Home ধর্মীয় প্রশ্ন-উত্তর ‘হিজবুত তাওহীদ’ মতবাদ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছেন আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন

‘হিজবুত তাওহীদ’ মতবাদ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছেন আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন

প্রশ্নঃ আমাদের এলাকায় কয়েক বছর পূর্বে নতুন একটি দলের আবির্ভাব হয়েছে। এরা এমন কতগুলো আক্বীদা প্রচার করে বেড়াচ্ছে, যা কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট পরিপন্থী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আর এসব আক্বীদাগুলোর মাধ্যমে এলাকার সরলমনা ও নিরীহ মুসলমান ভাই-বোনদেরকে তাদের দলভুক্ত করে ঈমান হারা করছে। তাদের আক্বীদাগুলোর বিশেষ বিশেষ কয়েকটি ক্রমানুসারে নিম্নে উল্লেখ করা হলো। এদের ব্যাপারে কুরআন-হাদীসের আলোকে মতামত দিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরকে গোমরাহী থেকে বাঁচার পথ বাতলে দিবেন। বিশেষ বিশেষ আক্বীদাগুলো নিুরূপ-

(১) এই দলের প্রধান হলো বায়েযিদ খান পন্নী। তার উক্তি- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে, যা সমাপ্ত করার জন্য আল্লাহ্ তায়ালা তাকে ইলহামের মাধ্যমে দায়িত্ব প্রদান করেছেন।

(২) দলনেতা ও তার অনুসারীদের উক্তি- জুম্আ ও দুই ঈদের নামায পড়ার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ খিলাফত প্রতিষ্ঠা ছাড়া জুম্আ ও ঈদাইনের নামায পড়া ভণ্ডামী ছাড়া আর কিছুই নয়।

(৩) বর্তমান আলেম সমাজ, যারা তাদের দলের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন না বা তাদের দলভুক্ত হবেন না, তারা কাফির, মুশরিক। তাদের পিছনে নামায পড়া হারাম।

(৪) মাযহাব স্বীকার বা মান্য করা তাদের দলগত আক্বীদা বিরোধী।

(৫) যারা ‘হিযবুত তাওহীদ’-এর সাথে একমত নন, মৃত্যুর পর তাদের জানাযা পড়া যাবে না। এমনকি তাদের মা-বাবা হলেও। যেহেতু তারা কাফির ও মুশরিক।

(৬) দাঁড়ি, টুপি, লম্বা জামা ও সুন্নাত নামায পড়া প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। কারণ, এতে ইসলামের কিছু যায় আসে না।

(৭) বর্তমান কুরআন-হাদীস এবং কওমী ও মারকাযী মাদ্রাসার পাঠ্য সিলেবাস তৎকালীন খ্রীস্টান তথা ইংরেজ শাসকদের নির্বাচিত। তাই শরীয়তের বিধান অনুযায়ী তা মানা যাবে না।

(৮) ‘সিহাহ্ সিত্তাহ্’র হাদীসগুলোর উপর নির্ভর করা যায় না। যেহেতু এগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শত শত বছর পর সংকলিত। আমরা এক সপ্তাহ আগের কথা স্মরণ রাখতে পারি না, তারা কিভাবে শত শত বছর আগের কথা স্মরণ রাখবে। তাই এগুলোতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত।

(৯) নবী-রাসূলগণ ভুলের ঊর্ধ্বে নন। যেহেতু তাঁরা আমাদের মত মানুষ। যদিও মর্যাদার দিক দিয়ে কিছুটা পার্থক্য আছে।

  • আবু তাহের (এলাকা বাসীর পক্ষে), গোবরা, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী।

উত্তরঃ সৃষ্টির আদিকাল থেকে হক্ ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলে আসছে। আর এই বাতিলপন্থী ইহুদী-খ্রীস্টান তথা ইসলাম বিরোধীরা ইসলামকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে নানাবিধ চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে ইসলামকে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করতে সর্বাÍক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে সদা-সর্বদা। তারা সরাসরি ইসলামের সাথে মোকাবেলা করার সাহস না পেয়ে বিভিন্ন কূটকৌশল ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে যুগে যুগে, আবিস্কার করেছে বিভিন্ন মতবাদ ও ফিরকার। যেমন শিয়া, কাদিয়ানী, বাহাই, রেযাখানী, আগাখানী প্রভৃতি।

