Home ফিকহ ও মাসায়েল ইসলামে সফর মাস কি অশুভ?

ইসলামে সফর মাস কি অশুভ?

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

হিজরী সনের দ্বিতীয় মাস সফর। অভিধান মতে, ‘সফরুন’ শব্দের অর্থ খালি, শূন্য ও মুক্ত। আবার এটি জন্ডিস ও ক্ষুধা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সফর শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) তাঁর স্বরচিত ‘নিহায়া’ কিতাবে লিখেন যে, সফর হলো, পেটের ভেতরে অবস্থানকারী এক ধরনের বিষাক্ত কীট, মানুষকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় যা কামড় দিয়ে কষ্ট দিতে থাকে। এটি একটি ছোঁয়াচে রোগকেও বলা হয়।

কাজী আয়াজ (রাহ.) তার নিজ কিতাব ‘মাশারিকুল আনওয়ার’এ লিখেন- এটি এমন প্রসিদ্ধ একটি মাস, যাকে জাহেলী যুগে অধিক সম্মান দিয়ে মাহে মুহাররামের অন্তর্ভুক্ত করে, তার সমপরিমাণ মর্যাদা দেয়া হতো। আবার কেউ কেউ বলেন- এটি মুহাররাম এবং বরিউল আওয়াল এর মধ্যবর্তী একটি প্রসিদ্ধ মাস। লোকজনের ধারণা, এ মাসে বেশি পরিমাণে বিপদ-আপদ এবং অধিক বালা-মুসিবত অবতীর্ণ হতো।

আর ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও এর বাস্তবতায় দেখা যায় যে, এ মাসটিকে  জাহেলী যুগে অত্যন্ত খারাপ ও অশুভ মনে করা হতো। তারা মনে করতো, এ মাস মানুষের জন্য খুবই অপয়া। আবার এ মাসে ভালো ও কল্যাণকর কোনো কাজ করলেও তাতে মন্দের প্রভাব ও ক্ষতির দিকই অধিক থাকে। যে কারণে এ মাসে তারা কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ-শাদী ও সফর করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতো। আর এ বিষয়টিকে যথাযথভাবে তারা মেনে চলার চেষ্টা করতো। কেননা, তাদের ধারণা অনুযায়ী এ সময়ে কোনো ব্যক্তি ভালো কোনো কাজ শুরু করলে এর মন্দ প্রভাব অবশ্যই সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। এ থেকে নিষ্কৃতি বা মুক্তির উপায় কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়।

তাই সে সমাজের প্রত্যেকে একে নিজে যেমন মেনে চলতো, তেমনি অন্যদেরকেও এ নিয়ম কঠোরভাবে পালনের জন্য আহ্বান জানাতো।

এমন ধারণা তাওহীদ বা একত্ববাদের উপর চরম আঘাত স্বরূপ। সুতরাং এটিও এক প্রকার র্শিকের মধ্যে শামিল। হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই প্রথা ও ধারণাকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন আখ্যায়িত করে বলেন, সংক্রামক ব্যাধি বলতে ইসলামে কিছু নেই এবং অলক্ষুণে বা অশুভ লক্ষণ বলতে কোন কিছুকে ইসলাম অনুমোদন করে না। পেঁচার আওয়াজকে অশুভ জ্ঞান করা এবং সফর মাসকে অমঙ্গল ধারণা করা শরীয়ত সম্মত নয়। (বুখারী শরীফ)।

অন্য এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- কোন ব্যক্তি পরিপূর্ণ ঈমানদার ততক্ষণ পর্যন্ত হবে না, যতক্ষণ না সে তাকদীর ও তার ভালমন্দ সব কিছুর উপর সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করবে। দুনিয়াতে যা কিছু ঘটতে থাকে ভালমন্দ আল্লাহ্র হুকুমে ও তাকদীর অনুযায়ীই ঘটে। এবং এটাও অন্তরে অটুটভাবে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, কোন আপদ-বিপদ বা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়, তাহলে এমন নয় যে, (অন্য পথ বা পন্থা অবলম্বন করলে) তার সম্মুখীন হতে হত না। (তিরযিমী শরীফ-২/৩৭)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো ইরশাদ করেন- বাস্তব ক্ষেত্রে একের রোগ অন্যের মধ্যে বিস্তার করে না। বদ শকুনীর কোন অস্তিত্ব ইসলামে নেই। উলু পাখির ডাক কখনো ক্ষতিকর নয়। সফর মাসে কোন অশুভ লক্ষণ নেই। (বুখারী শরীফ)।

