Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন আমি ‘আধুনিক’ নই; হতেও চাই না; কিন্তু কেন? -পিনাকী ভট্টাচার্য

আমি ‘আধুনিক’ নই; হতেও চাই না; কিন্তু কেন? -পিনাকী ভট্টাচার্য

কয়েকদিন আগে আমাকে এক গুরুজন বললেন, ‘তুমি কি নিজেকে আধুনিক মনে কর?’ আমি নির্দ্বিধায় উত্তর দিলাম, না, আমি আধুনিক নই, হতেও চাই না।

‘আধুনিকতা’ হচ্ছে একটা বিশেষ ‘চিন্তা কাঠামো’। এই চিন্তা কাঠামোটা বুঝতে হলে ইউরোপে ১৭ এবং ১৮ শতকে প্রায় ২০০ বছর ধরে চলা নতুন চিন্তার উত্থানটাকে বুঝতে হবে। এর নাম আধুনিকতা।

৯/১১ এর আগে পর্যন্ত পাত্র-পাত্রির বাজারে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে শুনেছি সেকালে যে ছেলেটা বা মেয়েটা ‘আধুনিক’ কিনা। সেটা ছিল সেইসময়ে একটা ক্রেডেন্সিয়াল, বা বিশেষ যোগ্যতা হিসাবে দেখা হত। আবার আধুনিক বলতে অনেক স্তরের মানে হয়। ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম বা থিওলজি (ধর্মতত্ব) অস্বীকার করতে পারেও কিনা – এটা সম্ভবত আধুনিকতা বলতে যা বুঝায় এর সবচেয়ে পরিপুর্ণ রূপ। আবার আধুনিকতা বলতে আরবানাইজেশন, বা শহুরেপনা, শহরের তর-তরিকায় অভ্যস্ত যুবক ইত্যাদি- এই নিরুপদ্রব কাউকে কামড় দেয় না, এই অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

আবার কমিউনিজম যে পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে রুস্তমি করে সেটাও আধুনিকতাই। আধুনিকতা যার পয়সায় খায় সেই ক্যাপিটালিজমের একটা ক্রিটিক করে কেবল।

মার্কস যেটাকে বুর্জোয়া শ্রেণী বলে এক ধারণা খাড়া করে আমাদের চিনাতে চান আধুনিকতার চোখে সেটাই আধুনিকতা, আধুনিক শ্রেণী। ফলে মার্কসের বুর্জোয়া শ্রেণী বুঝবার আগে মানে বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামকে নিন্দা ও ঘৃণা করারও আগেই মর্ডানিটির ভিত্তি ‘এনলাইটেনমেন্ট’ নামের সেই লড়াইকে একটু বুঝতে হত। কিন্তু দেশের কোন কমিউনিস্ট বা প্রগতিশীল একাজ করে নাই। অথচ এই এনলাইটেনমেন্টের দৃষ্টিভঙ্গী আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আধুনিকতার সঙ্গে।

তাই আরেকভাবে বলতে গেলে, এই এনলাইটেনমেন্ট দৃষ্টিভঙ্গীর সর্বশেষ রাজনৈতিক কাঠামো রূপ হল আধুনিকতা। এই এনলাইটেনমেন্ট পর্বই আজকের আধুনিক চিন্তা কাঠামোর ভিত্তি আর পুঁজিবাদের মনোগাঠনিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়। এনলাইটেনমেন্ট এবং আধুনিকতাটাই যে মার্কসের বর্ণিত ‘বুর্জোয়া মতাদর্শ’, এটা প্রায় একশ ভাগ ‘প্রগতিশীল’ রাজনৈতিক কর্মীদের জানা নাই। ফলে তারা ভুল করেন সেটা খুব দুঃখজনক। প্রত্যেক প্রগতিশীল বা কমিউনিস্ট নিজেকে আধুনিক মনে করে। আধুনিকতা তাঁদের আরাধ্য।