এসব মতবাদগুলোকে যদিও ইসলামের রূপ দিয়ে প্রকাশ-প্রচার করা হয়েছে কিন্তু এগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য আল্লাহ্র মনোনীত ইসলামের প্রচার-প্রসার নয়, বরং মূলতঃ এসবের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইসলামকে ধ্বংস করা। মুনাফিকের চরিত্র ধারণ করে এসব মতবাদের জন্ম।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে প্রকাশ্য কাফিররা ইসলামের যতটুকু ক্ষতিসাধন করেছিল, মুনাফিকরা তার চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি সাধন করেছিল। কারণ, এদের বহিঃরূপ ছিল মুসলমানের, আর ভেতরের রূপ ছিল কাফির, মুশরিক ও ইহুদী-খ্রীস্টানের। একারণেই বর্তমান কালের ইহুদী-খ্রীস্টানরা যুগ-যুগান্তরের সেই মুনাফিক চরিত্রের একদল লোককে তৈরী করেছে ইসলামের ক্ষতি সাধন করার মানসে। যারা প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচারক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে কিন্তু অন্তঃকরণে এরা করে ইহুদী-খ্রীস্টানদের দালালী।

আর এই দালালীর বিনিময়ে এরা পাচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ-সম্পদ। এসব ভ্রান্ত দলগুলোরই একটি হচ্ছে নব আবির্ভত ‘হিযবুত তাওহীদ’ নামক দল।

দলটির প্রতিষ্ঠাতা বায়েযিদ খান পন্নী’র লিখিত “এই ইসলাম ইসলামই নয়” ও “যুগ সন্ধিক্ষণে আমরা” বই দুইটির বিভিন্ন অংশ পড়ে আমরা যা বুঝতে পেরেছি, তা হচ্ছে- এই দলটি আসলেই একটি ভ্রান্ত ও বাতিল দল। যা ইসলামের ক্ষতি সাধন করার লক্ষ্যেই ইসলামের নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। দলটির প্রতিষ্ঠা বায়েযিদ খান পন্নী মূলত একজন নাস্তিক ও মুরতাদ এবং ইহুদী-খ্রীস্টানদের দালাল, একথা প্রমাণিত। যদিও লেখক তার বই দুটোর বিভিন্ন অংশে ইহুদী-খ্রীস্টানদের বিরোধিতা করেছে, এটাও তার এক প্রকার ছলনা ছাড়া কিছুই নয়।

আরও পড়তে পারেন-

এই আশঙ্কাও রয়েছে যে, ‘হিযবুত তাওহীদ’ প্রধান কাফির শিয়া সম্প্রদায়ের লেলিয়ে দেওয়া দালাল। ইহুদী-খ্রীস্টানদের মত শিয়ারাও ইসলামকে ধ্বংস করার সুদর প্রসারী চক্রান্তে প্রতিনিয়ত লিপ্ত। এজন্য তারা অকৃপণ হস্তে অঢেল অর্থসম্পদ ব্যয় করে যাচ্ছে। এই মুরতাদ হয়তো অঢেল অর্থসম্পদ প্রাপ্তির লোভে পড়ে সাধারণ মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা ধ্বংস করার জন্য তাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এক নতুন ইসলাম আবিস্কার করে ‘হিযবুত তাওহীদ’ নামক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছে। নামে যদিও দলটি ইসলামী, কিন্তু তার কর্মকাণ্ড হচ্ছে ইসলাম পরিপন্থী।

ইসলামের নাম ও রূপে আত্মপ্রকাশ করা এধরণের বাতিল ও ভ্রান্ত দলগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে যদিও কিছু সংখ্যক সরলমনা সাধারণ মুসলমানকে ধোঁকা দিয়ে তাদের দলভুক্ত করে নিতে সক্ষম হয়, কিন্তু উলামায়ে হক্ তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উলামায়ে কিরাম যখন তাদের আসল রূপ মুসলমানদের সামনে তুলে ধরেন, তখন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে তাদের আসল উদ্দেশ্য কি? নিুোক্ত হাদীসের মাধ্যমে স্বকথিত ‘হিয্বুত্ তাওহীদ’র পরিচয় জানা যেতে পারে।

হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- আখেরী যামানায় মিথ্যুক বিভ্রান্তকারী কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা তোমাদেরকে এমন সব কথাবার্তা শোনাবে এবং এমন কিছু মতাদর্শ প্রচার করবে যা তোমরাও কোন দিন শুননি এবং তোমাদের পূর্ববর্তী (সাহাবা, তাবিঈন)গণও শুনেন নি। সাবধান! তোমরা তাদের (ধোঁকা) থেকে বেঁচে থাকবে। যদি তাদের প্রতারণা ও ছলনা থেকে বেঁচে থাকো, তাহলে তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট ও ফিতনাগ্রস্ত করতে পারবে না।

