Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইসলামের দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনায় মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম

ইসলামের দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনায় মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম

।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।

মানুষের মুখের ভাষা মানুষের জীবনের মতই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে সৃষ্টির সেরা মনে করা হয় মূলতঃ দুটি কারণে। প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষই কেবল নিজের মনের ভাব ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে। আসলে ভাষা হলো আল্লাহ পাকের এক বিশেষ নিয়ামত। মানব জাতিকে সৃষ্টি করার পর যে সকল নিয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে ভাষা অন্যতম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পৃথিবীতে যুগের চাহিদার প্রেক্ষিতে অসংখ্য ভাষা সৃষ্টি করেছেন। বিশাল এই পৃথিবীতে বিভিন্ন কোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাজারো ভাষা। এ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা আড়াই হজারেরও বেশী ভাষা সৃষ্টি করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহর সৃষ্টি কোন ভাষাকেই অবজ্ঞা করার অবকাশ নেই।

প্রশ্ন হতে পারে এক আদম আর হাওয়া (আ.)এর সন্তানের মধ্যে এত ভাষার কী প্রয়োজন ছিল? কী প্রয়োজন ছিল এত বর্ণ মালার? আল্লাহ স্বয়ং সেই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে অবশ্যই জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে”। (সূরা রুম, ২২ আয়াত)।

উল্লিখিত আয়াতের দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ পাক তার জমীনে যুগের চাহিদা মত যখন যে ভাষায় প্রয়োজন বোধ করেছেন, তাই করেছেন এবং সেই ভাষার মাধ্যমে তার মুবারক দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াশ পেয়েছেন। স্মর্তব্য, পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের মহান দায়িত্ব নিয়ে যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল আগমন করেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন নিজ নিজ মাতৃভাষায় বিশেষ পারদর্শী। এর অনুকুলে পবিত্র কুরআন পাকে ইরশাদ হয়েছে, “আমি সকল রাসূলকেই তাদের স্ব জাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি। যাতে তাদেরকে (আমার বাণী) স্পষ্ট ভাবে বুঝাতে পারেন”। (সূরা ইব্রাহীম- ৪ আয়াত)

এতে করে আরো প্রতিয়মান হয় যে আল্লাহর জমীনে সর্বত্র তাঁর আইন প্রতিষ্ঠা করতে হলে, দ্বীন কায়েম করতে হলে, নবী রাসূলগণের সেই মিশনে জাতিকে তুলে আনতে হলে যে ভাষার সাহায্য পয়োজন, তা হলো মাতৃ ভাষা। মায়ের ভাষা ছাড়া যে দ্বীন কায়েম করা যাবে না, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর মহত্ব, তাঁর কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, সে দিকে ইংগিত করেই আল্লাহ তায়ালা নিজেই ইরশাদ করেছেন, “যদি আমি তাকে কোন ভিন্ন ভাষায় অবর্তীণ করতাম, অতঃপর তিনি তা তাদের কাছে পাঠ করতেন, তবে তারা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করতো না”। (সূরা শূআরা, ১৯৮-১৯৯ আয়াত)।

স্মর্তব্য, রাসূল (সা.) নিজেকে ‘আরব জাতির মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ব ভাষার অধিকারী’ বলে ঘোষণা করেছেন। দ্বীনের দাওয়াতের জন্য বিশুদ্ব ভাষার যে কত প্রয়োজন, তা আরো প্রকটভাবে ফুটে ওঠে হযরত মুসা (আ.)এর ঘটনায়। তিনি যখন নুবুওয়্যাত লাভ করলেন, তখন নিজের যবানের প্রতি শংকিত হলেন। কেননা তাঁর কথার মধ্যে জড়তা ছিল। তাই তিনি মনে মনে ভাবলেন, যদি তিনি দ্বীনের দাওয়াত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে না পারেন, আর তার কারণে যদি তারা আল্লাহর শ্বাশত দ্বীনকে প্রত্যাখান করে, তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে কী জবাব দিব? সংগত কারণে তিনি আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন, “হে মহান পালনকর্তা! আমি আমার যবানের ব্যপারে শংকিত। আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে যবানের দিকে অধিক বিশুদ্বভাষী। তাকেও আমার সঙ্গী করে দিন”। (সূরা কাসাস-৩৪ আয়াত)।

