Home ওপিনিয়ন বিজেপির মুসলিমবিদ্বেষী কর্মকান্ডের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ করা উচিত

বিজেপির মুসলিমবিদ্বেষী কর্মকান্ডের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ করা উচিত

।। মনোয়ারুল হক ।।

নূপুর শর্মা ও জিন্দাল এই দুই ব্যক্তির হযরত মোহাম্মদ (স) সম্পর্কিত বিতর্কিত মন্তব্যের পরে বিশ্বের মুসলিম সমাজ প্রতিবাদী হয়েছে । ৫৭ টি মুসলিম দেশের সংগঠন ওআইসি এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ওআইসির প্রতিবাদকে ভারতের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়নি বরঞ্চ তার বিরুদ্ধে একটি অতিরিক্ত মন্তব্যসহ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।

ওই দুই ব্যক্তির একজন নূপুর সর্বপ্রথম টেলিভিশন নেটওয়ার্কে মোহাম্মদ (স) সম্পর্কিত মিথ্যা এবং ভুল তথ্যের ভিত্তিতে মিথ্যাচার করে। অপরজন তাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেয়। এ দুজনই বিজেপির সর্বভারতীয় পর্যায়ের নেতা। একজনকে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি সাময়িক বহিষ্কার ও অপর জনকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে।

ইতিপূর্বে ভারতে সংগঠিত নানান মুসলিমবিদ্বেষী কার্যক্রমে এই মুসলিম দেশগুলো তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। বিশেষ করে মসজিদে এবং ও গরু খাওয়া নিয়ে চলতে থাকা অসংখ্য ঘটনা নিভৃতে হারিয়ে গেছে। কাশ্মীরের সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা ও দীর্ঘকালের সংকট নিয়ে কখনো কোনো মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ার পরে কাশ্মীর মুসলিমদের উপর যে নির্যাতন চালিয়েছে ভারত, এই মুসলিম দেশগুলো সে বিষয়ে কখনো কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি।

মুসলিম দেশগুলো বিষয়গুলোকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখেছে। মুসলিম ধর্মের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণ হিসেবে দেখেনি। ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি ও তার সংঘ পরিবার তার সমস্ত সীমারেখা পার করেছে। কিছুদিন আগে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের দেশদ্রোহী ১৮৬০ সালের আইন সম্পর্কিত এক রায়ের বিষয়ে দেশটির আইনমন্ত্রী তার লক্ষণ রেখা পার না হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন ।

ভারতীয় সুধী সমাজ জাতীয় কংগ্রেস ও বাম রাজনৈতিক দলসমূহ দীর্ঘকাল যাবত মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে ধর্মীয় সহিংসতা অব্যাহতভাবে পরিচালনা করছিল, বিজেপি সে বিষয়ে সবসময় প্রতিবাদী থাকা সত্ত্বেও সংযত হয়নি। বরঞ্চ ইতিহাসকে পাল্টে দেওয়ার জন্য তারা আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। তাজমহল স্বীকৃত ইতিহাস ,সেই ইতিহাসকে পাল্টানোর জন্য এলাহাবাদ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে যে রিট পিটিশন করা হয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করেছে আদালত। আবার বাবরী মসজিদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে তা বাবরি মসজিদ সম্পর্কিত ইতিহাসের যে বয়ান বিজেপি চালু করেছিল তাকে সমর্থন করা হয়েছে।

ভারতের হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া সন্ত্রাস শুধু ভারতকেই বিভাজন ও অশান্তির নিগড়ে নিক্ষেপ করছে না, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশিদের প্রতিও ক্রমাগত হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

যে প্রধান বিচারপতির সময়ে তার নেতৃত্বে আদালত বাবরি মসজিদ সম্পর্কিত চূড়ান্ত রায় দিয়েছিল সেই প্রধান বিচারপতি আজ ভারতীয় রাজ্যসভার বিজেপির সদস্য। বাবরি মসজিদ সম্পর্কিত রায় তাকে বিজেপি রাজ্যসভার সদস্য পদ এনে দিয়েছে তা ভারতের বিরোধী দলগুলো বারবার উল্লেখ করেছে। কারণ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সরাসরি রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার প্রথম ঘটনা এটি।

যে ১৫ জিসিসি ভুক্ত দেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই কর্মকান্ডের বিরোধিতা করেছে তাদের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুবই গভীর। ভারতের আজকের উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি এই দেশসমূহ। এই দেশ থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ভারতকে আজকের অর্থনীতির জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে কিংবা এখনো ভারতের লক্ষ লক্ষ লোক এই দেশগুলোতে শ্রমিক হিসাবে কর্মরত। এখানে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসায় ভারতীয়রা ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। ভারতের শ্রমিকদের কাছ থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস হচ্ছে এই ১৫টি দেশ। তাদের এই প্রতিবাদ যদি স্থায়ী প্রতিবাদে রূপ নেয় তাহলে ভারতের বর্তমান মুসলিম বিরোধী রাজনীতিতে অবশ্যই ভাটার টান দেখা যাবে ।

