Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ সুনানে আবু দাঊদ প্রসঙ্গে আকাবিরে দেওবন্দের উপর উত্থাপিত আপত্তির অপনোদন

সুনানে আবু দাঊদ প্রসঙ্গে আকাবিরে দেওবন্দের উপর উত্থাপিত আপত্তির অপনোদন

।। আল্লামা ফোরকান আহমদ সাতকানভী ।।

আল্লামা কাজী শাওকানী (রহ.) নামাযে হাত বাঁধা প্রসঙ্গে প্রসিদ্ধ তিনটি মত উল্লেখ করেছেন-
১. হানাফিদের মতে নাভির নিচে হাত বাঁধা।
২. শাফিঈদের মতে বুকের নিচে ও নাভির উপর হাত বাঁধা।
৩. মালেকিদের মতে হাত স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া।

উল্লিখিত তিনটি মতের বিপরীতে বুকের উপর হাত বাঁধা প্রসঙ্গে ভিন্ন কোনো প্রামাণ্য মত নেই। তা সত্ত্বেও কেউ যদি বুকের উপর হাত বাঁধাকে মুস্তাহাব বলতে চায়, তবে তা সকল ইমাম এবং উম্মতের ইজমা পরিপন্থী মত হিসেবে গণ্য হবে। (বাযলুল মাজহুদ, ৪/১১২-১১৩, শরহু সুনানি আবি দাউদ লিল আইনী- ৩/৩৫৩, ৩৫৭)।

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) তিনটি হাদীসের আলোকে উক্ত মতটি অবলম্বন করেছেন।
১. তাউস (রহ.)এর মুরসাল রিওয়ায়াত।
২. হালব (রহ.)এর হাদীস।
৩. ওয়াইল বিন হুজরে’র হাদীস।

যেগুলো ইমাম ইবনে খুযাইমা (রহ.) স্বীয় কিতাব ‘সহীহ ইবনে খুযাইমা’তে উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু কাজী শাওকানী (রহ.) এই তিনটি হাদীসের উপর এই বলে আপত্তি করেছেন যে, উপরোল্লিখিত তিন হাদীসে বুকের উপর হাত বাঁধার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। অথচ শাফিঈদের মতে বুকের নিচে হাত বাঁধা মুস্তাহাব। (বাযলুল মাজহুদ, ৪/১১২ মাকতাবায়ে ইউ.পি, ইন্ডিয়া)।

তবুও আউনুল মা’বুদের গ্রন্থকার আল্লামা শামসুল হক আজিমাবাদী (রহ.) শাফেঈদের মতকে সঠিক মত বলে আখ্যা দিয়েছেন। (আউনুল মাবুদ- ২/১৪১, মাকতাবায়ে দারুল হাদীস, কায়রো)।

হানাফী মাযহাবের ইমামগণ নাভীর নিচে হাত বাঁধা মুস্তাহাব প্রমাণ করার জন্য ছয়টি হাদীস দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে নিম্নোক্ত তিনটি হাদীস আবু দাউদ শরীফের কিছু নুসখাতে পাওয়া যায়।

(১) হযরত আবু জুহাইফার সূত্রে আলী (রাযি.)এর রিওয়ায়াত-

من السنة: وضع الكف على الكف في الصلاة تحت السرة.

অর্থাৎ- “নামাযে এক হাতের তালু অপর হাতের উপর রেখে নাভির নিচে বাঁধা সুন্নাত”। (বাযলুল মাজহুদ, হাদিস নং- ৭৫৪, আওনুল মা’বূদ, হাদিস নং- ৭৫২)।

(২) হযরত জারির দাব্বী (রহ.)এর রিওয়ায়াত-

رأيت عليا رض. يمسك شماله بيمينه على الرسغ فوق السرة، قال أبو داود: وروي عن سعيد بن جبير: “فوق السرة”، وقال أبو مجلز: “تحت السرة”، وروي عن أبي هريرة رض. وليس بالقوي”

অনুবাদ- “একদা আমি হযরত আলী (রাযি.)কে স্বীয় বাম হাতের কব্জি ডান হাত দ্বারা ধরে নাভির উপর রাখতে দেখলাম”।

