Home লাইফ স্টাইল আদর্শ ও সফল জীবন গড়ার গুণাবলী

আদর্শ ও সফল জীবন গড়ার গুণাবলী

।। আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ।।

মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে জ্ঞান ও বিবেক শক্তি দান করেছেন। এই জ্ঞান ও বিবেক শক্তি দ্বারা যখন একজন মানুষ ইসলাম নির্দেশিত পথে পরিচালিত হবে, তখনই সে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে তার দুনিয়াবী জীবন যেমন সফলকাম হবে, তেমনি পরকালের অফুরন্ত জীবনও স্বার্থক হবে। এই জ্ঞান ও বিবেক শক্তির বিকাশ ঘটাতে হলে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এবং অভিজ্ঞদের সংস্পর্শে থেকে অর্জিত শিক্ষার অনুশীলন করতে হবে। তারপর নিজের বাস্তব জীবনকে সে অনুপাতে পরিচালনা করা লাগবে। যেসব ভাগ্যবান জীবনকে শৃঙ্খলার সাথে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারে, তাদের জীবনকে আদর্শ জীবন বলা হয়। এই আদর্শ জীবন গড়তে হলে করণীয় প্রসঙ্গে কিছু লিখার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

আদর্শ জীবন গড়ার জন্য ৪টি শর্ত রয়েছে। এই ৪টি শর্ত আত্মস্থ করে সকলকে ছাত্র জীবন থেকেই অনুশীলন করে চলতে হবে। এর এক নম্বর শর্ত হচ্ছে, পাক-পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। জীবনের সর্বস্তরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পাক-পবিত্র, সুন্দর ও পরিপাটি হয়ে চলতে হবে। নোংরা, অপরিষ্কার, অগোছালো ও বিশৃঙ্খল হয়ে চলা যাবে না।

দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, সুস্থির, ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু এবং জ্ঞান খরচ করে কাজ করা। অস্থির, অধৈর্য ও আবেগাপ্লুত হয়ে কাজ না করা। যে কোন কাজের সময় বুঝে, শুনে, সুস্থির হয়ে, ভাবনা-চিন্তা ও ভবিষ্যত ভাল-মন্দ ও কল্যাণ-অকল্যাণের পরিণতি বিশ্লেষণ করে আল্লাহর উপর ভরসা করে কাজ শুরু করা। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া হুটহাট বা মন যা চাইল তা কোন অবস্থাতেই করা যাবে না।

উন্নত জীবন গঠনের তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, ইনসাফ ও ন্যায়-নিষ্ঠাবান হওয়া। ব্যক্তি, পারিবারিক, সমাজ ও জাতীয় জীবনে যে কোন কাজকর্ম ও লেনদেনের সময় ন্যায়-নিষ্ঠা, সততা, আমানতদারি, ইনসাফ ও সুবিচারের পরিপূর্ণ অনুগামী হওয়া। কারো অধিকার ও হক বিন্দু পরিমাণও নষ্ট করা বা খেয়ানত করার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। ব্যক্তি জীবনে নিজের উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব পরিপূর্ণ সততা ও ইনসাফের সাথে আদায় করতে হবে। হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদ তথা আল্লাহর হক ও বান্দার হক্ব এর বিষয়ে সামান্যতম খেয়ানতের চিন্তাও দিল থেকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে ইনসাফ, সুবিচার ও সততার সাথে চলতে হবে। নিজের শরীরের, স্ত্রীর, সন্তানদের, আত্মীয়-স্বজনদের, পাড়া-প্রতিবেশী এবং দেশ ও জাতির হক্ব নিজের অবস্থান অনুপাতে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে আদায় করতে হবে।

উন্নত জীবন গড়ার চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, ইহসান তথা উদারতার গুণ থাকা। মনকে বড় ও উদার করতে হবে এবং সংকীর্ণতা ও কৃপণতা পরিহার করতে হবে। মানবিক দয়া-মায়ার গুণ অর্জন করতে হবে। নিজের রাগ দমন এবং ক্ষমা ও দয়াপ্রদর্শন করা। মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। যার যার সাধ্যমতো মানবতার জন্য ও মাখলুকের কল্যাণে কাজ করা। নিজের চাওয়া-পাওয়ার বাইরে স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ ও জাতির কল্যাণকামী হওয়া এবং সাধ্যমতো সেবা করা।

এই চার গুণের সমাবেশ যার মধ্যে পাওয়া যাবে, বুঝতে হবে তাঁর মধ্যে আদর্শ মানুষ রূপে বিবেচিত হওয়ার গুণাবলী আছে। আর যার মধ্যে এই চার গুণ নেই, বুঝতে হবে সে দেখতে মানুষ হলেও মানবিক গুণাবলীর কাতারে পড়ে না। সে পশু বা পশুর চেয়েও অধম। সুতরাং প্রতিটি তালেবুল ইলমকে এই চার গুণাবলী অর্জনে সবসময় সজাগ ও চেষ্টা সাধনা করে যেতে হবে।

আদর্শ জীবনের গুণাবলীর পর এবার কর্ম জীবনে সফলতা অর্জন করার গুণাবলী প্রসঙ্গে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। কর্মজীবনে সফলতা এবং শীর্ষস্থান অর্জন করতে হলে ১১টি গুণাবলী অর্জন করতে হবে। এসব গুণাবলী অর্জন করতে না পারলে কর্মজীবনে ইতিবাচক ভূমিকা যেমন পালন করা যাবে না, তেমনি নিজের দৃঢ় অবস্থানও নিশ্চিত করতে পারবেন না। এই ১১টি গুণাবলী ও যোগ্যতা হচ্ছে, যথা-

১. হক্কানী উলামায়ে কেরাম ও সফল মানুষদের জীবনী পড়া। কারণ, কর্মজীবনের নানা পরিস্থিতিতে দিক-নির্দেশনা লাভ, প্রতিকূলতার মোকাবেলা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কৌশলী হতে হলে অবশ্যই পূর্বসূরি সফল মানুষদের জীবনী মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। এতে কর্মপন্থা নির্ধারণ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সহযোগিতা পাওয়া যায়।

২. উদারমনা হওয়া তথা অনেক বড় মনের অধিকারী হওয়া। কারণ, সংকীর্ণমনা কোন মানুষ কোন যোগ্যতা বলে নেতৃত্বের স্থানে যেতে পারলেও তাকে আদর্শ পরিচালক বা কর্তা বলা যাবে না। কারণ, সংকীর্ণমনারা যে কোন দায়িত্বে আসীন হতে পারলে স্বৈরাচারিতা বা স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েন। সংকীর্ণমনারা কখনোই সহকর্মী ও অধঃস্তনদের প্রতি ন্যায়চারি হতে পারেন না, যে কারণে তারা ন্যায়নিষ্ঠ ও জনপ্রিয় হতে পারেন না। সংকীর্ণমনা হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তারা ঝুঁকি নিতে পারেন না। সবসময় হীনমন্যতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে থাকেন।

৩. পরোপকারের মানসিকতা লালন করা। একজন সৎ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিত্বকে অবশ্যই সমাজ, দেশ ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখার মানসিকতা লালন করতে হবে। পরোপকারের চিন্তা লালন করেন, এমন একজন ব্যক্তিত্ব তৃণমূল পর্যায় থেকে সহজেই সকলের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠতে পারেন। পরোপকারের চিন্তাহীন স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার মানুষ কখনোই নিজ অঙ্গনে ও বাইরে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন না।

৪. বক্তব্য, ভাষণ ও বিতর্কে সংযত হওয়া এবং মিষ্টভাষী হওয়া। বৈঠক, সভা বা সমাবেশে ফ্লোর পেলেই অসংযত ও লাগামহীন বক্তব্য দেওয়া যাবে না। বক্তব্য দিতে হবে পরিবেশের চাহিদা অনুযায়ী, গোছানো এবং বিষয়ভিত্তিক। বল্গাহীন আবেগ দিয়ে যেমন যা খুশী তা বলে সস্তা আবেগ তৈরি করা যাবে না, তেমনি বয়ান বা বক্তব্য একেবারে আবেগহীনও রাখা যাবে না। বয়ান করার সময় স্রোতাদের আগ্রহ বুঝে বক্তব্য দিতে হবে। বিরক্ত তৈরি করে, এমন বিষয়ে এবং অতিরিক্ত সময় নিয়ে বক্তব্য দেওয়া যাবে না। বক্তব্যের ভাষা সুমিষ্ট, যৌক্তিক, তথ্যভিত্তিক এবং আকর্ষণীয় উপস্থাপনার চেষ্টা করতে হবে।

