Home ইসলাম স্বর্ণ পরিশোধন ও রপ্তানিতে গৌরবময় মুসলিম অধ্যায়

স্বর্ণ পরিশোধন ও রপ্তানিতে গৌরবময় মুসলিম অধ্যায়

।। আতাউর রহমান খসরু ।।

মানবসমাজে স্বর্ণের ব্যবহার শুরু হয়েছে আনুমানিক তিন থেকে ছয় হাজার বছর আগে। স্বর্ণ পরিশোধনের গৌরবময় ইতিহাসের সূচনা হয় মিসরীয়দের মাধ্যমে। খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ সনে মিসরীয়রা তাদের নদীগুলো থেকে স্বর্ণমিশ্রিত বালু সংগ্রহ করত এবং জলীয় পদ্ধতিতে তা পৃথক করত। এরপর সংগৃহীত স্বর্ণকণা গলিয়ে অলংকার তৈরি করত।

মিসরীয়দের উদ্ভাবিত পরিশোধন পদ্ধতি ধীরে ধীরে পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতা ও জাতিগুলোর ভেতর ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রম-উন্নতির ধারায় যা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে।
মুসলিম সভ্যতায় স্বর্ণ পরিশোধন: মুসলিমরা রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত শাম বিজয় করার পর স্বর্ণ পরিশোধনের প্রযুক্তি তাদের হস্তগত হয়। উমাইয়া শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় আফ্রিকা ও স্পেনে স্বর্ণ পরিশোধন শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং স্বর্ণ-রৌপ্যের বিস্তৃত বাজার তৈরি হয়। আব্বাসীয় শাসকরাও এ বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখেন। এ সময় মুসলিম বিজ্ঞানীরা স্বর্ণ পরিশোধন পদ্ধতির ব্যাপক উন্নতি ঘটান। তাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি স্বর্ণ-রৌপ্যকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধন করা সম্ভব হতো। স্বর্ণ-রৌপ্যসহ খনিজ দ্রব্যগুলো পরিশোধনের পদ্ধতি ও কৌশল বিষয়ে মুসলিম বিজ্ঞানীরা অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন হাসান ইবনে আহমদ আল-হামদানি রচিত ‘আল-জাওহারাতাইনিল আতিকাতাইনি মিনাস সাফরায়ি ওয়াল-বাইদায়ি’ ও আল-বেরুনি রচিত ‘আল-জামাহিরু ফি-মারিফাতিল জাওয়াহিরু’।

যে নগর থেকে স্বর্ণ রপ্তানি হতো : পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির প্রাচীন শিল্প নগরী তাদমেক্কা। মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই নগরীতে হাতির দাঁত, কাপড়, কাচ ও স্বর্ণ শিল্পের বিস্তার ঘটে। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিকরা তাদমেক্কায় ধাতব মুদ্রা তৈরিতে ব্যবহৃত এক সেট ছাঁচ আবিষ্কার করেছেন। ধারণা করা হয়, মধ্যযুগে এখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ধাতব মুদ্রা তৈরি করে রপ্তানি করা হতো।

খ্রিস্টীয় ১১ শতকের আরব ঐতিহাসিক আবু আবদুল্লাহ আল-বাকরির বর্ণনা থেকে সে ধারণা লাভ করা যায়। তিনি তাঁর ‘দ্য বুক অব রোডস এবং কিংডমস’ (কিতাবুল মাসালিক ওয়াল মামালিক) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে তিনি তাদমেক্কাতে এমন স্বর্ণ মুদ্রা দেখেছেন, যাতে কোনো শাসকের পরিচয়সূচক চিহ্ন ছিল না; এমনকি নিজ শহরেরও কোনো চিহ্ন তাতে ছিল না। যা থেকে ধারণা করা যায় মুদ্রাগুলো অন্যত্র রপ্তানি করা হতো। আর তা ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো নবম থেকে একাদশ শতকের।

যেভাবে পরিশোধন করা হতো : যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জিয়ানলুকা পাস্তোরেলি, মার্ক ওয়াল্টন ও স্যাম নিক্সন যৌথভাবে তাদমেক্কায় পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর ওপর রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

Caravans of Gold, Fragments in Time: Art, Culture, and Exchange across Medieval Saharan Africa

