Home ইসলাম ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য

ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য

।। ইকবাল কবীর মোহন ।।

ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং এখন ব্যাপক পরিচিত ও জনপ্রিয় বিষয়। এই ব্যবস্থা ব্যতিরেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বর্তমানে কল্পনাও করা যায় না। বর্তমান বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে এখন আট শতাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিংয়ের চর্চা করছে। অনেক অমুসলিম দেশেও ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয়েছে।

ফলে এই অর্থব্যবস্থা ও ব্যাংকিং সম্পর্কে প্রতিটি মানুষের জানা ও বোঝার ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আজকের প্রবন্ধটির গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামী অর্থনীতি ইসলামী সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এটি ইসলামী জীবনদর্শন, কৃষ্টি ও সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ‘মহান আল্লাহর নীতি-পদ্ধতি অনুসরণে সৃষ্টির লালন-পালনের যাবতীয় জাগতিক সম্পদের সামগ্রিক কল্যাণধর্মী ব্যবস্থাপনাকে ইসলামী অর্থনীতি বলে। অন্য কথায়, ‘যে সমাজবিজ্ঞান ইসলামী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সমস্যা পর্যালোচনা করে, তা-ই ইসলামী অর্থনীতি। ’

ইসলামী অর্থনীতির কয়েকটি সংজ্ঞা থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।
১. আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মিসরীয় অর্থনীতিবিদ এম উমর চাপড়া : Islamic economics is that branch of knowledge which helps to realize human well-being through an allocation and distribution of scarce resources that is in conformity with Islamic teachings without unduly curbing individual freedom or creating continued macro-economic and ecological imbalances. অর্থাৎ ইসলামী অর্থনীতি জ্ঞানের সেই শাখা, যা ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বণ্টন ও বরাদ্দের মাধ্যমে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা অযথা খর্ব ও সামষ্টিক অর্থনীতি এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি না করে মানবীয় কল্যাণ অর্জনে সহায়তা করে।

২. প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এম নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী : Islamic economics is the Muslim thinkers’ response to the economic challenges of their times. অর্থাৎ ইসলামী অর্থনীতি সমকালীন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুসলিম চিন্তাবিদদের জবাব।

৩. প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এম এ মান্নান : Islamic economics is a social science which studies the economic problems of the people in the light of Quran and Sunnah. অর্থাৎ ইসলামী অর্থনীতি হলো একটি সামাজিক বিজ্ঞান, যা কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে।

৪. বিশিষ্ট ইসলামী অর্থনীতিবিদ খুরশিদ আহমদ : Islamic economics represents a systematic effort to try to understand the economic problem and man’s behaviour in relation to that problem from an Islamic perspective.

অর্থাৎ ইসলামী অর্থনীতি হলো ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতির সমস্যা ও ওই সব সমস্যার সমাধানে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে মানবীয় আচরণকে বোঝার এক পদ্ধতিগত প্রয়াস। এসব সংজ্ঞা পর্যালোচনা করলে যেসব বিষয় স্পষ্ট হয় তা হলো : ১. ইসলামী অর্থনীতির উৎস হচ্ছে কোরআন ও সুন্নাহ। ২. ইসলামী অর্থনীতি জাগতিক সম্পদ উৎপাদন, বণ্টন ও ব্যবস্থাপনার একটি প্রক্রিয়া। ৩. উন্নয়নের জন্য ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামী অর্থনীতির পাথেয়। ৪. মানবসমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক বিষয়গুলো ইসলামী অর্থনীতির বিবেচ্য বিষয়। ৫. ইসলামী অর্থনীতিতে কল্যাণ বলতে তেমন কোনো কল্যাণকেই শুধু বোঝায় না, যা অর্থের মাপকাঠিতে বিবেচিত।

ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য : ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষের বস্তুগত কল্যাণ এবং একই সঙ্গে সামগ্রিক আধ্যাত্মিক উন্নয়ন। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। ইসলামের মৌলিক নীতি হচ্ছে আল্লাহর একত্ব, সার্বভৌমত্ব ও মানুষের খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—

ক. অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা : ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক জুলুম এবং একচেটিয়া দখলদারি নীতির পথ বন্ধ করা। কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়, বরং গোটা সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য। অর্থকে সবার মধ্যে সঞ্চারিত করা, তা পুঞ্জীভূত করে না রাখা, আল্লাহর নির্ধারিত পথে অর্থ ব্যয় করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়। আল্লাহ বলেছেন : ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। ’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৪)

আরও পড়তে পারেন-

খ. উন্নত নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা : সম্পদ আল্লাহর নির্ধারিত পথে কাজে লাগানোর মধ্য দিয়ে মানুষের ভেতর উন্নত নৈতিক গুণাবলি তৈরি করা ইসলামী অর্থনীতির আরেকটি উদ্দেশ্য। কোরআনের ঘোষণা হচ্ছে : ‘আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দেবে এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরও এবং অপব্যয় কোরো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় রবের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। ’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৬ ও ২৭)

গ. সামাজিক সাম্য ও স্থিতি সংরক্ষণ : ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য হলো, মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা এবং সামাজিক সাম্য ও স্থিতি সংরক্ষণ। এর ফলে সমাজে সবার অধিকার নিশ্চিত হবে। কেউ অভাবে থাকবে না, না থাকবে ক্ষুধার্ত। রাষ্ট্র আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে এবং নাগরিকদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও কর্মের সুযোগ তৈরি করে দেবে। এর মাধ্যমে সমাজে গড়ে উঠবে সাহায্য, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ। মানুষের জীবিকা সম্পর্কে কোরআনের বাণী হচ্ছে : ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোনো প্রাণী নেই, যার জীবিকার ব্যবস্থা (আল্লাহ) করেননি। ’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৬)

ঘ. একচেটিয়া ব্যক্তিমালিকানা ও জাতীয় মালিকানার বিলোপ : একচেটিয়া ব্যক্তিমালিকানা কিংবা জাতীয় মালিকানার কোনোটাই ইসলাম স্বীকার করে না। ইসলামে ব্যক্তিমালিকানাকে উৎসাহিত করা হলেও ব্যক্তির সম্পদে অপরের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সম্পদের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তাই আল্লাহর সম্পদে সবার অধিকার রয়েছে। ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ব্যক্তিমালিকানা এবং ইসলামের ব্যক্তিমালিকানার মধ্যে বেশ ফারাক আছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও ইসলামী অর্থনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করবে। দুনিয়ার সব সম্পদের মালিক যে আল্লাহ তা তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন : ‘আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর। তোমাদের মনে যা কিছু আছে তা প্রকাশ করো অথবা গোপন রাখো, আল্লাহ তার হিসাব তোমাদের কাছ থেকে গ্রহণ করবেন। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৪)

লেখক : সাবেক ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, বর্তমানে হেড অব বিজনেস অ্যান্ড শরিয়াহ সেক্রেটারিয়েট, স্ট্যাডার্ড ব্যাংক লিমিটেড

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।