।। হামিদ মীর ।।
অনেক দিন আগে আমেরিকার লাসভেগাস শহরে ইসলামি উগ্রবাদ বিষয়ে এক সেমিনারে কিছু ইসলামবিরোধী উদ্ধত মারমুখী ব্যক্তির মুখোমুখি হয়েছিলাম। ওই সেমিনারে ইসলামকে উগ্র ও অসহিষ্ণু ধর্ম হিসেবে অভিহিতকারীদের মধ্যে সবার আগে ছিল রবার্ট স্পন্সর, যে কিনা ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর বিরুদ্ধে বই লিখে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করেছিল। সেমিনার ছিল উগ্রবাদের বিরুদ্ধে, অথচ রবার্ট স্পন্সরের পুরো বক্তব্য ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে। সুতরাং আমাকে আমার বক্তৃতায় ইসলাম ধর্মের ওপর কৃত অভিযোগগুলোর বিস্তারিত জবাব দিতে হয়। আমি স্বল্পজ্ঞানের অধিকারী হয়েও রবার্ট স্পন্সরকে মিথ্যা প্রমাণিত করলাম। কিছু স্থানীয় টিভি চ্যানেল সেমিনার যথাযথ প্রচার করে।
এ প্রচারের ফলে আমেরিকার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও দফতর থেকে লেকচারের নিমন্ত্রণ আসে। আমি যেখানেই গেছি, সেখানেই বেশির ভাগ নারী ইসলামে নারীর অধিকার সম্পর্কে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেছেন। আত্মসম্মানবোধের নামে হত্যা, জোরজবরদস্তিমূলক বিয়ে, নারীশিক্ষা ও রোজগার করার ওপর বিধিনিষেধ সম্পর্কে পাশ্চাত্য মিডিয়ায় প্রচার করা সংবাদ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয়। ওইসব প্রশ্নের জবাবে এ অধম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হযরত খাদিজা (রাযি.)এর ঈমান ও বিশ্বস্ততা এবং হযরত আয়েশা (রাযি.)এর জ্ঞানগরিমার দৃষ্টান্ত পেশ করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হয়েছি।
যখন আমি এ কথা বললাম, আমাদের প্রিয়নবী (সা.)এর প্রথম স্ত্রী হযরত খাদিজা (রাযি.) একজন মহিলা ব্যবসায়ী ছিলেন। ইতিপূর্বে তাঁর দু’বার বিয়ে হয়েছিল। আগের স্বামীর তিন সন্তানের জননী ছিলেন। বয়সেও বড় ছিলেন। তা সত্ত্বেও হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর সাথে তাঁর দাম্পত্য জীবন সফল ও সুখকর ছিল। তার জীবদ্দশায় নবী কারীম (সা.) দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। তখন প্রশ্নকারীরা আরো জানার জন্য এ সংক্রান্ত গ্রন্থ সম্পর্কে জানতে চান। এ অধম তখন মুহাম্মদ হুসাইন হায়কাল, মার্টিন লিংস ও ক্যারন আর্মস্ট্রংয়ের নবী কারিম (সা.)এর ওপর লিখিত গ্রন্থগুলোর উদ্ধৃতি পেশ করি। যখন মুহাম্মদ ডোগার সাহেবের রচনা আল আমিন আমার নজরে পড়ল, তখন আরো বেশি জানার আগ্রহ সৃষ্টি হলো।
আল্লামা শিবলী নোমানী ও আল্লামা সাইয়েদ সুলাইমান নদভীর সীরাতুন্নবী গ্রন্থে পড়েছি, হযরত খাদিজা (রাযি.)এর পিতা আগেই ইন্তেকাল করেছিলেন। তবে তার চাচা আমর বিন আসাদ বেঁচেছিলেন। হযরত খাদিজা (রাযি.) চাচা থাকা সত্ত্বেও নবী করিম (সা.)এর কাছে বিয়ের পয়গাম নিজেই প্রেরণ করেছিলেন।
পীর মুহাম্মদ করমশাহ আল আজহারি তার জিয়াউন্নবী গ্রন্থে লিখেছেন, বিশ্বনবী (সা.)এর বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা হযরত খাদিজা (রাযি.)কে তার গুণগ্রাহী বানিয়ে দেয়। সুতরাং তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মতামত জানার জন্য অন্তরঙ্গ বান্ধবী নাফিসাকে তাঁর কাছে পাঠান। নাফিসা রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মতামত অবগত হন এবং ফিরে এসে হযরত খাদিজা (রাযি.)কে খোশখবর শোনান। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে দাওয়াত করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাশরিফ আনলেন। কথাবার্তা হলো।