ইমাম আবু দাউদ (রহ.) বলেন, এই হাদীসে সাঈদ বিন জুবাইর থেকেও নাভির উপর হাত বাঁধার কথা এসেছে।

তবে আবু মিজলায ও আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে নাভির নিচে হাত বাঁধার কথা এসেছে। কিন্তু আবু হুরায়রা (রাযি.)এর হাদীসটি দুর্বল সূত্রে প্রমাণিত। (বাজলুল মাজহুদ- ৪, হাদীস নং- ৭৫৫, আউনুল মাবূদ- ২, হাদীস নং- ৭৫৩)।

(৩) আবু ওয়াইলের সূত্রে হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত রিওয়ায়াত-

أخذ الأكف على الأكف في الصلاة تحت السرة

অর্থাৎ- নামাযে এক হাতের তালু অপর হাতের তালুর উপর রেখে নাভির নিচে হাত বাঁধা। (বাযলুল মাজহুদ- ৪, হাদীস নং- ৭৫২, আউনুল মাবূদ- ২, হাদীস নং- ৭৫৪)।

অনুরূপভাবে তাঊস (রহ.) থেকে মুরসাল হিসেবে বাযলুল মাজহুদ (৪/১১০) ও ‘আউনুল মাবূদ (২/১৪২) গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে-

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يضع يده اليمنى على يده اليسرى، ثم يشد بينهما على صدره وهو في الصلاة

অর্থ- রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাযে নিজের ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে উভয় হাতকে শক্তভাবে বুকে বাঁধতেন। (বাযলুল মাজহুদ- ৪, হাদিস নং- ৭৫৭ , ‘আউনুল মা’বূদ- ২, হাদিস নং- ৭৫৫)।

উপরোল্লিখিত হাদীস ও উদ্ধৃতিসমূহের আলোকে পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আবু দাউদ শরীফের বিশ্ববিখ্যাত এই দুই ব্যাখ্যাগ্রন্থে আপত্তিকারিদের চারটি হাদীসের আলোচনাই এসে গেছে। এবং উভয় ব্যাখ্যাকার নিজ নিজ গ্রন্থে স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে হাদিসগুলোর বিশ্লেষণ করেছেন। (বাজলুল মাজহুদ- ৪/১০০-১১৬, ‘আউনুল মাবূদ- ২/১৩৬-১৪২)।

আরও পড়তে পারেন-

সুতরাং যে আপত্তি ও অভিযোগ আমাদের কিছু কিছু ভাইয়েরা হানাফিদের উপর করেছে, সেটা তো তাঊসের রিওয়ায়াত তথা শাফিঈদের দলীলের উপরও বর্তায়। কবি চমৎকার বলেছেন-

حملہ بر خود میكنى اےسادہ مرد ہمچوں آں شیرے کہ بر خود حملہ کرد

তাই উভয় মাযহাবের ইমামগণ এ মাসআলায় মুস্তাহাবের মত অবলম্বন করেছেন। ফরয, ওয়াজিব, কিংবা সুন্নাতের মত অবলম্বন করেননি। কেননা ফুকাহায়ে কেরাম সর্বদা হাদীস বা দলীলের স্তর অনুযায়ী হুকুম নির্ণয় করে থাকেন। যেন কোনো হাদীসের উপর আমল ছুটে না যায় এবং কোনো হাদীসকে যেন অস্বীকার করা না হয়। দুর্বল বাচ্চাকে যেমন দূর্বল দেখে ফেলে দেওয়া যায় না, অনুরূপ দুর্বল হাদীসকেও দূর্বল বলে বাদ দেওয়া যায় না।

তবুও ভুল বুঝাবুঝি, খারাপ ধারণা ও গালমন্দের মত মহাপাপ থেকে বেঁচে থাকার লক্ষ্যে, এশিয়া মহাদেশে প্রচলিত আবু দাঊদের নুসখাগুলোতে উল্লিখিত চারটি হাদীস না থাকার আসল রহস্য তুলে ধরা সমীচীন মনে করছি।