উক্ত হাদীসের টিকায় মিরক্বাত শরীফের (১/৩৯০) বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে- হাদীসে দাজ্জালের কথা বলা হয়েছে। এখানে দাজ্জাল অর্থ বিভ্রান্তকারী, চক্রান্তকারী ও ধোঁকাবাজ। এরা মানুষের কাছে এসে বলবে, আমরা ইসলামের পণ্ডিত ও বুযুর্গ, তোমাদেরকে সঠিক ইসলামের দিকে আহ্বান করছি। কিন্তু আসলে তারা মিথ্যাবাদী। তারা এমন সব আজগুবি ও ভ্রান্ত কথাবার্তা, হুকুম-আহ্কাম ও আক্বীদা-বিশ্বাস বর্ণনা করবে, যা তোমরা নিজেরা কোনদিন শুননি। এমনকি তোমাদের পূর্ববর্তী সাহাবা, তাবিঈনগণও কখনো শুনেননি। (মিশকাত শরীফ- ১/২৮)।

উল্লিখি হাদীসের আলোকে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ হয় যে, তথাকথিত বায়েযিদ খান পন্নী সেই দাজ্জাল তথা বিভ্রান্তকারী, চক্রান্তকারী ও ধোঁকাবাজদের একজন। যাদের কথা চৌদ্দশত বছর পূর্বেই রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন। বায়েযিদ খান পন্নী ও তার দলের পরিচয় এবং পরিণতি কি; তা উক্ত হাদীসের আলোকে সহজেই অনুমেয়।

হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- আমার উম্মতের ঐক্য কখনো ভ্রান্তি ও গোমরাহীর উপর হবে না। কারণ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উপর আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ রহ্মত রয়েছে। আর এই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত থেকে যে পৃথক হয়ে যাবে, সে জাহান্নামে পতিত হবে। (তিরমিযী শরীফ-২/৩৯)।

অন্যত্র ইরশাদ করেন- তোমরা বড় জামাআত অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসরণ কর। কেননা, যে ব্যক্তি এই জামাআত থেকে পৃথক হয়ে যাবে সে জাহান্নামে পতিত হবে। (মিশকাত শরীফ-১/২৮)।

উল্লিখিত হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, গোটা উম্মত কখনো ভ্রান্তি ও গোমরাহীর উপর ঐক্যবদ্ধ হবে না। অথচ মুরতাদ বায়েযিদ খান পন্নী বলছে, “সকল মানুষ গোমরাহীর মধ্যে আছে। তারা যে ইসলামের কথা বলছে সে ইসলাম- ইসলামই নয়। বরং আমার হিয্বুত্ তাওহীদে যোগদান না করলে কাফির হয়ে যাবে”। প্রমাণিত হলো তার এ দাবী সম্পূর্ণ হাদীস তথা ইসলাম বিরোধী। আর এই ভ্রান্ত মতবাদ প্রচারকারী ও উম্মতের মধ্যে বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারীর পরিণাম এবং যারা তার দলভুক্ত হয়ে এসব ইসলাম বিরোধী আক্বীদা-বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে, তাদের পরিণাম কি হবে, আশাকরি তা সকলের কাছে দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার হয়ে গেছে। এই লোকের অন্যান্য ভ্রান্ত আক্বীদা ও দাবীগুলোর খণ্ডন এ স্বল্প-পরিসরে সম্ভব নয় বিধায় কেবল দলীল-প্রমাণের উদ্ধৃতিসমূহ উল্লেখ করে ক্ষান্ত হচ্ছি।

সূত্র- সূরা মায়েদা- ৩, সূরা জুম্আ- ৯, সূরা ইমরান- ১৭৫, সূরা বাক্বারাহ- ২৬৮, সূরা আ’রাফ- ১৬, সূরা আন্আম- ৪৩, তাফ্সীরে রূহুল মাআনী-১৪/১০০, ১০২, তাফ্সীরে কুরতুবী-১/৩০৮, মুসলিম শরীফ-১/১২৯, তিরমিযী শরীফ-১/২৯৪, ৩০৮, আল্ মাওছআতুল ফিক্বহিয়্যা-২৭/১৯৩, ১৯৫-১৯৭, ২৪০, ৩১/১১৪, হিদায়া-১/১৪৬, হালবী কাবীর-৫৬৬ পৃঃ, জাওয়াহির€ল ফিক্বাহ্-১/২৬, ৩০, ফাতওয়ায়ে শামী-৩/৪৫৮ প্রভৃতি।

উত্তর দিয়েছেন- আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন

মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসীর ও সহকারী পরিচালক-
জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।