। নবী (সা.) সমস্ত গোপন কথা যা কেয়ামত পর্যন্ত সংগঠিত হবে হযরত হুজাইফা (রাযি.) কে বলে গেছেন। তিনি এসব বিভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠ দেখে ভীত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন।

তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন এর ভাবী পরিণাম। তাই জেহাদ শেষে তিনি মদীনায় এসে পবিত্র কুরআনের এক পাঠে সকলকে বাধ্য করার জন্যে খলীফাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। খলীফা উসমান (রাযি.) ও এর গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন। অতঃপর খলীফা মক্কা-মদীনা ও আশেপাশের সমস্ত ছাহাবাগণকে দরবারে তলব করেন। তাতে পঞ্চাশ হাজার সাহাবার সমাবেশ ঘটে। খলীফা তাদের সামনে বিষয়টা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন এবং সকলের পরামর্শ কামনা করেন।

সমবেত ৫০ হাজার সাহাবা হযরত উসমান (রাযি.) এর মতের সাথে একাত্বতা পোষণ করেন, এবং উক্ত সমাবেশেই ৫০ হাজার সাহাবার সর্বসম্মতিক্রমে শুধুমাত্র “এক রীতিতেই কুরআন পাঠ” এর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং একে দ্রুত কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়।

অতঃপর খলীফা সবাইকে ধন্যবাদ ও শুকরিয়া জ্ঞাপন করার মধ্য দিয়ে পরামর্শ সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন এবং কাল বিলম্ব না করে তৎক্ষণিক হযরত হাফসা (রাযি.) এর নিকট হতে কুরআনের সেই আসল মাস্হাফ চেয়ে নেন। এবং পুনঃ সেই সোভাগ্যবান ছাহাবী প্রধান ওহী লেখক হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রাযি.) কে প্রধান করে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি কার্যকরি কমিটি গঠন করা হয়। অপর তিন সদস্য ছিলেন কোরাইশী সাহাবা যথাক্রমে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর, ছাইদ ইবনে আস, আব্দুর রহমান ইবনে হারেস (রাঃ)। তাদেরকে একত্রিত হয়ে কুরআনের বিভিন্ন অনুলিপি প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। সাথে সাথে তাদেরকে এটাও জানিয়ে দেয়া হয় যে, এবার অনুলিপিগুলো মাত্র এক কেরাত এবং এক রীতিতেই লিখতে হবে।

সুতরাং আপনাদের তিন কোরাইশী এবং যায়েদের মধ্যে যখন কোন শব্দের উচ্চারণ বা বানানে মতভেদ দেখা দিবে তখন আপনারা অন্য সব রীতি পরিত্যাগ করতঃ ধুমাত্র কুরাইশী রীতিতেই লিপিবদ্ধ করবেন। কেননা, কুরআন কুরাইশদের ভাষায় এবং তাদের রীতিতেই নাজিল হয়েছে। অতঃপর উক্ত কমিটি সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ কষ্ট স্বীকার করে এক ভাষা ও এক রীতির উপর সাত কপি অনুলিপি বা মাসহাফ প্রস্তুত করে খলীফার দরবারে পেশ করা হয়।

খলীফা এক কপি মদীনায় রেখে বাকী কপিগুলো এক কপি করে বিভিন্ন রাজ্যে প্রেরণ করেন। সে রাজ্যগুলো হচ্ছে মক্কা, শাম, ইয়ামেন, বসৱা, কৃষ্ণা ও বাহরাইন। সাথে সাথে সমস্ত প্রদেশে কয়েকটা আবশ্যকীয় মান জারী করা হয়-

