Home ইসলাম ব্যাংকিংয়ে শরিয়াহ অনুসরণের সহজ উপায়

ব্যাংকিংয়ে শরিয়াহ অনুসরণের সহজ উপায়

।। ড. ইকবাল কবীর মোহন ।।

শরিয়াহ পরিপালন ইসলামী ব্যাংকের জন্য অপরিহার্য বিষয়। এটি যথাযথভাবে নিশ্চিত করা না গেলে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মূল উদ্দেশ্যই বিলীন হয়ে যায়। তাই শরিয়াহ পরিপালনের ওপর সবাইকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

শরিয়াহ পরিপালনকে যথাযথ করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে :

কর্মকর্তা ও কর্মচারী পর্যায়ে করণীয় : ইসলাম, ইসলামী ব্যাংকিং, নীতি-নৈতিকতা, হালাল-হারাম, আখিরাতে জবাবদিহিতা ইত্যাদি সম্পর্কে জানা এবং আখিরাতে মুক্তির বিষয়ে সচেতন থাকা গেলে শরিয়াহ পরিপালন সহজ হয়ে যায়।

এ জন্য যেসব কাজ করতে হবে তা হলো : ১. কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জ্ঞানের প্রসারতার জন্য মাঝেমধ্যে শাখাভিত্তিক বা জোনভিত্তিক স্টাডি সার্কেল, আলোচনা সভা, সেমিনার বা ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ২. কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ, কমিটমেন্ট ও পরকালীন জবাবদিহিতার অনুভূতি বৃদ্ধি ও শাণিত করার চেষ্টা করা। ৩. পড়াশোনার জন্য প্রত্যেক শাখায় প্রয়োজনীয় বইয়ের ব্যবস্থা করা। ৪. শরিয়াহ জানা ও মানার জন্য পুরস্কার এবং না জানা ও না মানার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা।

গ্রাহক পর্যায়ে করণীয় : একমাত্র ব্যাংকাররা শরিয়াহ সম্পর্কে জানলেই চলবে না। গ্রাহকদেরও তা জানতে-বুঝতে হবে এবং তা পালনের চেষ্টা করতে হবে। ১. ইসলাম ও ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। ২. ইসলামী ব্যাংকিং জানা ও মানার জন্য গ্রাহকদের উদ্বুদ্ধ করা। ৩. গ্রাহকদের মধ্যে পরকালীন জবাবদিহিতার অনুভূতি বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে। এ জন্য গ্রাহকদের নিয়ে আলোচনা সভা ও সেমিনার করা। ৪. ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ওপর সহজ ভাষায় লেখা কিছু পুস্তিকা গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা করা। ৫. ইসলামী মনোভাবাপন্ন গ্রাহক বৃদ্ধির চেষ্টা চালাতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে করণীয় : ১. প্রতিটি শাখায় মার্কেটিং সেল রাখা, যারা মালের ক্রয়-বিক্রয় নিশ্চিত করবে। মালামালের ক্রয়-বিক্রয় নিশ্চিত করার পর বিনিয়োগ বিতরণ করা। ২. কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রাহককে এবং প্রয়োজনে ভিন্ন কোনো সংস্থাকে ব্যাংকের পক্ষ থেকে ক্রয় এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া। ৩. গ্রাহকের চাহিদামতো মালামালের সরবরাহকারী নিয়োগ দেওয়া। ৪. ক্রয়-বিক্রয় প্রমাণের জন্য সঠিকভাবে ডকুমেন্ট সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৫. ইসলামী ব্যাংকিং আইন কাঠামো তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় চেষ্টা-তদবির জোরদার করা। ৬. শরিয়াহ পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিবীক্ষণের পাশাপাশি বাইরের পরিবীক্ষণ জোরদার করা।

পরিবেশ সৃষ্টিতে করণীয় : ১. সুদের বিরুদ্ধে ও ইসলামী অর্থনীতির পক্ষে জনমত গঠনে তৎপর হওয়া। ২. গোটা অর্থনীতিকে ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজানোর জন্য চেষ্টা করা।

শরিয়াহ পরিপালনে কতিপয় সহজ উপায়

ব্যাংকের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় শরিয়াহ পরিপালনে সীমাবদ্ধতা, মালের বেচাকেনা সঠিকভাবে সম্পন্ন না করা ও মালের মালিকানা অর্জন না করে তা বিক্রি করার ক্ষেত্রে যেসব আলোচনা করা হয়েছে, তা নিরসনের জন্য ওআইসি ইসলামী ফিকহ একাডেমি কতিপয় সুপারিশ করেছে। ১৯৯০ সালের মার্চে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত একাডেমির ষষ্ঠ সম্মেলনে এসব সুপারিশ গৃহীত হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলো এসব সিদ্ধান্তের আলোকে কাজ করতে পারে। নিচে সুপারিশসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. টেলিফোনের মাধ্যমে মালামাল ক্রয় করা : ফিকহ একাডেমির সিদ্ধান্ত : যখন পরস্পর দূরবর্তী অবস্থান থেকে দুই পক্ষের মধ্যে একই সময়ে চুক্তি হয় এবং এটা টেলিফোন বা ওয়ালেসের মাধ্যমে হয়, তখন তাদের মধ্যকার চুক্তি দুই উপস্থিত ব্যক্তির মধ্যে চুক্তি বলে গণ্য হবে। তাই ব্যাংক বাই-মুরাবাহা ও বাই-মুয়াজ্জাল পদ্ধতিতে গ্রাহকের সঙ্গে বিনিয়োগ চুক্তি সম্পাদনকালে বা আগে সরাসরি বা টেলিফোন, ওয়ারলেস, ফ্যাক্স, টেলেক্স, ই-মেইল, ইত্যাদির মাধ্যমে (প্রস্তাব প্রদান ও প্রস্তাব গ্রহণ মানে ইজাব ও কবুল) ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করতে পারে এবং বাস্তব মালিকানাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ফলে এর মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন না হওয়ার কোনো কারণই নেই।