উভয়ে রাজি হওয়ার পর হযরত খাদিজা (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কাছে আবেদন করেন, তিনি যেন তাঁর চাচা আবু তালেবকে তার কাছে পাঠিয়ে দেন। চাচা আবু তালেব পরের দিন হযরত খাদিজা (রাযি.)িএর কাছে গেলে তিনি তার কাছে অনুরোধ করেন, আপনি আমার চাচার কাছে গিয়ে আমার সাথে আপনার ভাতিজার বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করুন। এভাবে পাত্রপাত্রীর মুরব্বিদের অনুমতিতে বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। অপর কিছু গ্রন্থেও এ বর্ণনা বিদ্যমান রয়েছে। হযরত খাদিজা (রাযি.)এর জীবন ও কর্মের আলোকে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা ও ওপরে তুলে ধরা আরো বেশি সহজ হয়ে গেছে।
কিছু দিন আগে ইসলামি নজরিয়্যাতি কাউন্সিলরের সদস্য ও জামায়াতে ইসলামি পাকিস্তানের ওমেন অ্যান্ড ফ্যামিলি কমিশনের প্রেসিডেন্ট ড. সাবিহা রাহিল কাজী তার এক পত্রের সাথে আমাকে জুবায়ের মানসুরির হযরত খাদিজা (রাযি.): ঈমান ওয়া ওয়াফা কি সাথী (হযরত খাদিজা (রাযি.): ঈমান ও বিশ্বস্ততার সঙ্গী) গ্রন্থটি প্রেরণ করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (রাযি.)এর ভূমিকা সবার সামনে তুলে ধরা। ওই গ্রন্থেও এ কথা লেখা আছে, হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর সাথে হযরত খাদিজা (রাযি.)এর বিয়ের কথাবার্তা নাফিসার মাধ্যমে শুরু হয়। অতঃপর বড়রা কথাবার্তাকে এগিয়ে নিয়ে যান। এ ঘটনা এবং অপর কিছু হাদিস এ কথা প্রমাণ করে যে, ইসলামে পছন্দের বিয়ে নিষেধ নয়।
এ জন্য ২০১৬ সালের ১৬ জুন আমি আমার অপর এক কলামে এ কথা লিখেছিলাম যে, হযরত খাদিজা (রাযি.) তার বান্ধবী নাফিসার মাধ্যমে নবী কারিম (সা.)এর মতামত জানেন। অতঃপর উভয় পরিবারের বড়রা বিয়ের বন্দোবস্ত করেন। এটাকে পছন্দের বিয়ে অভিহিত করেছি। কিছু ব্যক্তি এ বিষয়ে তাদের অমনঃপুতের কথা প্রকাশ করেছেন এবং উল্লেখিত কলামকে ঘর থেকে পালানো মেয়েদের সহায়তাকারী বলে অভিহিত করেছেন। আপত্তিকারীদের প্রতি অনুরোধ, কলামের শিরোনাম লক্ষ্য করুন। মূলত ‘মেকি আত্মসম্মানবোধ’ শিরোনামের এ কলাম ছিল বোন ও কন্যাদের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে। ওই কলামে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের আলোকে বলা হয়েছে, একজন বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক বালেগ মুসলমান নারী তার পছন্দমতো বিয়ের অধিকার রাখেন। সুপ্রিম কোর্টের এ রায় সায়েমা নামের এক নারী ও আরশাদ নামের এক যুবকের বিয়ে সম্পর্কে ছিল। সায়েমা ঘর থেকে পালিয়ে বিয়ে করেননি।
তার পিতা কন্যাকে তার অমতে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। জোরজবরদস্তিমূলক বিয়ে থেকে বাঁচার জন্য সায়েমা পাঁচজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে আরশাদকে বিয়ে করেন। এরপর তিনি স্বীয় পিতার ঘরে ফিরে যান। মাকে বিয়ের কথা জানানোর পর সায়েমাকে নির্যাতন ভোগ করতে হয়। আমার কলাম নারী নির্যাতন ও তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে ছিল। হযরত খাদিজা (রাযি.)এর উদাহরণ পেশ করার কারণ শুধু এটাই ছিল যে, আমি উম্মুল মুমিনিন খাদিজা (রাযি.)কে মুসলিম নারীদের জন্য রোলমডেল মনে করি। তিনি ইসলামের প্রথম নারী। তিনি প্রতিটি কঠিন সময়ে স্বামী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর পাশে ছিলেন।
আমি স্পষ্টত: লিখেছি যে, নবী কারিম (সা.)কে পছন্দ করা এবং তার মতামত জানার পর উভয় পরিবারের বড়রা বিয়ের কার্যক্রম চূড়ান্ত করেন। ১৬ জুনের কলাম নিয়ে একটি পত্রিকা কিছু বিরোধিতামূলক বক্তব্য প্রকাশ করলে অনেক বিজ্ঞ আলেম আমার সাথে যোগাযোগ করেন এবং পরিপূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তবে ওইসব আলেমকে এক অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে জড়িয়ে পড়া থেকে দূরে থাকতে বললাম। আমার আবেদন, যদি কারো কোনো মতবিরোধ থাকে, তাহলে এ বিষয়ে যৌক্তিক আলোচনা ও তথ্যনির্ভর যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ রাখা উচিত। একজন আরেকজনের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়াতে কোনো ফায়দা নেই। ফায়দা সেই উঠাবে, যে ইসলামের বদনাম করতে চায়।
