।। আবু তালহা তোফায়েল ।।
মুসলিম উম্মাহর জীবনে প্রতিবছর রামাজান আসে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে। করোনা-অমিক্রণের এই বিপর্যস্তে পবিত্র মাহে রামাজান আমাদের মাঝে এসেছে। কষ্ট ও পেরেশানির এই দুর্দিনে রামাজান নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের তরফ থেকে এক বড় নেয়ামত।
মুমিনের জীবনে রামাজান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসে সে তার পুরো বছরের পুঁজি সংগ্রহ করে। অতীতের সব গুনাহ থেকে তাওবা করে নতুন জীবনের শপথ গ্রহণ করে। তাই খুব সতর্কতার সাথে, হিসেব করে, পরিকল্পনা মাফিক এই মাস অতিবাহিত করতে না পারলে কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করা যায় না, উপকৃত হওয়া যায় না রামাজানে আসমানী বরকত থেকে।
তাই রামাজানের ২৪ ঘন্টা কীভাবে কাটাবেন? কীভাবে মহিমান্বিত এই মাসের সমটা কাজে লাগাতে পারব?
রাতে তারাবি আদায় করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ুন, অনর্গল গল্পগুজব করে সময় নষ্ট করবেন না। আর শেষ রাতে সেহরি খাওয়ার জন্য একটু তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন যাহাতে কমপক্ষে ৪ রাকাত তাহাজ্জুদ আদায় করা যায়। দোয়া করুন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য ও মুসলিম উম্মাহর জন্য। পাপের কথা স্মরণ করে অশ্রু ফেলে দোয়া করুন, রোনাজারি করুন।
সুনানে তিরমিজিতে বর্ণিত, “জাহান্নামের আগুন দুটি চোখকে স্পর্শ করবে না, যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে এবং যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় পাহারা দিয়ে নির্ঘুম রাত যাপন করে।” (তিরমিযী, ১৬৩৯)।
সাহরি শেষে খাওয়া সুন্নত। তাই শেষ সময়ে সাহরি খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
রামাজানের গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো পাঁচ ওয়াক্তের সালাত গুরুত্ব সহকারে জামাতে আদায় করা। এক ওয়াক্তও যেনো জামাত না ছুটে, যদি এইমাসে জামাতে নামাজ আদায় করার অভ্যাস গড়ে উঠে, তাহলে এটিই হবে রামাজানে আপনার শ্রেষ্ঠ পাওয়া।
ফজরের সালাতের পর সাথে সাথে না ঘুমানো ভালো, কেননা এই সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতময়। সম্ভব হলে জিকির-আযকার ও তেলাওয়াত করে একেবারে ইশরাকের সালাত আদায় করে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ও দিন মিলিয়ে ৬-৭ ঘন্টা ঘুমালেই যথেষ্ট। রামাজানের প্রতিটি সময়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিটি সময় থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করুন।
আর রামাজান যেহেতু কুরআন নাজিলের মাস, তাই পুরো রমজানে অন্তত এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করুন। প্রতিদিন কমপক্ষে এক পারা কুরআন তেলাওয়াত করুন এবং একটা টাইম সেট করে রাখুন। অনেক ভাই আছেন কুরআন তেলাওয়াত করতে পারেন না। এটা তাদের দ্বীনের প্রতি অনেক বড় একটা অবহেলা, রামাজান তাদের জন্য অনেক বড় একটা সুযোগ। কোনো উস্তাদ ধরে এই রামাজানে কুরআন শিখে নেই। প্রাথমিকভাবে অন্তত ১০টি সূরা বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করা শিখে নেই, যাতে সালাত আদায় করতে পারি।
আর সময়গুলোকে বিভিন্নভাবে ভাগ করে নেই বিভিন্ন ধরনের আমলের জন্য। কিছুক্ষণ তেলাওয়াত করুন, কিছুক্ষণ কুরআনের তর্জমা ও তাফসির অধ্যয়ন করুন, কিছুক্ষণ সময় দ্বীনি কিতাবাদী পড়ুন, বেশী ক্লান্ত হয়ে পড়লে নির্ভরযোগ্য শায়েখদের লেকচার শুনুন।