বাস্তবতা হলো, ইমাম আবু দাঊদ (রহ., জন্ম- ২০২, মৃত্যু- ২৭৫ হি.)এর যুগে মূদ্রণ ও ছাপার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বরং প্রত্যেক ছাত্র উস্তাদের দরসসমূহ স্বহস্তে লিখে ভিন্ন ভিন্ন নুসখা (পা-ুলিপী) তৈরি করতো। কিন্তু ইমাম আবু দাঊদ (রহ.)এর হাজার হাজার ছাত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁর সুনান গ্রন্থটি মাত্র চারজন ছাত্রের লিখিত নুসখায় ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে এবং অনেক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। যথা-

১. আবু বকর বিন দাসা’র নুসখা
২. আবু সাঈদ বিন আ’রাবী’র নুসখা
৩. আবু আলী লু’লুয়ী আল বসরীর নুসখা
৪. আবু ঈসা রমলীর নুসখা।

ইবনুল আ’রাবীর নুসখায় উল্লিখিত চারটি হাদিস থাকলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং হাদীস এই নুসখা থেকে বাদ পড়েছে। আল্লামা শামসুল হক আজীমাবাদী (রহ.) বলেন-

اعلم: أن رواية أبي هريرة وأثر أبي مجلز وأثر سعيد بن جبير ورواية علي -رضي الله عنهم- المذكورة في الباب، ليست إلا في نسخة ابن الأعرابي، ووجد في بعض نسخ الكتاب، وهكذا ما روي عن طاؤس. (عون المعبود ١۳۹ / ۲، وکذا في الصفحة الماضية في هامش البذل المجهود: ٤ / ۱۰۲-۱۱۰.)

قال المزي في “تحفة الأشراف”: هذه الاحاديث الاربعة في رواية أبي سعيد بن الأعرابي وغيره، ولم يذكرها أبو القاسم.

অনুবাদ: জরুরী জ্ঞ্যতব্য বিষয় হল, হযরত আবু হুরায়রা, মিজলায, সাঈদ বিন জুবাইর ও আলী (রাযি.)এর হাদীস, যা এই অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ইবনুল আ’রাবীর নুসখা ব্যতীত অন্য কোনো নুসখাতে পাওয়া যায় না। তাউস (রহ.)এর বর্ণিত হাদীসটিও অনুরূপ। (আউনুল মাবূদ- ২/১৩৯, বাযলুল মাজহুদ- ৪/১০২-১১১)।

ইমাম মিযযি (রহ.) ‘তুহফাতুল আশরাফ’ এ লিখেন- এই চারটি হাদীস ইবনুল আ’রাবীর নুসখাসহ বিভিন্ন নুছখাতে রয়েছে। কিন্তু আবুল কাসেম (রহ.)এর নুসখায় তা সংকলিত হয়নি।

আর আবু আলী লু’লুয়ী আল বসরীর নুসখা “আসাহহুর রিওয়ায়াত” তথা বিশুদ্ধতম বর্ণনা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। কেননা ইমাম আবু দাউদ (রহ.) শেষ বয়সে লু’লুয়ীর এই নুসখাটি ইমলা করিয়েছিলেন (লিখিয়েছিলেন)। এর কিছুদিন পর তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। যার দরুন ভিন্ন কোনো নুসখা ইমলা করানোর সুযোগ তাঁর হয়ে উঠেনি । তাই এই নুসখাটিকে “আসাহহুর রিওয়ায়াত” বলা হয়।

অন্যদিকে আবু বকর বিন দাসার নুসখাটি “আকমালুর রিওয়ায়াত” হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। আর আবু ঈসা রমলীর নুসখা এবং ইবনে দাসার নুসখা কাছাকাছি। অনুরূপ লু’লুয়ীর নুসখাও ইবনে দাসার নুসখার মতই।

শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) “বুসতানুল মুহাদ্দিসীন” এ লিখেছেন, আমাদের এশিয়া মহাদেশে “আসাহহুর রিওয়ায়াত” তথা লু’লুয়ীর নুসখা বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। আর পশ্চিমাবিশ্বে “আকমালুর রিওয়ায়াত” তথা আবু বকর বিন দাসার নুসখা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। আর তা আজ থেকে প্রায় এগার শতাব্দী পূর্বের ঘটনা ।

তৃতীয় শতাব্দির বিষয় নিয়ে পনেরো শতাব্দির আলেমদের উপর আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপন একগুঁয়েমি ও মূর্খতা বৈ আর কী হতে পারে!