৫. দূরদৃষ্টির অধিকারী হওয়া। পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার যোগ্যতা থাকা।

৬. দৃঢ়চেতা মনোভাবের অধিকারী হওয়া। হামলা, মামলা, হুমকি, ধমকির কাছে মাথানত না করার দৃঢ় মানসিকতা লালন করতে হবে। সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেওয়ার সময় যেমন বুদ্ধি-পরামর্শ ও যাছাই বাছাই করে নিতে হবে, তেমনি গৃহীত সিদ্ধান্তে ভুল প্রমাণিত না হলে যে কোন মূল্যে দৃঢ় ও অবিচল থাকতে হবে। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত ও মত পরিবর্তনের ফলে নিজের মানসিক দুর্বলতা সবার সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়বে। এতে ক্রমান্বয়ে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

৭. দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে সদা সজাগ ও সতর্ক থাকতে পারা। প্রতিকূল বা অনুকূল পরিবেশে কখন কী করতে হবে না হবে, সে বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকার গুণাবলী অর্জন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে হলে সার্বিক পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে পরামর্শের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। অধিনস্থ ও অনুসারীদের এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। পরিবেশ অনুকূল না থাকলে অনেক সময় ইতিবাচক কথা না বলেও চুপচাপ সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়।

আরও পড়তে পারেন-

৮. সর্বাবস্থায় নীতি-আদর্শের উপর অবিচল ও দৃঢ় থাকা। প্রতিকূল পরিবেশে হয়তো চুপ থাকা যায় সাময়িক; কিন্তু কোনভাবেই নীতি বা আদর্শ বদলানো যাবে না। নীতি ও আদর্শহীন মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায়ে যত সৎই হোক না কেন, তিনি কখনোই সমাজে মর্যাদাবান হতে পারেন না।

৯. একগুঁয়েমি পরিহার করা এবং নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেও গঠনমূলক যে কোন পরামর্শ ও প্রস্তাব গ্রহণে উদার মানসিকতা থাকা। কারণ, একগুঁয়েমি কখনোই মানুষ পছন্দ করেন না। নিজের মতকে সঠিক মনে হলে সেটা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে, অথবা অন্যদেরকে যৌক্তিকভাবে খণ্ডন করার আমন্ত্রণ জানাতে হবে। কিন্তু কোনভাবেই একগুঁয়েমির সাথে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা যাবে না। কারণ, এতে অনেকেই সংক্ষুব্ধ হয়ে পড়তে পারেন, যেটা ভবিষ্যতের জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

১০. নিজেকে খাদেম মনে করা এবং মাখদুম মনে না করা। কর্মজীবনে সহকর্মী ও অধঃস্থনদের প্রতি সবসময় আন্তরিকতা ও সহযোগিতার মানসিকতা লালন করতে হবে। যথাসাধ্য অন্যদের ভাল-মন্দের খোঁজ-খবর রাখতে হবে। যে কারো প্রয়োজনে সাড়া দিতে হবে। নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা যথাসম্ভব বলাবলি থেকে এড়িয়ে চলতে হবে।

১১. আমানতদার হওয়া। হিসাব-নিকাশ ও যে কোন লেনদেন এবং কাজকারবারে স্বচ্ছতা বজায় রেখে চলতে হবে। খেয়ানতের প্রবণতা যার থাকবে, সে কখনো শীর্ষস্থানে যেতে পারবে না। ক্রমান্বয়ে নিজের অঙ্গনে ও বাহিরে সে সমালোচিত হতে থাকবে এবং এটা তার অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।

আদর্শ জীবন গড়ার এবং কর্মজীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে উপরে যে গুণাবলীর বর্ণনা করেছি, এগুলো অর্জন ও মেনে চলতে পারলে আশাকরি আদর্শ ও সফল জীবন গড়া সহজতর হবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে তাঁর নির্দেশনা মতে চলে সফল ও স্বার্থক জীবন গড়ে তোলার তাওফীক দান করুন; আমিন।

লেখক: মুহতামিম, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।