শীর্ষক গবেষণাপত্রে তারা তাদের গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন। যার সারকথা হলো—গবেষকরা মনে করেন, তাদমেক্কার অধিবাসীরা নিম্নমানের স্বর্ণের দলা সংগ্রহ করে তা পরিশোধন করতেন এবং তা দিয়ে উন্নতমানের ‘চিহ্নমুক্ত’ স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করতেন। কেননা প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধাতব মুদ্রা তৈরির ছাঁচ ছাড়াও সেখানে স্বর্ণ গলানোর কাজে ব্যবহৃত ক্রুসিবলের (গলানোর পাত্র) খণ্ড পেয়েছেন। যদিও প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে এমন ক্রুসবল পাওয়ার ঘটনা বিরল।

আরও পড়তে পারেন-

কেননা স্বর্ণের কোনো অংশ যেন পাত্রে লেগে না থাকে এ জন্য তা ভেঙে ফেলা হতো। গবেষকরা ক্রুসবলের খণ্ডের সঙ্গে এক প্রকার কাচ জাতীয় পদার্থ খুঁজে পেয়েছেন। প্রাচীন যুগে বিশ্বাস করা হতো ‘অক্সাইড মিনারেলস’ দূর করার ক্ষেত্রে কাচের ভূমিকা আছে এবং কাচের ব্যবহারে স্বর্ণ অধিকতর পরিশুদ্ধ হয়। মুদ্রা তৈরির ছাঁচে লেগে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বর্ণকণার ইলেকট্রন মাইক্রোস্কপি ও এক্স-রে নির্গমণ স্ক্যানিং করে গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন যে তাদমেক্কার স্বর্ণ প্রকৌশলীরা স্বর্ণকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধনে কাজ করতেন।

তাদমেক্কার স্বর্ণ পরিশোধন পদ্ধতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে গবেষকরা লেক মিশিগানের স্বর্ণ মিশ্রিত ধুলো সংগ্রহ করে তার সঙ্গে বালু মেশান। তার সঙ্গে যুক্ত করেন চূর্ণ করা সোডা ও কাচ। অতঃপর তারা নমুনাটি এক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস মাত্রায় সাত ঘণ্টা রেখে দেন। ফলাফলে তারা দেখেন স্বর্ণ ও কাচ আলাদা হয়ে গেছে। বেশির ভাগ বালু ওপরে উঠে গেছে এবং ক্রুসবলের নিচে একটি স্বর্ণের বোতাম তৈরি হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক ও পদার্থ বিজ্ঞানীদের এই যৌথ গবেষণা প্রমাণ করে তাদমেক্কার স্বর্ণ প্রকৌশলীরা শুধু ‘চিহ্নহীন’ মুদ্রা তৈরির কৌশলই রপ্ত করেনি; বরং তারা স্বর্ণ পরিশোধনের পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছিল।

মুসলিম স্পেনে স্বর্ণ পরিশোধন : রোমান শাসনামল থেকেই আইবেরিয়ান উপদ্বীপ (স্পেন ও পর্তুগাল) অত্র অঞ্চলের খনি ও খনিজ বিদ্যার কেন্দ্র ছিল। যা মুসলিম স্পেনে ধাতুবিদ্যার প্রসারে পাদভূমি হিসেবে কাজ করে। আন্দালুসিয়ান (মুসলিম স্পেন) ভূগোলবিদদের বর্ণনা ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায় মুসলিম যুগে খনিজ বিদ্যার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। এ সময় জাইন ও আল-গ্রাবা স্বর্ণ-রৌপ্য, কর্ডোভা লোহা ও সিসা, মালাগা রুবি, টলোডো ও মুরসিয়া লোহার জন্য খ্যাতি লাভ করেছিল। স্পেনসহ মুসলিম বিশ্বের একাধিক বিজ্ঞানী স্বর্ণ-রৌপ্যসহ খনিজ দ্রব্য পরিশোধন পদ্ধতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। তাদের মধ্যে আল-বেরুনি (৯৭৩-১০৪৮ খ্রি.), আল-কিন্দি (৮০১-৮৭৩ খ্রি.) ও জাবির ইবনে হাইয়ান (মৃত্যু ৮১৫ খ্রি.) অন্যতম। তাদের সূত্র ও কৌশল দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় খনিজশিল্পে ব্যবহৃত হয়েছে।

স্পেনে অলংকারশিল্পের বিকাশ : মুসলিম স্পেনে শুধু খনিজ ও পদার্থ বিদ্যার বিকাশ ঘটেনি; বরং স্বর্ণ-রৌপ্য অলংকার তৈরি ও স্বর্ণ-রৌপ্যসহ অন্যান্য খনিজ দ্রব্য ব্যবহার করে আসবাব অলংকরণের বিশেষ রীতির প্রচলন ঘটে। ইংরেজি, ফরাসি ও ল্যাটিন ভাষায় যাকে ‘দামেস্কিন’ শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। এই পদ্ধতি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে মানুষ মোমদানি, ধূপদানি, প্লেট, ল্যাম্প, তালা-চাবিসহ নিত্য ব্যবহার্য আসবাবের অলংকরণে স্বর্ণ-রৌপ্যসহ অন্যান্য খনিজ দ্রব্য ব্যবহার করত।