আল্লামা আইনী (রহ.) তাঁর আবূ দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থে লিখেছেন-

وهذا الحديث ليس بموجود في غالب نسخة أبي داود، وإنما هو موجود في النسخة التي هى من رواية ابن داسة، ولذلك لم يعزه ابن عساكر في “الأطراف” إليه. شرح سنن أبي داود: ٣/٣٥٦، ط. مكتبة الرشيد.

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম মুহাদ্দিস শাইখ আওয়ামা (হাফি.) তাঁর কৃত আবূ দাউদের তাহকীকে (সুনানে আবূ দাউদ: ১/৬১০-৬১১, মাকতাবা: দারুল য়ুসর) এবং শাইখ শুআইব আরনাউত (রহ.) তাঁর আবূ দাউদের তাহকীকে (সুনানে আবূ দাউদ, ২/৬৮-৬৯, দারুর রিসালা আল আলামিয়্যা) এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

বস্তুত লু’লুয়ীর নুসখাতে এই চারটি হাদিস উল্লেখ না করাটাই ছিলো আমানতদারিতা। বরং এগুলো যোগ করে দেওয়া অনেকটা খিয়ানতের মতই ছিলো।

বস্তুত লু’লুয়ীর নুসখাতে এই চারটি হাদসি উল্লখে না করাটাই ছলিো আমানতদারতিা। বরং এগুলো যোগ করে দযে়া অনকেটা খযি়ানতরে মতই ছলিো। উল্লখ্যে এশযি়া মহাদশেে সমাদৃত আবু দাউদরে আহাদীসরে উপর যে সব উলামায়ে করোম ক্রমবন্যিাসরে কাজ করছেনে, লু’লুয়ীর নুসখা অনুসারে তাতে ক্রমবন্যিাস করা তাদরে আমানতদারি এবং দযি়ানত দারীতার দাবছিলিো। সাধারণ উলামায়ে করোমরে যনে এরূপ সন্দহেরে সম্মুখীন হতে না হয়। অতএব, ইচ্ছাকৃতভাবে যদি তারা এমনটি (চার হাদীসরে ক্রমকি বাদ দযি়ে সামনে থকেে ক্রমবন্যিাস) করে থাক, তবে এর জবাবদহিতিার জম্মিাদারওি তাদরে। আর অনচ্ছিাকৃতভাবে যদি এমনটি হয়ে থাকে তবে আল্লাহ তাআলা তাঁদরে ক্ষমা করবনে।

হ্যাঁ, শুরুহাতে উল্লেখ করে দেওয়াতে কোনো বাধা নেই। কেননা ব্যাখ্যাগ্রন্থ কখনোই মূল কিতাব নয়। সাধারণত ব্যাখ্যাগ্রন্থে আরও অনেক হাদিসও আনা হয়, যা মূল কিতাবে নেই।

তাছাড়া ব্যাখ্যাগ্রন্থ-টিকাতেও বলে দেয়া হয়েছে যে, উক্ত চারটি হাদীস এই নুসখার নয়। যেমনটি পূর্বের আলোচনা থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেছে।

নুসখার ভিন্নতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পূর্বোক্ত উদ্ধৃতি সমূহের পাশাপাশি ’আউনুল মা’বূদ, التنبيه الثالث في ذكر اختلاف النسخ অধ্যায়টিও দেখা যেতে পারে। (আউনুল মা’বূদ- ৮/৫০৭)।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সব বিষয়ের বাস্তবতা জেনে তা গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন; আমীন।

লেখক: মুহাদ্দিস, মুফাসসীর ও আবাসিক হল পরিচালক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।