স্মর্তব্য, জন্মসূত্রে মায়ের মুখ থেকে যে ভাষা লাভ করি সেই ভাষাকে বলা হয়ে থাকে মাতৃভাষা। যে ভাষায় আমি আমার মনের আবেগ, উচ্ছাস, আনন্দ-বেদনা সহজেই প্রকাশ করতে পারি। যে ভাষায় আমি নিজেকে বুঝি, জগত ও জীবন সম্বন্ধে অবহিত হই। যে ভাষায় আমি আমার প্রতিভা, মেধা, চিন্তা-চেতনাকে শাণিত করতে পারি। যে ভাষায় দরদ, প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসা তুলে ধরতে পারি, সে ভাষা হলো আমার মায়ের ভাষা। সে ভাষা অতুলনীয় অনুপম।

আরও পড়তে পারেন-

বস্তুতঃ মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত কোন জাতি কখনও সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতিতে পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। সেই সাথে বেড়েছে বিভিন্ন ভাষার গুরুত্ব। তবে যত গুরুত্বই বাড়ূক না কেন, ভাষার গুরুত্ব মাতৃভাষাকে ছাপিয়ে উঠতে পারে না। নিজের ভাষাকে উপেক্ষা করে কোন জাতিকে বিকশিত করা যায় না। তথা জাতির সার্বিক উন্নতি সাধিত হয় না। কেননা, যে কোন সমাজের ঐতিহ্য, মেধা, সংস্কৃতি বিকাশ ও পালনে ভাষা এক উৎকৃষ্ট মাধ্যম।

উল্লেখ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বর্তমান যুগে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী যারা নিজেদেরকে পরিচিত করেছে, মহিমান্বিত করেছে, তা সম্ভব হয়েছে নিজের মাতৃভাষার মাধ্যমে। কেননা, কোন কিছু আয়ত্ব করা কিংবা কাউকে কিছু বুঝাতে মাতৃভাষায় যতখানি সহজ, অন্য কোন ভাষা ততখানি সহজ নয়। আমাদের দেশের ভাষা বাংলা ভাষা। প্রাচীনতম ভাষার মধ্যে এটি অন্যতম। আমাদের ভাষার একটা ইতিহাস রয়েছে। নিকট অতীতে আমাদের মাতৃভাষার উপর অনেক ঝড় বয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার জন্য জীবন দিতেও কুন্ঠাবোধ করেনি। মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে রাজপথে নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা রূপে মর্যাদা লাভ করেছে। শুধু স্বীকৃতিই নয় বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইদানিং আমাদের এক শ্রেণীর মানুষ বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে ভিন্ন ভাষাকে প্রাধান্য দেয়া শুরু করেছে। ভিন্নভাষা শিক্ষা করা তো দোষনীয় নয়, তবে দোষনীয় হবে তখনই যখন আপন মাতৃভাষা গুরুত্বহীন হয়, অবহেলিত হয়। কাজেই আমাদের প্রত্যেককেই মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে হবে। তথা মাতৃভাষার ব্যাপক চর্চা করতে হবে।

দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। সঙ্গত কারণে বাংলাভাষার পাশাপাশি পবিত্র কুরআন আরবীতে নাযিলের পটভূমি ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা অর্জন করতে হবে। কুরআন ও হাদীসকে বাংলায় ব্যাখ্যা করার প্রয়াস চালাতে হবে এবং ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা করতে হবে। সভা-সমিতিতে, সেমিনারেও মাতৃভাষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কুরআন ও হাদীস থেকে জনগণকে মাতৃভাষার মাধ্যমে সকল ক্ষেত্রে তুলে ধরতে হবে। আর এসব ক্ষেত্রে আলেম সমাজ তথা ইসলামী মাদ্রাসায় কর্মরত আলেমগণ ও মসজিদের ইমাম সাহেবদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশে ইসলামের আলো টিকিয়ে রাখতে হলে বিজ্ঞ আলেম সমাজকে কুরআন হাদীসের কথা মাতৃভাষায় জনগণকে বুঝাতে হবে, অন্য ভাষায় নয়।