(ক) এখন থেকে সবাইকে কুরআনের পাঠ তেলাওয়াত, এবং তা’লিম ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই রীতি অনুসরণ করতে হবে। খ) অন্য সমস্ত রীতিকে নিষিদ্ধ করা হল। সে সব রীতির ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হল। (গ) এবং অন্য সব রীতির উপরে লেখা যার কাছে যে মাসহাফ রয়েছে তা অবিলম্বে জ্বালিয়ে দিতে হবে। এর বিরুদ্ধাচরণকারীর ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অভিজ্ঞ খলীফা এসব আইনের মাধ্যমে সমস্ত লোকদিগকে উক্ত রীতির হুবহু অনুসরণ করাতে সামর্থ হন। তারা পূর্বের সমস্ত মাসহাক বা অনুলিপিগুলো জ্বালিয়ে দেন। আল্লাহর অশেষ কৃপা আর রহমাতে খলীফা সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদ (সা.)কে কুরআন পাঠে মতভেদ থেকে চিরতরে রক্ষা করেন।

আল্লাহ হযরত হুজাইফা (রাযি.) এবং হযরত যায়েদ (রাযি.) সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন। হযরত উসমান (রাযি.) যেহেতু সবাইকে এক রীতি ও এক কোতের উপর কুরআন পড়ার নিয়ম চালু করেছিলেন এবং সেই রীতি, সেই কেরাত এবং তদ্রুপ মাস্হাফ আজও আমাদের বিশ্বে বিদ্যমান। (ইনশাআল্লাহ, কেয়ামত পর্যন্ত এভাবেই থাকবে)।

তাই এই রীতি ও এই ক্বেরাতের মাস্হাফকে ‘মাসহাফে উসমানিয়া’ বলা হয়। আর খলীফা উসমানকে ‘জামেউল কুরআন’ হিসেবে উপাধী দেয়া হয়। শুধুমাত্র এই দৃষ্টিকোণ থেকেই । নতুবা বাস্তবে খলীফা উসমান (রাযি.) পবিত্র কুরআন একত্রকারী ছিলেন না; বরং কুরআন একত্রকারী ছিলেন খলীফা আবু বক্কর ও খলীফা উমর (রাযি.) যা বিস্তারিতভাবে পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, আজ আমাদের দেশসহ সমস্ত বিশ্বে যে তারতীবের উপর কুরআন বিদ্যমান এটা হুবহু সেই মাসহাফের অনুরূপ যা হযরত উসমান (রাযি.) এর কাছে ছিল একটি অক্ষর পর্যন্ত কমবেশ হয়নি। তাই উলামা ফুকাহাগণের সর্বস্বীকৃত ঐক্যমত যে, ভবিষ্যতে কুরআনের অনুলিপি, মূদ্রণ ও ছাপার ক্ষেত্রে মাস্হাফে উসমানিয়ার তারতীব ও ধারা হুবহু অনুসরণ করা অপরিহার্য। এর ব্যতিক্রম জায়েয নেই এবং সেটা গ্রহণযোগ্যও হবে না। কেন সাহাবায়ে কেরামগণের ইজমা বা কোন বিষয়ে ঐক্যমত শরীয়তের বিধানের অন্ত ভূক্ত।

অতএব, এর বিরুদ্ধাচরণ মানে শরীয়তের বিধানের বিরুদ্ধাচরণ। ইতকান গ্রন্থে আলোচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করা হয় যে, বর্তমানে পবিত্র কুরআন যেই তারতীব এবং নজম (মাল্য সুত্র) এর উপর বিদ্যমান, এটা হুবহু সেই নজম ও তারতীব, যার সাথে মহান আল্লাহ লাওহে মাহফুজ থেকে স্বীয় রাসুল মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি অবতীর্ণ করেছিলেন। কোন অগ্রাংশকে পশ্চাতে নেয়া হয়নি তেমনি কোন পশ্চাৎ অংশকে আগে আনা হয়নি। (আল ইতকান ফী উলুমিল কুরআন, ১ম খন্ড)।

তবে ৩০তম পারা, যাকে আমপারা বলা হয়। ভিন্নভাবে ছাপার অনুমতি দেয়া হয়েছে বিশেষ প্রয়োজনে। অর্থাৎ, বাচ্চাদের শিক্ষার সুবিধার্থে এই অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু এই জায়েয হওয়া বা অনুমতি প্রদান করা আমপারার সাথেই সম্পৃক্ত। অন্য পারা সমূহের ব্যাপারে নয় ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।