আপনি আব্দুল মালেক মুজাহিদের বেশ সুন্দর গ্রন্থ হযরত খাদিজা (রাযি.) কি যিন্দেগি কে সুনাহরি ওয়াকিয়াত (হযরত খাদিজা (রাযি.)এর জীবনের সোনালি ঘটনাবলী) পড়ুন অথবা ড. মুহাম্মদ আজম রেজা তাবাসসুমের গ্রন্থ খাদিজাতুল কুবরা অধ্যয়ন করুন। আপনি জানতে পারবেন, উম্মুল মুমিনিন খাদিজা (রাযি.) তাঁর সব কিছু আল্লাহর রাসূল (সা.)এর কাছে কোরবান করে দিয়েছিলেন। জীবনের শেষ তিনটি বছর মক্কার বাইরে গারে হেরা তথা হেরা গুহার সন্নিকটে পাহাড়ি উপত্যকা শেয়াবে আবি তালিবে ক্ষুৎ-পিপাসায় দিন অতিবাহিত করেন। ৬৫ বছর বয়সে রমজানুল মোবারকে তার ইন্তেকাল হয়। হযরত আয়েশা (রাযি.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) তার প্রথম বিবিকে বেশ সুন্দর শব্দ দিয়ে স্মরণ করতেন।
এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, নবী করিম (সা.)এর সব সন্তান হযরত খাদিজা (রাযি.)এর গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেন। দুই পুত্র হায়াত লাভ করেননি। চার কন্যা ছিলেন পিতার চক্ষুশীতল নয়নমণি। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের সন্তানদের পাশাপাশি হযরত খাদিজা (রাযি.)এর প্রাক্তন স্বামীর সন্তানদেরকেও বুকে আগলে রেখেছিলেন। স্বীয় কন্যাদের খুব ভালোবাসতেন। কন্যা সাইয়েদা জয়নাব (রাযি.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সফরের প্রাক্কালে হাব্বার বিন আসওয়াদ তার ওপর আক্রমণ করে বসে। জয়নাব (রাযি.) উট থেকে পড়ে গিয়ে আহত হন (ওই সময় তিনি গর্ভবতী ছিলেন)। তার দেবর তাকে উদ্ধার করেন। কন্যার ওপর আক্রমণের খবর শুনে নবী করিম (সা.) খুব কষ্ট পান। আবু হুরায়রা (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে (তাদের বিরুদ্ধে) অভিযানে প্রেরণ করে বললেন, যদি অমুক অমুককে পেয়ে যাও, তাহলে তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারবে।
যখন সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) রওনা হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কাছে বিদায় নিতে গেলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের অমুক অমুককে আগুনে পুড়িয়ে মারার আদেশ করেছিলাম, তবে আগুনের শাস্তি আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না, এ জন্য যদি তোমরা তাদের পেয়ে যাও, তাহলে তাদেরকে তলোয়ার দিয়ে হত্যা করবে।
এ কথাগুলো লিখে এটাই নিবেদন করতে চাই যে, আল্লাহর পেয়ারা নবী (সা.) স্বীয় কন্যার ওপর আক্রমণকারীদের আগুনে পুড়িয়ে মারার আদেশ ফিরিয়ে নিয়েছেন, আর আমাদের সমাজে নিজের মেয়েকেই পুড়িয়ে মারার ঘটনা রীতিমতো অব্যাহত রয়েছে। মেয়েদের পুড়িয়ে মারা ও আত্মসম্মানবোধের নামে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন এবং বিশ্বকে জানান, আসল ইসলাম উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসীদের নয়, আসল ইসলাম হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর, যার ওপর সর্বপ্রথম একজন নারী ঈমান এনেছেন এবং ওই মহীয়সী নারীকেও খাতুনে জান্নাত আখ্যায়িত করা হয়েছে।
[পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং এ প্রকাশিত ইংরেজি নিবন্ধ ভাষান্তর করেছেন ইমতিয়াজ বিন মাহতাব; ahmadimtiajdr@gmail.com ]
– হামিদ মীর, পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক।