Home ওপিনিয়ন আবহাওয়া অস্থির, বিশ্ব পরিস্থিতিও খাদ্য সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে

আবহাওয়া অস্থির, বিশ্ব পরিস্থিতিও খাদ্য সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে

- ফরিদা আখতার।

।। ফরিদা আখতার ।।

এ বছরের শুরু থেকে আবহাওয়াকে খুব অস্থির দেখছি। শীতকালে ভালই শীত পড়ল, সাথে অসময়ের বৃষ্টি হলো কয়েকবার। মাঘের শেষের বৃষ্টি মাসের মাঝখানেই হলো, ফাল্গুনেও বৃষ্টি হলো। আবার চৈত্র-বৈশাখে বৃষ্টি নেই, একটা কাল বৈশাখিও হলো না ঠিক মতো।

প্রচন্ড তাপমাত্রা বেড়ে গেল। দেশের এক এক অঞ্চলে এক এক রকম আবহাওয়া, কোথাও বন্যা, কোথাও তীব্র খরা। এক কথায় জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা জলবায়ু দুর্যোগে আমরা অন্যান্য দেশের মধ্যে পড়ে গিয়েছি।

বাংলাদেশে সারা বছরই কোন না কোন ফসল বোনা ও কাটার সময় থাকে, কাজেই অবহাওয়ার তারতম্য সরাসরি ফসলের ওপর প্রভাব ফেলেছে। খাদ্য ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এই প্রভাব কতটা দৃশ্যমান হয় তা সরকারের পরিসংখ্যানে অবশ্যই দেখা যাবে।

কিন্তু ক্ষুদ্র পর্যায়ের কৃষকদের কিছু অভিজ্ঞতা দেখলে একটু চিন্তিত হতে হয় বৈকি। তারা রবি মৌসুমের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি পুরোপুরি, বোরো ধানও ঠিকমত পেকে ওঠার আগেই বন্যায় তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। এখন সিলেট-সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যে বন্যা হচ্ছে তাতে ঘর-বাড়ি যেমন ডুবেছে, তেমনি ধানের গোলা, বীজের ভান্ডার, খাদ্য গুদাম – সবই ডুবেছে। তাহলে দেশে খাদ্য ঘাটতি হবে কি না সে আলোচনা কি আমরা করছি?

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরাতে পত্রিকার খবরে (২৪ মে, ২০২২) দেখা যাচ্ছে হাওর এলাকায় বন্যার কারণে ৭৮৯৮৭ টন বোরো ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এ বছর ৪৯.৬৩ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান করা হয়েছিল, তার মধ্যে ১৯,৭২২ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। যদিও কৃষি মন্ত্রণালয় আশাবাদ ব্যক্ত করেছে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও বোরো ফলন ভাল হবে এবং ক্ষতির পরিমাণ ৮০,০০০ টনের কম হবে।

কিন্তু গবেষকদের মতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং কোভিড-১৯ মহামাররির প্রেক্ষিত বিচার করলে খাদ্য ঘাটতি এবং তা মেটাবার সম্ভাবনার সুযোগ যথেষ্ট কম থাকবে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন এবং ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিড মহামারি বৈশ্বিক ঘটনা, এবং আমরা তার বাইরে নই। কাজেই সরকারকে সে বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।

এখন দেখা যাক, বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি কেমন।

জাতিসংঘের হিসাবে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে খাদ্য পণ্যের মূল্য ২০.৭% বেড়েছে, এবং আরও বাড়বে। জুন মাসের ২০ তারিখে জাতিসংঘের উপ-মহাসচিব আমিনা মোহাম্মদ একটি ভাষণে বলেছেন, ২০২১ সালে ৫৩টি দেশের ১৯ কোটি মানুষ ৩০ লক্ষ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু এখন ইউক্রেন যুদ্ধের পর যুদ্ধের প্রভাব ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। এখন খাদ্য সংকট আরো বেড়ে যাবার আশংকা রয়েছে। একই সাথে কোভিড মহামারির সুযোগ নিয়ে বিশ্বে খাদ্য ব্যবসায়ীরা রমরমা ব্যবসা করেছেন।

তাই আমিনা মোহাম্মদ সতর্ক করেছেন গত দুই বছরে অর্থাৎ কোভিড মহামারির সময় ৬২ জন নতুন ফুড বিলিয়নিয়ার হয়েছেন।

এ বছর মে মাসে অক্সফাম বিলিনিয়ার খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোর ওপর প্রতিবেদন দিয়েছে। খাদ্য পণ্যে কার্গিল আরও তিনটি কোম্পানি নিয়ে পুরো কৃষি পণ্য বাজারের ৭০% নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০২১ সালে কার্গিলের ব্যবসায়িক জীবনের সর্বোচ্চ মুনাফা লাভ (৫ বিলিয়ন ডলার) করেছে, এবং আশা করছে ২০২২ সালেও রেকর্ড মুনাফা অর্জন করবে। একই সাথে বিপরীত চিত্র হচ্ছে সারা বিশ্বে খাদ্য পণ্যের দাম রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে; সবখানেই মূল্যস্ফীতি ঘটছে। গরিব দেশের গরিব মানুষেরা খাদ্য সামগ্রী ক্রয়ে দ্বিগুণ বেশি খরচ করছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্য সংকটের একটি বড় কারণ অস্বাভাবিক তাপমাত্রা। ভারতে ১২২ বছরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল মার্চ মাসে। ঠিক এই সময়টা ছিল গমের পেকে ওঠার সময়। ফলে ভারত ও পাকিস্তানের গমের আবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি ভারত থেকে গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ সরকার এই নিষেধাজ্ঞা জারির আগে ৩ লক্ষ টন গম আমদানির অর্ডার দিয়ে রেখেছিল, সেটা পাওয়া না গেলে বাংলাদেশে চালের ওপর চাপ বাড়বে।

অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ্বের কারণে রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম সরবরাহ ব্যহত হয়েছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন সারা বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গম রপ্তানি করে। তার সাথে ভারতের দুর্যোগ যোগ হয়েছে। গম বিশ্বের অনেক দেশের প্রধান খাদ্য। ফলে গমের উৎপাদন কমে গেলে সরবরাহ কমে যাবে এবং দাম বেড়ে গেলে মানুষের খাদ্য প্রাপ্তি বিরাট সংকটে পড়বে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য পণ্যের মধ্যে গম সরবরাহের ওপরই প্রধানত প্রভাব পড়ছে। ফলে চালের চাহিদা বাড়ছে এবং দামও বাড়ছে। জাতিসংঘের ইউএন এফএও রাইস প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ী চালের দাম ১০% বেড়ে গেছে। চাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম গমের বিকল্প হিশেবে চালের ওপর জোর দিচ্ছে এবং তারাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৫০% মানুষের প্রধান খাদ্য চাল। কাজেই চালের উৎপাদন এবং সরবরাহ খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু চাল উৎপাদনের জন্য যে সারের প্রয়োজন হয় তার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়ে গেছে।

সব কিছু বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে জলবায়ু দুর্যোগ যেমন তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, অতি বৃষ্টি খাদ্য বিশ্বব্যাপী খাদ্য ফসল উৎপাদনের জন্যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। কিন্তু পাশাপাশি যুদ্ধ, বিভিন্ন দেশের সংঘাত খাদ্য সরবরাহে বাধার সৃষ্টি করছে। উৎপাদন হলেও সরবরাহ করা যাচ্ছে না, যা ইউক্রেনের যুদ্ধের ক্ষেত্রে হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

মার্চ মাসে ইউক্রেনের গমবাহী ৩০০ জাহাজ রাশিয়ার সৈন্যরা কৃষ্ণ সাগরে আটক করে রেখেছে , ফলে প্রায় ২ কোটি টন গ্রেইন (গম) সরবরাহ কমে গেছে। একই সাথে রাশিয়াও বিশ্বের অন্যতম প্রধান গম রপ্তানিকারক দেশ। পশ্চিমা ন্যাটোভুক্ত দেশ ইউক্রেন আক্রমণের অপরাধে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গম সরবরাহ করে। শুধু তাই নয় রাশিয়া বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক সার যেমন পটাশ, এমোনিয়া, ইউরিয়ার প্রধান সরবরাহকারী। যুদ্ধের কারণে সার সরবরাহেও ঘাটতি হচ্ছে ফলে সয়া, ধান, গম এবং ভূট্টা উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।

যুদ্ধ সহজে থামবে না, কোভিড মহামারিও ঘুরে ফিরে আসতে থাকবে, বিশ্বের ধনী দেশের কার্বন নিঃসরণ না কমালে জলবায়ু দুর্যোগ হতেই থাকবে; আর যারা এ অবস্থার সুযোগে ব্যবসা করছে সে বিলিনিয়নরাও দাম বাড়িয়ে মুনাফার পাহাড় গড়বে। অক্সফামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২৬ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ অতি দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যাবে।

বিশ্ব ব্যাংকের সংজ্ঞায় অতি দরিদ্র হচ্ছে দৈনিক ১.৯০ ডলারের কম আয়। এর অর্থ হচ্ছে লক্ষ-কোটি মানুষ দু’বেলা খেতে পারছে না, অথবা কম পরিমাণে খাচ্ছে। খাদ্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণে বাংলাদেশের গরিব মানুষের খাদ্য গ্রহণ অনেক কমে গেছে, তারা চাল কিনলে তেল কিনতে পারছে না, মাছ-মাংস দূরে থাক শাক-সবজিও ঠিক মতো পাচ্ছে না।

এ অবস্থা থেকে কতগুলো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে আমাদের সার্বিক খাদ্য ব্যবস্থা মাত্র কয়েকটি খাদ্য পণ্য যেমন চাল, গম, ভুট্টা ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল করা যাবে না। এসব খাদ্য পণ্য এখন আন্তর্জাতিক বাজারে গুটি কয় কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তারা তাদের মুনাফার স্বার্থে মানুষকে ক্ষুধার্থ রেখে দিতেও পিছপা হচ্ছে না।

পৃথিবীর লক্ষ-কোটি কৃষকরা যে বৈচিত্রপূর্ণ খাদ্য উৎপাদন করেন তার ওপর আমাদের নজর দিতে হবে। আরও বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং রাসায়নিক সার-কীটনাশক নির্ভর খাদ্য উৎপাদন বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান থেকে সরে এসে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে যেতে হবে। এর জন্যে কিছু সময় লাগবে ঠিকই কিন্তু কাজ এখন থেকেই শুরু করতে হবে নইলে ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করবে। এখনই সাবধান হবার সময়।

লেখক: মানবাধিকার কর্মী।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।