বিজেপি ভারতকে আর সাম্প্রদায়িক রাস্তায় পরিচালিত করতে পারবে না। যদিও ওআইসির প্রতিবাদকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি বিজেপি। সাম্প্রতিককালে সৌদি প্রিন্স সালমানের নানান বিষয়ের ভূমিকা বিশ্বের নানা প্রান্তে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করছে, তার নিজ দেশে বেশ কিছু গুণগত পরিবর্তন এনেছেন। ধারণা করা যেতে পারে ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সামগ্রিকভাবে মুসলিম দেশগুলোর একটি স্থায়ী বহিঃপ্রকাশ। দীর্ঘদিনের সম্পর্কের সংকটে ইরান ও সৌদি আরব একইভাবে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে।

সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতে মন্দির উদ্বোধন করে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী দেশের কাছে এমন একটি বার্তা সৃষ্টি করেছিল যাতে মনে করা হচ্ছিল বিজেপির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী নতুন ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে, যে ইতিহাস হচ্ছে মুসলিম বিদ্বেষ। ভারতীয় শাসক এই রাজনৈতিক দলটি এমন একটি সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করতো যা সমাজের মানুষকে তাদের মানুষ হিসাবে স্বীকার করত না। যা সেই দেশটির মধ্যে এখনো তীব্রভাবে বিরাজমান। এখনো দেশটি দলিত ও নিম্ন বর্ণের মানুষদের উপর অত্যাচারের হাতিয়ার চালিয়ে যাচ্ছে । যে দলিতরা সনাতন ধর্মের অনুসারী।

ডিসেম্বরে বেশ কজন হিন্দু ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ছবি- বিবিসি।

ব্রিটিশ শাসনের আগে এই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিধবা নারীদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার নিয়ম ছিল। ব্রিটিশ শাসনের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় রাজা রামমোহনরা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়ে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর সহায়তায় ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিলে উপস্থিত না হতেন, তাহলে হয়তো আজও সতীদাহ প্রথা বহাল থাকত ওই সমাজে। রাজা রামমোহনকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন দিল্লির দ্বিতীয় আকবর নামক মোগল শাসক। যদিও শাসন ক্ষমতা ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরা সেই সময় সতীদাহ বিরোধী আইনের বিপক্ষে ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করেছিলেন। তেমনি বিদ্যাসাগর যদি বিধবা বিবাহের পক্ষে না দাঁড়াতেন তাহলে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধই থেকে যেত। তখনকার ভারতীয় সমাজের ধর্মীয় পণ্ডিতরা নিষিদ্ধ করে রেখেছিল বিধবা বিবাহ।

তাদের ওই ধর্মীয় রীতিনীতির পদ পরিবর্তন মুসলিম সমাজের রীতিনীতি ও মানবতা ও মানবিকতা ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। এ সবকিছুই বর্তমান শাসক চক্র ভুলে গিয়ে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে যে সঙ্কট সৃষ্টি করছে তাতে পৃথিবীর বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একটি সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে বর্তমান শাসকদল।

আরও পড়তে পারেন-

এদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর আবেগের ওপর যে নির্মম আঘাত বিজেপির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সমাজ করেছে তাতে আমাদের সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। এই মুহূর্তে বোঝা না গেলেও আশংকা করা যায় দেশের ইসলামপন্থীরা এ বিষয়টিকে তাদের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করবে। যথার্থভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিবাদ না হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ সমাজেও তার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে অবশ্যই আমাদেরও গালফ দেশগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রতিবাদ করা উচিত যেন দেশের নতুন কোন উত্তেজনার সৃষ্টি না হয়।

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকাকে আমাদের কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে হবে কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের মূল ধর্ম বিশ্বাসের উপর আঘাত হানার কোনো অধিকার আমরা কোনো রাষ্ট্রকে কিংবা কোনো জনগোষ্ঠীকে দিয়েছি।

নূপুর শর্মা ও জিন্দালদের ঘটনার আগেও বিজেপির রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ লাগাতারভাবে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করিয়ে চলছে। তাদের ক্ষমতায়নের কালে যে মুসলিম জনগোষ্ঠী ভারত বিভাগের সময় ভারত ত্যাগ না করে ভারতেই তাদের দেশ হিসেবে মেনে নিয়ে বসবাস করছিল তাদের প্রায় সবাইকেই বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী হিসাবে বিভিন্ন সময়ে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে এই দলটি। বিশেষ করে আসামের জাতীয় পরিচয় অর্থাৎ এনআরসি সংশ্লিষ্ট আইন দ্বারা।

বর্তমান ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিম বাংলার সর্বশেষ নির্বাচনের সময়ে প্রায় প্রতিটি জনসভায় বিষয়টিকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলেন। যদিও পশ্চিম বাংলায় তার এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি, তা প্রমাণ হয়েছে তাদের নির্বাচনে ব্যাপক পরাজয়ের ফলে । তারপরও তারা এখন অবধি এ ধরনের বক্তব্য থেকে সরে আসেনি। আমরাই বরং একে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখে এ নিয়ে এতোদিন কোনো মন্তব্য করিনি, তবে এখন বোধ করি বলা উচিত। রাষ্ট্রটির বিশেষ করে বিজেপির এই কর্মকান্ডের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ করা উচিত।

সূত্র- টিবিএস-এর সৌজন্যে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।