এনলাইটেনমেন্ট প্রকল্পের মুখ্য দিক হচ্ছে যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিচার করা। যুক্তি মানে লোজো, লজিক বা র‍্যাশনালিটি। এমনকি মানুষের অনুভব, আবেগ, অনুভুতি, সত্তা, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে সে কেবল যুক্তির নিরিখে বিচার করে বসে। মানুষের ভালোবাসা বাৎসল্যকে দেখা হয় কেমিক্যাল রিয়াকশন হিসেবে। এমনকি প্রেমকেও- কোন নাকি গ্লান্ডের রস নিঃস্বরণ হিসাবে। হতাশা, সুখ আর আনন্দকেও দেখা হয় কেমিক্যাল ভারসাম্য হিসেবে। আধুনিকতার কাছে যুক্তিই শেষ কথা, যুক্তির বিচারে যে উত্তীর্ণ হতে পারবে না সে পরাজিত এবং তা পরিত্যাগযোগ্য। যুক্তির সর্বস্বতা অথবা এই একচ্ছত্র আধিপত্যকে খুব মনোহর মনে হয়। পৃথিবীর চোখ ধাধিয়ে গিয়েছিল এই নতুন চিন্তার দর্শনে। অথচ শেষ বিচারে মানবিক সম্পর্ক নন-লজিক্যাল বা বিয়ন্ড লজিক্যাল; যাকে বলা যেতে পারে যুক্তির সীমানার বাইরের বিষয়।

যুক্তিই আধুনিকতার চিন্তা ও সংস্কৃতির একমাত্র মানদণ্ড আর বাকিরা যারা এই আধুনিকতার মানদণ্ডে আধুনিক বলে সার্টিফিকেইট পায়না, তাদেরকে বলা হয় অসভ্য, বর্বর ও পশ্চাৎপদ।

আমাদের বাম আর স্যেকুলারেরা হয়ে উঠেছেন, এই আধুনিকতার সিপাহসালার। আমরা স্যেকুলার আর বামদের যেই ক্রিটিক করি সেইটা তাঁদের এই আধুনিকতার গোঁসাই-গিরির জন্য করি। আমরা বলতে চাই, যা করছেন সেইটা বুঝে করছেন তো? আমরা দেখিয়ে দিতে চাই এই আধুনিকতার সীমাবদ্ধতা। কারণ এই সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে অতিক্রম করে আমরা নতুন চিন্তাকাঠামোর দুনিয়ায় যেতে চাই। আবার আধুনিকতা চিন্তা কাঠামো যতই ধর্মত্যাগী দাবি করুক না কেন ওর জন্ম ঠিকুজির মধ্যে আছে খ্রিস্ট্রতন্ত্র। আমরা আধুনিকতাকে অতিক্রম করে সেই ক্রিটিকটা করি।

এইবার আসেন আধুনিকতার এই যুক্তির জগত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেইটা দেখি। আমাদের যেই দৃশ্যমান জগত, সেই জগতের যেইটা ফিজিক্যাল বা বস্তুগত সেখানে যুক্তি দারুণ কাজ করে। কিন্তু মানুষ আর মানবিক সম্পর্কগুলোকে যুক্তি দিয়ে বিচার করা চলে না। আমি অনেককেই বলেছি একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে। ধরেন আপনার গোঁফ আছে, আপনার মা বললেন, ধুর এই গোঁফ ভালো লাগে না, কেটে আয়। আপনার গোঁফটা দারুণ পছন্দ, আর আপনাকে গোঁফে দারুণ মানায়, এটা অসংখ্য (মেয়ে)বন্ধুরা আপানাকে বলেছে।

এখন এই পরিস্থিতিতে আপনি কী করবেন? শেষে আপনি অনেক কিছুর পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সেটা মায়ের পক্ষে বা প্রেমিকার (প্রেমিক) পক্ষে অথবা স্বার্থপরভাবে নিজের পক্ষ কান্নি মেরে। কোন দিকে যাবেন সেটা নিয়ে খুব কিছু বলার নাই। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত যুক্তি দিয়ে না, সম্পর্ক (সম্পর্কের গুরুত্ব) দিয়ে টানতে হবে। এটাই মূল কথা।

এই কারণেই আধুনিক পশ্চিম, বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে গ্লানিতে ভোগে না, সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে না, বাচ্চাকে বাসায় রাখতে পারে না, বন্ধু বানাতে পারে না, সমাজ বানাতে পারে না, কোন পরমের আকাংখা নাই। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক বিষয়টাকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত টানা হয়। শুধু নিজের বানানো যুক্তির খাচায় এক নিঃসঙ্গ বন্দি; যেই বন্দি জীবনের আর কোন লক্ষ্য নাই, শুধু নিজে ভোগ করে খুশি হওয়া ছাড়া। দুঃখজনকভাবে এই যুক্তির খাঁচায় থাকাকে সুখ মনে করে মানুষ আটকে যায়।

আমি তো চাই না আধুনিক হতে, আপনি চান কি?

লেখক: গবেষক, চিন্তক, গ্রন্থ লেখক ও জনপ্রিয় অনলাইন এক্টিভিস্ট।