তাই সফর মাসে যে কোনো কাজ করাতে কোনো অসুবিধে নেই। কেননা, ভালো ও মন্দ উভয়ের সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তিনি যে বিষয়টিকে যেভাবে রাখবেন, তা সেভাবেই থাকতে বাধ্য। তিনি কোনো বস্তুকে মানুষের জন্য লাভজনক কিংবা ক্ষতিকর হিসেবে উল্লেখ করলে, বাস্তবে তা সেভাবেই আখ্যা পাবে। যেমন- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “তোমাদের কাছে হয়তো কোনো একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তো বা কোনো একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয়, অথচ তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না”। (সূরা বাকারা- ২১৬)।

এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, সকল বস্তুর স্রষ্টা যেহেতু একমাত্র আল্লাহ তাআলা। সৃষ্টির জন্য ভালো কিংবা মন্দ হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে তিনিই খবর রাখেন। সৃষ্টি জীবের জন্য ভালো ও কালোর পার্থক্য কেবল তাঁরই জ্ঞানের আয়ত্তাধীন। সুতরাং মানব জীবনের কল্যাণ ও অকল্যাণকর প্রতিটি বিষয় তিনি তাঁর প্রেরিত নবী ও তাঁর ওপর নাযিলকৃত কিতাবে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। আর সৃষ্টিজীব হিসেবে প্রত্যেকের জন্য তা মেনে চলা খুবই জরুরী।

হাদীসে রাসূলে সফর মাস সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে- হযরত জাবের (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, সফর মাস কোনো অসুস্থতা, অমঙ্গল, অশুভ ও ক্ষতির কারণ নয়। (মুসলিম)।

হাদীসের এ বাণী থেকেও সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, বস্তুর শুভ-অশুভ হওয়াটা সম্পূর্ণই নির্ভর করে তার সৃষ্টিকারী আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। মানুষের ধারণার সাথে বস্তুর কল্যাণ হওয়া না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অশুভ ভেবে কোনো কাজ ছেড়ে দেয়া বা তা থেকে বিরত থাকা, আবার শুভ ভেবে অশুভ কাজকে উৎসাহের সাথে করা সমীচীন নয়।

আরও পড়তে পারেন-

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, যাতে মানব জীবনের সকল বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে। ইসলামের এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা মানুষের বোধ ও বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ততা রাখে। একজন মু’মিনের বোধ ও বিশ্বাস এমন হওয়া বাঞ্চনীয় যে, সব কিছু হওয়া ও না হওয়ার মূলে বিশ্ব প্রতিপালক মহামহিম আল্লাহ তাআলার কুদরতী হাতই কার্যকর থাকে। এ পৃথিবীর সকল সৃষ্টির কর্মকাণ্ড তারই দৃষ্টিশক্তির অধীনে। এগুলির ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ এবং শুভ-অশুভ হওয়া আল্লাহ তাআলার খেয়াল ও খুশির ওপর নির্ভর করে। সুতরাং তাঁর সৃষ্টিজীব ও সৃষ্টবস্তুকে কোনো দোষে অভিযুক্ত করার অধিকার মানুষের নেই। তিনি যেভাবে যে বস্তুকে পরিচালিত করেন, তা সেভাবেই চলতে থাকে। তিনি যে বস্তুকে ভালো বলে উল্লেখ করেন, তা কল্যাণকর বলে বিবেচিত হয়। আবার কোনো বস্তুকে মন্দ বললে, তা নিন্দনীয় হিসেবে পরিগণিত হয়।

অতএব, কুরআনের আলোকে এবং হাদীসে রাসূলের ইরশাদ অনুযায়ী সফর মাসকে মানুষের জন্যে অকল্যাণ ও অশুভ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়নি। তাই এ মাসকে অকারণে অমঙ্গলজনক ও অশুভ লক্ষণ মনে করা কিছুতেই সঠিক ও যথার্থ হবে না। অন্যান্য সময়ের মতো এ মাসেও যে কোনো ধরনের কাজ-কারবার, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিবাহ-শাদীসহ যে কোনো কাজ করতে দোষের কিছু নেই।

প্রসঙ্গঃ আখেরী চাহার সোম্বা

এই মাসে প্রচলিত একটি বিদআত হলো, ‘আখেরী চাহার সোম্বা’। যারা এটা পালন করেন, তারা সফরের শেষ বুধবারে গোসল করে সেই দিন তাবিজ ইত্যাদি নিয়ে থাকেন। প্রফুল্লচিত্তে ভালো খাবার রান্না করেন, যা মূলত কোনো সাহাবী এমনকি চার খলীফা, আশারায়ে মুবাশ্শারা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, উলামায়ে মুহাক্কিকীন, মুফতি, মুহাদ্দিসগণের বর্ণনা কিংবা কুরআন- হাদীস, ফিকহ, সীরাত বা ইতহিাস গ্রন্থের কোথাও উল্লেখ নেই।

তাদের আকিদা হলো- সফর মাসের চতুর্থ বুধবার নবীজি (সা.) অসুস্থতা থেকে সুস্থতা লাভ করেছিলেন। সেই খুশিতে উল্লিখিত কাজগুলো তারা করে থাকেন । কিন্তু তা বিশুদ্ধ কোন ঐতিহাসিক সূত্রে বর্ণিত নেই। বরং ইতিহাসে পাওয়া যায়, মাহে সফরের শেষ বুধবার নবীজি (সা.)এর অসুস্থতা শুরু হয়েছে। পরন্তু যদি তা সাওয়াব ও বরকত লাভের কাজ হতো, তাহলে খলীফাতুর রাসূল হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.), আমিরুল মুমিনীন হযরত উমর (রাযি.), হযরত উসমান (রাযি.), হযরত আলী (রাযি.) তথা খুলাফায়ে রাশেদা ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম তা পালন করতেন।

 নবীজি (সা.)এর মরযে মউতের বর্ণনা

যে বছরের রবিউল আউয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইন্তিকাল করেছেন ঐ বছর সফর মাসের চতুর্থ বুধবার রাতে নিজ গোলাম মুআইহেবাকে জাগ্রত করলেন এবং বললেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে হুকুম করেছেন যে, আমি যেন জান্নাতুল বাকীর অধিবাসীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি । নবীজি রাতে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে তাদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করে ফিরে এলেন। অতঃপর হঠাৎ করে শরীরে অসুস্থতা অনুভব করলেন এবং গায়ে জ্বর আসলো। সেদিন পালা ছিলো উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা’র (রাযি.) ঘরে বিশ্রাম নেওয়ার। যখন অসুস্থতা বেড়ে গেলো, তখন উম্মুহাতুল মুমিনীনদের সম্মতি সাপেক্ষে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ‘আয়েশা সিদ্দিকা (রাযি.)’এর ঘরে থাকেন। সেখানে ১৪/১৫ দিন অসুস্থ থাকার পর রবিউল আউয়াল মাসের ২য় সপ্তাহ সোমবার তিনি ইন্তিকাল করেন । (জুরকানী- ৮/২৫১)।

ইতিহাস যাচাই করলে বুঝা যায় যে, সফরের শেষ বুধবার থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর অসুস্থতা শুরু হয়েছিলো। কাজেই যারা সেদিন আনন্দ উৎসব পালন করে তারা বিদআত করার সাথে সাথে প্রকারান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মরযে মউতের উপর খুশি পালন করে থাকে।

সাবধান মুসলিমগণ! এদিনে শয়তান নেকীর আদলে মুসলমানদেরকে কত বড় জঘন্য কর্মকান্ডে লিপ্ত করে দিচ্ছে।

আমাদের সকলের স্মরণ রাখা চাই যে, যেসব আকীদাকে রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং অস্বীকার করেছেন সেসব আকীদা পোষণ করা গুনাহ এবং হারাম। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.), সাহাবী, তাবিইন, তাবে তাবিইনের মধ্যে কেউ কোন দিন ক্ষণ বা সময়কে অশুভ বলার কোন প্রমাণ নেই। এমনকি কোন নির্দিষ্ট দিন বা মাসে বিয়ে-শাদীকে অশুভ বলে তারা কখনও প্রকাশ করেননি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করে সে মোতাবেক আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: মুফাসসির, মুহাদ্দিস, মুফতি এবং সহযোগী পরিচালক, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব- নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।