আরও পড়তে পারেন-

২. কোটেশনের মাধ্যমে ক্রয় : ফিকহ একাডেমির সিদ্ধান্ত : কোটেশন বা দরদাতা যখন এসব (আধুনিককালের যোগাযোগের সব) উপায়ে নির্দিষ্ট মেয়াদসংবলিত ইজাব বা প্রস্তাব গ্রহণ করেন, তখন ওই মেয়াদের মধ্যে ইজাব বা প্রস্তাবের ওপর অনড় থাকা তার জন্য বাধ্যতামূলক হবে এবং তা থেকে সরে আসার কোনো অধিকার তার থাকবে না। ব্যাংক সরবরাহকারী থেকে ব্যাংকের বরাবরে যথাযথভাবে লিখিত দরপত্র বা কোটেশন গ্রহণ করে বিনিয়োগ প্রদান করতে পারে। বস্তুত কোটেশন বিক্রেতার পক্ষ থেকে ব্যাংকের কাছে মালামাল বিক্রির লিখিত প্রস্তাব বা ইজাব। আর এই প্রস্তাব ব্যাংক গ্রহণ করা মানে ব্যাংকের পক্ষ থেকে কবুল বোঝায়। তাই ব্যাংকের দরপত্র বা কোটেশন গ্রহণ করার মাধ্যমে শরিয়াহর দৃষ্টিতে ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয়। এভাবে ইজাব ও কবুল সম্পাদিত হওয়ার মাধ্যমে মালামালের ওপর ব্যাংকের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ব্যাংক এই কোটেশন সরাসরি সরবরাহকারীর কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারেন অথবা ব্যাংকের গ্রাহক বা অন্য কোনো উপায়েও তা ব্যাংকের কাছে আসতে পারে।

৩. মালামালের দখল লাভ ও মালামাল বুঝিয়ে দেওয়া : ফিকহ একাডেমির সিদ্ধান্ত : মালামালের দখল লাভ যেমন খাদ্য-দ্রব্যের বেলায় প্রত্যক্ষভাবে হাতে ধরে বা পরিমাপ অথবা ওজন করে কিংবা দখল লাভকারীর নিয়ন্ত্রণে স্থানান্তরের মাধ্যমে হয় তেমনি বর্তমান দখলদারের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে দখল লাভকারীর ব্যয় ব্যবহারের অধীন করে দেওয়ার মাধ্যমেও পরোক্ষভাবে হতে পারে যদিও এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ দখল হয় না। শরিয়াহর দৃষ্টিতে মালামালের দখল ও মালিকানা থাকলে তা বিক্রি করা যাবে। শরিয়াহর দৃষ্টিতে দখল দুইভাবে হতে পারে। একটি হলো হাতে ধরে, সরাসরি উপস্থিত হয়ে পরিমাপ বা গণনা করে বুঝে নিলে, তা হবে প্রত্যক্ষ দখল। দ্বিতীয়টি হলো কোনো বস্তু বা মালামাল বুঝে নিতে যদি কোনো বাধা না থাকে, তাহলে সেই মালামালও তার দখলে আছে বলে ধরে নেওয়া যায় এবং এটা হলো পরোক্ষ দখল। এ ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক টেলিফোন বা কোটেশনের মাধ্যমে মালামাল ক্রয় করার পর ব্যাংক যাকে মাল প্রদান করতে বলবে তাকে প্রদান করতে যদি সরবরাহকারীর কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে শরিয়াহর দৃষ্টিতে মালামাল ইসলামী ব্যাংকের দখলে রয়েছে বলে ধর্তব্য হবে।

মালামাল ক্রয়-বিক্রয় ও এর মালিকানা ও দখল নিয়ে যে জটিলতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে ওপরে আলোচিত প্রতিকারের বিষয় ছাড়াও এ বিষয়ে নতুন প্রোডাক্ট সৃষ্টির মাধ্যমে সমস্যার সহজ সমাধানের উপায় ভাবা যেতে পারে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। আশা করা যায়, বিষয়টি আরো স্বচ্ছ ও যৌক্তিক পর্যায়ে সুরাহা হবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক।

বর্তমানে, প্রধান ব্যবসায় উন্নয়ন ও শরিআহ

সেক্রেটারিয়েট, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।