বস্তুতঃ আল্লাহর জমীনে সর্বত্রই দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে হলে দ্বীনি সমাজ কায়েম করতে হলে নবী-রাসূলগণের সেই মিশন জাতির কাছে তুলে ধরতে হবে। আর তা তুলে ধরতে যে ভাষার প্রয়াজন, তাহলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষা ছাড়া যে দ্বীন কায়েম ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সহজ নয়, তা সকলকে অনুধাবন করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে মুসলিম জাতি আজ মারাত্মক নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার। ইহুদী-নাসারা গোষ্ঠি ইসলামকে বিশ্বের মাঝ থেকে উৎখাত করতে বহুমূখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো আজ বিশ্বের মাঝ থেকে ইসলামী মূল্যবোধকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করতে উঠে পড়ে লেগেছে। পাশ্চ্যাত্যের আগ্রাসী মাধ্যমগুলি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধ্বংস করতে প্রয়াস পাচ্ছে। প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও ইন্টারনেট মিডিয়ার মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে গেছে পশ্চিমা সংস্কৃতি। তাদের মিডিয়ার বদৌলতে ইসলামের বিরুদ্ধে বহুমূখী ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি চলছে অপসংস্কৃতির অপতৎপরতা। অপসংস্কৃতির সয়লাবে ছেয়ে গেছে সারাদেশ। আর সেই গড্ডালিকা প্রবাহে আমাদের কোমলমতি যুবক-যুবতীরা খড়কুটোর মত ভেসে চলেছে অধপতনের গহবরে। অথচ আমরা তা থেকে উদ্ধারের পদক্ষেপ নিচ্ছি না। আর তার মূল কারণ হলো কুরআন-হাদীসের লব্ধ জ্ঞানকে আমরা মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রচার-প্রসারে ব্যর্থ হচ্ছি। অথচ উর্দু এবং ফার্সি ভাষা ভাষীরা কিন্তু তাদের মাতৃভাষায় সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যদি পারে তবে আমরা পারবো না কেন?

বিশ্বায়নের এ সময়ে প্রচার মাধ্যমের গুরুত্ব অপরিসীম। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান যুগটা মিডিয়ার যুগ। আমাদের শত্রুরা কলমের মাধ্যমে মুসলমানের উপর যে সব আঘাত হানছে, সে সব আঘাতের জবাব আমরা সঠিকভাবে কলমের মাধ্যমে দিতে পারছি না। কাজেই এই মুহূর্তে আমাদের একদল কলম সৈনিক গড়ে তুলতে হবে। যারা কিনা আমাদের মাতৃভাষাকে সাহিত্যের রসে সমৃদ্ধ করবে। এবং তার মাধ্যমে ইসলামের মিশনকে জয়যুক্ত করবে।

পত্র-পত্রিকা একটা প্রচার মাধ্যম। ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠির ষড়যন্ত্রের নখর থাবা থেকে উত্তরণে ইসলামী পত্র-পত্রিকার প্রচার-প্রসারের বিকল্প নেই। সংগত কারণে আমি সকল কলম সৈনিক ভাইদের উদাত্ত আহবান জানাই। আসুন আমরা শপথ নেই! সাহিত্য রচনার মাধ্যমে ইসলামের আলো বাংলা ভাষাভাষী প্রতিটি মানুষের মাঝে পৌঁছে দেই এবং দূর করি সব অপসংস্কৃতির অন্ধকার।

লেখকঃ মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ঢাকা, খতীব- তিস্তাগেট জামে মসজিদ, টংগী, গাজীপুর, অর্থসম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এবং উপদেষ্টা- উম্মাহ২৪ডটকম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।