অবশ্য মুসলিম পৃষ্ঠপোষকতায় স্বর্ণ-রৌপ্যসহ অন্যান্য খনিজ দ্রব্যের পরিশোধন ও অলংকরণ পদ্ধতির ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছিল বলে আইবেরিয়ান উপদ্বীপসহ অত্র অঞ্চলের জীবনযাত্রায় অস্বাভাবিক বিলাসিতা বৃদ্ধি পেয়েছিল বলেও অনুযোগ করেন কোনো কোনো ঐতিহাসিক।

ভারতবর্ষের স্বর্ণশিল্পে মুসলিম অবদান : ভারতবর্ষে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতীয় জুয়েলারি শিল্প অনন্য উচ্চতা লাভ করে। গহনা তৈরির ভারতীয় রীতির সঙ্গে মধ্য এশিয়া, পারস্য ও আরবীয় শিল্পশৈলীর সংযোগে এ শিল্পের অভাবনীয় উত্থান ঘটে। মোগল পৃষ্ঠপোষকতায় গহনার ‘এনামেলিং’ কৌশলটি ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। প্রচলিত রীতি-কৌশলের উন্নয়ন ছাড়াও তখন গহনা তৈরির বহু নতুন কৌশল উদ্ভাবিত হয়। প্রাচীন ভারতীয় নকশাগুলো যেমন জ্যামিতিক, পুষ্পশোভিত, প্রকৃতি-অনুপ্রাণিত নকশার পরিবর্তন-পরিমার্জনের পাশাপাশি ক্রিসেন্ট (অর্ধচন্দ্র) ও স্টেম (গাছের কাণ্ড) নকশার উদ্ভব হয়।

‘কুন্দন’ তথা খাঁটি স্বর্ণে পাথর স্থাপনের নকশাটিও মোগল আমলে প্রসার পায়। পাথর খোদাই করে তাতে স্বর্ণ বসানোর রীতিটিও মোগলদের অবদান। এই রীতিতে পাথরের ওপর গাছের কাণ্ড, পাতা ও ফুলের প্যাটার্ন তৈরি করা হতো। লাল, সবুজ, সাদাসহ প্রভৃতি রঙিন পান্নার প্রতি মোগল সম্রাটদের বিশেষ দুর্বলতা ছিল। তারা পান্নাকে ‘চাঁদের কান্না’ বলত। ফলে মোগল আমলে গহনায় রঙিন পাথর ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করে। ‘জাদাউ’ পদ্ধতির উদ্ভব মোগলদের মাধ্যমেই হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে রাজস্থান ও গুজরাটের স্বর্ণকাররা এই পদ্ধতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। জাদাউ হলো নির্ধারিত ছাঁচে গলিত স্বর্ণ ঢালা এবং পরে তাতে রত্ন যুক্ত করে পলিস করা। বহুল জনপ্রিয় ‘মিনাকারি’র কাজ ও ‘করনফুল ঝুমকা’রও ব্যাপক প্রচলন ঘটে মোগল আমলে। মুসলিম শাসনামলেই মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের বাজারে ভারতীয় অলংকারের কদর বৃদ্ধি পায়।

ভারতের স্বর্ণশিল্পের বিকাশে হায়দরাবাদের নিজামদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের সংগ্রহে ছিল বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও মূল্যবান রত্ন। শেষ নিজাম মির উসমান আলী খান—টাইম ম্যাগাজিনের বর্ণনায় যিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, তিনি রানি এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের বিয়েতে বিখ্যাত হীরার নেকলেস উপহার দেন। এ ছাড়া ভারতের অন্যতম প্রাচীন স্বর্ণ খনি ‘হুট্টি’-এর আনুষ্ঠানিক খননকাজের সূচনা ও হায়দরাবাদ গোল্ড মাইনস কম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে উপমহাদেশের স্বর্ণশিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখেন হায়দরাবাদের নিজাম।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো স্বর্ণ পরিশোধন ও রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প-পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপ। স্বর্ণশিল্প বিকাশে সরকারকে ‘গোল্ড ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও দিয়েছে তারা।

তথ্যঋণ : ফোর্বস ডটকম, সিটিজ অব লাইটস, মাই গোল্ড গাইড

দ্য বেটার ইন্ডিয়া ডটকম ও ইসলাম স্টোরি ডটকম

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।