খেয়াল রাখবেন রামাজানের একটি মুহুর্তও যেনো অনর্থক ও বরবাদ না হয়। সম্ভব হলে এবং একান্ত প্রয়োজন না হলে রামাজান উপলক্ষে ইন্টারনেট ইউজ করা একেবারে ছেড়ে দিন। ফেইসবুক, ইউটিউব ও ইন্টারনেট আসক্তি আপনার সময়কে নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুক। আমিন।
আরও পড়তে পারেন-
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
- উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য হুমকি
- ‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ
- মৃত্যুর স্মরণ জীবনের গতিপথ বদলে দেয়
- যে কারণে হিন্দুত্ববাদের নতুন নিশানা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’
জবানের হেফাজত করুন৷ মিথ্যা, গীবত, চোগলখোরি ও পরনিন্দার মতো জঘন্য গোনাহ থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। এসবের কারণে আপনি সাওমের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবেন।
সহিহ বুখারীতে এসেছে, “যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।” (বুখারী- ১৯০৩)।
রামাজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো ‘সাদাক্বাহ’। আশপাশের এতিম মিসকিনদের খোঁজখবর নিন, তাদেরকে সাধ্যমতো সাহায্য করুন। তারা যেন সুন্দরভাবে সাওমগুলো আদায় করতে পারে।
সহিহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, “হযরত আব্বাস রা. বলেন, “রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বাধিক দানশীল। রামাজান মাসে তার দানশীলতা অন্যান্য মাসের চেয়ে বেড়ে যেত।” ( বুখারী- ৬, মুসলিম- ২৩০৮)।
আসরের পরের সময়টি দোয়া, তেলাওয়াত ও জিকির-আযকার করে কাটান। ইফতার প্রস্তুতিতে সময় নিতে পারেন এবং সময় হলেই ইফতার করে নিন। ইফতার দেরি না করা সুন্নাহ। মাগরিবের সালাতের পর পরিবারের মানুষের সাথে দ্বীনি আলোচনা করে নিন। ফাজায়েলে আমাল ও জাতীয় ইত্যাদি কিতাবাদী থেকে তা’লীমও করতে পারেন অথবা অন্য কোনো ইবাদাতও করতে পারেন। তারপর যথারীতি এশার সালাত ও তারাবী আদায় করুন।
রামাজানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো তাওবা ও ইস্তেগফার। পুরো রামাজান জুড়েই আপনার চিন্তা থাকবে, কীভাবে অতীতের গুনাহ মাফ করানো যায়। রামাজান পেয়েও যে নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, তার ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদ দোয়া করেছেন; তাই আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে।
প্রিয় পাঠক! উল্লেখিত নীতিমালা অনুযায়ী ২৪ ঘন্টার একটি রুটিন তৈরি করে নিন এইমাসে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অনেক মুমিনকে ক্ষমা করে দিবেন, সুনানে তিরমিজিতে একটি সহীহ হাদিস এসেছে, রামাজানের প্রথম রাত যখন শুরু হয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, “হে কল্যাণ প্রত্যাশী, কল্যাণের দিকে অগ্রসর হও। হে গুনাহের ইচ্ছা পোষণকারী, গুনাহ থেকে বিরত হও। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে এইমাসে জাহান্নাম থেকে বহু লোককে মুক্তি দেওয়া হয়।”
প্রিয় পাঠক! আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতে হবে, আল্লাহর সৌভাগ্যবান মুক্তিপ্রাপ্ত বান্দাদের তালিকায় আল্লাহ যেনো আমাদের নামটি অন্তর্ভুক্ত করেন। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে আমল করার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক: সাংবাদিক।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